‘দ্য কুইন্ট’-এর প্রতিবেদন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নেতৃত্বাধীন বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষ ক্রমেই বাড়ছে। যার ফলে পুলিশের গুলিতে ডজন খানেক মানুষের মৃত্যু, জনগণের সম্পদ ধ্বংস, ধর্মঘট, অবরোধ এবং ৮০০০ জনেরও বেশি বিক্ষোভকারীকে আটক করার ঘটনা ঘটেছে। বিরোধীরা হাসিনার পদত্যাগ এবং জানুয়ারিতে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছেন।
পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলেছে, মাসিক বেতন তিনগুণ করার দাবিতে হাজার হাজার পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন। এই রাজনৈতিক অস্থিরতা ভারতের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। সত্যি বলতে, ভারত সম্মিলিতভাবে (জাতিসংঘ) নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। যেহেতু নয়াদিল্লির অন্য যে কোনো বিদেশী শক্তির চেয়ে বাংলাদেশে অনেক বড় অংশীদারিত্ব রয়েছে, তাই সে বাংলাদেশের অস্থিরতার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। তবে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনও পর্যন্ত প্রকাশ্যে কিছু বলেনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার স্পষ্টতই চায় না যে হাসিনা বিএনপি-জামায়াত-ই-ইসলামীর পদত্যাগের চাপের কাছে নতি স্বীকার করুক এবং নির্বাচনের তদারকি করার জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করুক যার ফলে অবশ্যম্ভাবীভাবে তার আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটবে। সেটা ভারতের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী।
নয়াদিল্লি এবং ওয়াশিংটন আসন্ন নির্বাচনটি যেভাবে দেখছে: ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা কর্তৃত্ববাদী হাসিনা (৭৬) তার ‘এক-দল, এক-নেতার’ শাসনকে স্থায়ী করতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আরো ৫ বছর মেয়াদের দিকে নজর দিচ্ছেন। জানুয়ারিতে তাকে পুনঃনির্বাচিত করা ভারতের পররাষ্ট্র নীতি-সহ-নিরাপত্তা সংস্থানের সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে ভারত তার উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে কারণ ভারতের সমস্ত চাহিদা, কানেক্টিভিটি এবং ট্রানজিট থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা এবং কৌশলগত প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশ না চাইতেই পূরণ করে দেয়।
স্বাভাবিকভাবেই, নয়াদিল্লি কেবল এটাই চায় না যে হাসিনা জিতুক, বরং চায়- যে কোনো উপায়ে জিতুক। যতক্ষণ না তিনি আরও এক মেয়াদের জন্য শপথ নিচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি যে পন্থাই অবলম্বন করুন না কেনো তা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয় ভারত। ২০১৪ এবং ২০১৮ উভয় নির্বাচনে স্পষ্টতই কারচুপি হওয়া সত্ত্বেও (বিশেষ করে গতবারের বিশাল বিজয়) ভারতই ছিল প্রথম দেশ যারা হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছিল। এবারও নয়াদিল্লি চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে হাসিনা নির্বাচন পরিচালনা করুক যাতে তার বিজয় সুনিশ্চিত হয়।
এর বিপরীতে, যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দুনিয়া অবাধ, সুষ্ঠু এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচনের উপর জোর দিচ্ছে যা বিরোধী শিবিরে বিশাল স্বস্তি বয়ে এনেছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে বাধাগ্রস্তকারী যে কোনো বাংলাদেশি কর্মকর্তা বা রাজনীতিবিদের ভিসা বাতিল করার হুমকি দিয়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে আশা জাগিয়েছে ওয়াশিংটন। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমারা হাসিনাকে অন্তর্র্বতী প্রশাসনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার কথাটি বলছে না। নয়াদিল্লিও এটা আশা করছে না। কারণ, নিরপেক্ষ সরকার পরিচালিত নির্বাচন নিশ্চিতভাবে ভারতপন্থী হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করবে। পাকিস্তানে আগস্ট মাসে আনোয়ারুল হক কাকারের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার শপথ গ্রহণ করেছে। ওই সরকার আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের তত্ত্বাবধান করবে। এরপর নেওয়াজ শরিফ, ইমরান খান এবং বিলাওয়াল ভুট্টোদের মধ্য থেকে কেউ দায়িত্ব নেবেন। বাংলাদেশের সংবিধানেও নির্বাচন তত্ত্বাবধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগের শাসন স্থায়ী করার জন্য হাসিনা সেটা বাতিল করে দেন।
বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা: জেনারেল এরশাদকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করার পর ১৯৯০ সালে তিন রাজনৈতিক জোট প্রথম নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অনানুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেছিল। পরবর্তীকালে, ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে একে আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনগুলো প্রকৃতপক্ষে নিরপেক্ষ প্রশাসন দ্বারা তত্ত্বাবধান করা হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ব্যাপারে আন্তরিক ছিল। কিন্তু বিএনপি’র প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ২০০৪ সালে আইন পাশ করে সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের অবসরের বয়স ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ বছর করে (যাতে তিনি পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্ব দিতে পারেন) এটিকে ধ্বংস করেছিলেন। এই পদক্ষেপ ছিল নিরপেক্ষতার মূল নীতির পরিপন্থী। কারণ, কে এম হাসান ছিলেন বিএনপি’র সেক্রেটারি, যিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হয়েছিলেন!
