ইসলামী দলগুলোও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। আগামী নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়ার দাবিতে গত ১০ আগস্ট পাঁচটি ইসলামী দল বৈঠক করে। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠক থেকে সরকারকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের গণদাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানান নেতারা।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলে মনে করেন দেশের অধিকাংশ ইসলামী দলের নেতারা। এজন্য দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনকে দায়ী করেন তারা। নেতারা মনে করেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার কারণে তাদের সাজানো প্রশাসন সরকারি দল বা জোটের পক্ষে জোরালো ভূমিকা নিয়ে থাকে। সরকারি দলের নেতাকর্মীরাও শক্তি প্রয়োগ করে থাকে। এ কারণে বিরোধীদলগুলো অসহায় পড়ে। ভোটাররাও তাদের নিজের মতামত প্রয়োগ করতে পারে না। নির্বাচন কমিশনও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। এজন্যই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক বা যে নামেই হোক নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেন, গত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। বর্তমান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচন দেশে-বিদেশে কোথাও গ্রহণযাগ্য হয়নি। বরং বিতর্কিত হয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনগুলোতেও ভোটার উপস্থিতি কম ছিল, নানা অনিয়মও হয়েছে। সব দল অংশ নেয়নি। আর এসব কারণেই এখন বিদেশীরা আসছে। এটা দেশের জন্য ভালো নয়। আগামী নির্বাচন একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে না হলে সে নির্বাচনও সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হবে না। এজন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দাবি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার। তিনি আরো বলেন, অতীতের অভিজ্ঞতা এবং বাস্তবতার আলোকে এ কথা বলতেই হয়, সরকারের আজ্ঞাবহ এই নির্বাচন কমিশনের উপর জনগণের কোনো আস্থা নেই, বরং অতিসম্প্রতি অনুষ্ঠিত কয়েকটি উপনির্বাচনেও নিরপেক্ষ সরকারের অপরিহার্যতাই প্রমাণিত হয়েছে। পাঁচ দলের জোট প্রসঙ্গে তিনি জানান, প্রাথমিক আলোচনা চলছে। দাবির বিষয়ে আমরা ঐক্যমত। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আশা করি সামনে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে পারব।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমেদ বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না তা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারই প্রমাণ করেছে। তারা দিনের ভোট রাতে করেছে, জোর জবরদস্তি করেছে। উপ-নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে যাচ্ছে না। পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাই ধ্বংস করেছে সরকার। নির্বাচন কমিশনও তাদের আজ্ঞাবহ আচরণ করে। এ কারণে মানুষের এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে কোনো আস্থা নেই। এ জন্যই আমরা নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন করছি। আগস্ট, সেপ্টেম্বরজুড়েই আমাদের আন্দোলন চলবে। আর অক্টোবরে ঢাকায় মহাসমাবেশ করা হবে।
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী বলেন, দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রয়োজন। কারণ দেশে দলীয় সরকারের অধীনে যেসব নির্বাচন হয়েছে তার কোনোটাই সুষ্ঠু হয়নি। এজন্য আমরা নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে ২০২২ সালে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। নির্বাচন কমিশনেও স্মারকলিপি দিয়েছি। এ ছাড়া নেজামে ইসলামী পার্টি, ইসলামী ঐক্য আন্দোলনসহ বিভিন্ন ইসলামী দল নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে। ইসলামী ঐক্যজোটও বর্তমান সঙ্কটের সমাধান, ভোটাধিকার, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে।
দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। কেয়ারটেকার বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফর্মুলা তাদের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আজম তৈরি করেছিলেন। জামায়াতে ইসলামী ও আওয়ামী লীগ প্রথম এ দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। পরে তার বাস্তবায়ন ঘটে। তখনকার ক্ষমতাসীন দল বিএনপি প্রথমে এটি মেনে না নিলেও পরে জনগণের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে জাতীয় সংসদে এটি পাস করে। এরপর ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যে নির্বাচনগুলো যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা পায়। কিন্তু এরপর যে আওয়ামী লীগ নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল তারাই শেষ পর্যন্ত এ পদ্ধতি বাতিল করে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী এখনো তাদের সে অবস্থানে অনড় রয়েছে। তারা এখনো নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। দলটির নেতারা মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার কারণে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। গত ১৬ আগস্ট অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ছোটখাট ত্রুটি থাকলেও তা দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনগুলো দেশে-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ভোটাররা ভোট দিতে পারেনি। দিনের ভোট রাতে হয়ে গেছে। প্রশাসন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেনি।
সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দিয়েছে। এজন্যই আমরা মনে করি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে হলে অবশ্যই নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজন। এ কারণেই আমরা আন্দোলন করছি।
দেশের অন্যতম ইসলামী শক্তি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। চরমোনাই পীরের অনুসারীরাই মূলত এ দলের কর্মী-সমর্থক। দলটির নেতারা মনে করেন, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না। এজন্য তারা নির্বাচনে আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। একই সাথে তারা নিরপেক্ষ একটি সরকারের অধীনে নির্বাচন চান। বিরোধীদল তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইলেও তারা চান জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, যে সরকারে নিবন্ধিত দলগুলোর প্রতিনিধি থাকবেন। আর প্রধান হবেন আপিল বিভাগের বর্তমান কর্মরত একজন গ্রহণযোগ্য বিচারপতি। তাদের কেউ নির্বাচন করতে পারবেন না। বর্তমান মন্ত্রী-এমপিরাও কেউ এর সদস্য হতে পারবেন না। এছাড়া তারা আসনভিত্তিক প্রার্থীর পরিবর্তে দলভিত্তিক ভোট চান। যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে তারা ততটি আসন পাবেন এ ধরনের একটি ফর্মুলারও বাস্তবায়ন চান তারা। ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র ও সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাদের অধীনে প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ থাকে না। মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে না। ইলেকশন নয় শুধু সিলেকশন হয়েছে। এজন্যই আমরা সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি নিরপেক্ষ সরকারের দাবি জানিয়েছি। সরকার যদি এ দাবি না মানে তাহলে গণবিস্ফোরণ বা গণঅভ্যুত্থান ঘটতে পারে।