‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। গতকাল সোমবার (২৮ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এ বিষয়ে ব্রিফিংয়ে বিস্তারিত জানাবেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে বিকেল সাড়ে ৪টায় এ ব্রিফিং শুরু হবে।
এর আগে গত ৭ আগস্ট বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ পরিবর্তন করে নতুন এ খসড়া আইনের নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এটির নাম দেয়া হয় ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩।’
এদিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তিত হয়ে সাইবার নিরাপত্তা আইন হয়েছে। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মধ্যে যেসব ধারা ছিল, সেই ধারা রেখে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার জনগণের সরকার। সেজন্য আমরা সেটাকে যেসব মিসইউজ এবং অ্যাবিউজ হয়, সেগুলো বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি আইনের মাধ্যমে।
তিনি আরও বলেন, এখানে বহু ধারা সংশোধন হয়েছে। এটার আজকে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল নয়, পরিবর্তন হচ্ছে।
দুটি ধারা জামিনযোগ্য: আরও দুটি ধারা জামিনযোগ্য করে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। গতকাল সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এখন কারিগরি ধারা ছাড়া খসড়া আইনের আর কোনো ধারা অজামিনযোগ্য নেই। সরকার বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন করছে। ৭ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়।
প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া নিয়ে অংশীজন ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ ছিল, আইনে সাজা কিছু কমানো ও ধারা জামিনযোগ্য করা ছাড়া বিষয়বস্তুতে তেমন কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। এতে মানুষের হয়রানি কমাবে না। ৯ আগস্ট আইনটির খসড়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে অংশীজনদের মতামত চাওয়া হয়। এ জন্য তারা ১৪ দিন সময় দিয়েছিল। প্রায় ৫০০টি মতামত জমা পড়ে। মন্ত্রিসভায় চূড়ান্তভাবে অনুমোদনের আগে খসড়া আইনের বিষয়বস্তুতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়েছে কি না, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, যে দুটি ধারা নতুন করে জামিনযোগ্য করা হয়েছে তার একটি ২১ নম্বর ধারা। অন্যটি কোন ধারা তা তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেননি মন্ত্রী। উল্লেখ্য, ২১ নম্বর ধারায় মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় পতাকা প্রভৃতি অবমাননার সাজার কথা বলা হয়েছে।
নামেই বদল,বিষয়বস্তুতে নয়: প্রকাশের পর বিশ্লেষকরা দাবি করেছিলেন.প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় কিছু ক্ষেত্রে সাজা কমেছে এবং জামিনযোগ্য ধারা বেড়েছে। বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন ধরনের অপরাধকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, তা প্রায় হুবহু প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেও রাখা হয়েছে। দুটি আইনের বিষয়বস্তুও প্রায় একই রকমের। এমনকি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশন, সম্পাদক পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের যেসব আপত্তি-উদ্বেগ ছিল, প্রস্তাবিত নতুন আইনেও সেসব দূর করা হয়নি। শুধু কিছু ক্ষেত্রে সাজা কমেছে এবং জামিনযোগ্য ধারা বেড়েছে। গত বুধবার সন্ধ্যায় সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের অধীন ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির ওয়েবসাইটে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। এই খসড়ার সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দুই আইনের মধ্যে পরিবর্তন বলতে প্রথমত শাস্তি কমানো ও জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের অপরাধের (প্রমাণিত হলে) ক্ষেত্রে কারাদ-ের পরিবর্তে শুধু জরিমানার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারা (৩৩ ও ৫৭) প্রস্তাবিত আইনে একেবারে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই দুই ধারায় প্রথমটিতে ‘বেআইনিভাবে তথ্য-উপাত্ত ধারণ, স্থানান্তর ইত্যাদির দ-’ সম্পর্কে বলা আছে। আর দ্বিতীয়টিতে ‘সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম’ সম্পর্কিত অপরাধের কথা বলা আছে।
এখন যেটা করা হয়েছে, আমার মনে হয় এটি (সাইবার নিরাপত্তা আইন) সাইবার অপরাধ বন্ধ করতে অত্যন্ত সহায়ক হবে। আর আপনারা (সাংবাদিকেরা) যেসব অভিযোগ করছিলেন, সেই অপব্যবহারও বন্ধ হবে। নতুন আইনের খসড়ায় মোট ধারা ৬০টি, যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রয়েছে ৬২টি। প্রস্তাবিত আইনে কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে প্রথমবারের জন্য যে সাজা, বারবার করলেও একই সাজা হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে সাজা বেশি রাখার বিধান রয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে উল্লেখ করে তা সংশোধনের দাবি করেছিল সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ। এখন প্রস্তাবিত আইনে এ ক্ষেত্রে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধন আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, আগের মতোই রয়ে গেছে। আর দুটি ধারায় কোনো পরিবর্তনই আনা হয়নি।
অন্যদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের দপ্তর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারা (২১ ও ২৮) বাতিলের আহ্বান জানিয়েছিল। প্রস্তাবিত আইনে এই দুটি ধারা বাতিল না করে সাজা ও জামিনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে সংস্থাটি যে আটটি ধারা (৮, ২৫, ২৭, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) সংশোধনের কথা বলেছিল, তার ছয়টিতে পরিবর্তন (মূলত সাজা এবং জামিনের ক্ষেত্রে) করা হয়েছে।
সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীদের অনেকে বলছেন, প্রস্তাবিত নতুন আইনে সাজা কমানো ও জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানোর বিষয়টি ইতিবাচক হলেও আইনের সংজ্ঞা আগের মতোই বহাল রাখা এবং বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন না আসায় অপপ্রয়োগ ও অপব্যবহারের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। সাজা কমানোর কিংবা বাড়ানো কিংবা সাজার মাত্রা পরিবর্তনের ঘটনায় নাগরিকদের অধিকার বা সুরক্ষা হবে না। যেসব পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তা নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকার সুরক্ষায় খুব একটা কাজে আসবে না। সম্পাদক পরিষদ এক বিবৃতিতে বলেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের চরিত্রগত পার্থক্য না থাকলে শুধু নাম বদল করে নতুন আইন করা অর্থহীন। সংগঠনটি বলছে, প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনও যেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ারে পরিণত না হয়, সে জন্য এটি চূড়ান্ত করার আগে সংবাদপত্রের অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন।
অবশ্য এই আইনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত সোমবার সাংবাদিকদের বলেছেন ‘এখন যেটা করা হয়েছে, আমার মনে হয় এটি (সাইবার নিরাপত্তা আইন) সাইবার অপরাধ বন্ধ করতে অত্যন্ত সহায়ক হবে। আর আপনারা (সাংবাদিকেরা) যেসব অভিযোগ করছিলেন, সেই অপব্যবহারও বন্ধ হবে।’