আওয়ামী লীগের চরম অসন্তোষে কে এম হাসান ওই পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাতে বাধ্য হন। কিন্তু, আদপে তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থারই অপূরণীয় ক্ষতি হয়। ২০০৬ সালে বিএনপির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এমন সাংবিধানিক সংকট দেখা দেয় যে প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন।
তারপর ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি ‘ড্রাকোনিয়ান’ সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়, যেটি খালেদা ও হাসিনা উভয়কেই কারাগারে নিক্ষেপ করে। অবশেষে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন দেওয়া হয় এবং চূড়ান্ত পরিণতিতে ২০০৯ সালের ০৬ জানুয়ারি ক্ষমতায় বসেন হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে হাসিনা সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক (২০১১ সালের মে মাসে) অন্তর্র্বতীকালীন প্রশাসনের ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করা নিশ্চিত করেন। এর ঠিক পরের মাসেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সমাপ্তি ঘটায় সংসদ। গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে এবং ক্ষমতাসীন দলকে নিজের নির্দেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় নির্বাচনে কারচুপি করা থেকে বিরত রাখতে ১৫ বছর আগে যার সূচনা হয়েছিল। এটা সত্যিই পরিহাসের বিষয় যে, আজ যে বিএনপি এতো জোরালোভাবে আসন্ন নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে বলে দাবি করছে তারাই ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালীন ২০০৪ সালে নির্লজ্জভাবে তাকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল।
সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আস্থার বড় ঘাটতি: বাংলাদেশে সরকার এবং বিরোধী দল উভয়েই নিজের অবস্থান থেকে সরতে নারাজ। অন্তর্র্বতী প্রশাসনের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিরোধী নেতাকর্মী এবং পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ সারা দেশে নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও, (করোনা) মহামারী এবং ইউক্রেন যুদ্ধ মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি ধুঁকছে।
ঢাকা আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) এর কাছে ৪.৪৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ চায়। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার স্টক ২০.৬৬ বিলিয়নে ডলারে নেমে গেছে। রক্তক্ষয়ী রাস্তার লড়াইয়ের মধ্যে, ৫৬ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি প্রত্যাখ্যান করে তিন গুণ বেতন বৃদ্ধির দাবিতে রাস্তায় নেমেছে পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা। পুলিশ এবং আধা-সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি তাদের (ওই আন্দোলনের) বিরোধীদের সাথে লড়তে হচ্ছে, যা সহিংসতাকে আরও উস্কে দিচ্ছে । সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে আস্থার ঘাটতি এতো বেশি যে এই সময়ে মধ্যস্থতা করতে এমন এক তৃতীয় পক্ষ প্রয়োজন যে অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে সক্ষম। যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে আলোচনার টেবিলে আনতে পারে এমন কেউ বাংলাদেশে নেই। বিদেশী শক্তিগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাদের বিরোধীদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে দেখা হয়। আর তাই, হাসিনা রেজিমের কাছে তারা গ্রহণযোগ্য নয়। অন্যদিকে, ভারতকে খুব বেশি হাসিনাপন্থী হিসেবে দেখা হয়। বিএনপি-জামায়াতের কাছে সৎ মধ্যস্থতাকারীর আস্থা জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে এই বক্তব্য ঠিকই আছে।এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে, নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে ভারতের আঙিনায় (বাংলাদেশে) আরও রক্তপাত ও অস্থিরতার সম্ভাবনা রয়েছে। [ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক এবং আউটলুকের সাবেক উপ-সম্পাদক এস এন এম আবদির লেখাটি দেশটির ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম ‘দ্য কুইন্ট’ এ ১২ই নভেম্বর ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে]