মানবাধিকারবিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক আব্দুল মতিন। তিনি বলেন, শুধু গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের কথা কিতাবে লেখা থাকলেই হবে না। বরং তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়। তাই এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ লাভ করতে হলে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের আদর্শ ধারণ এবং বৈরী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায় কিতাবের কথায় কোনো কাজ হবে না।
তিনি গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম মিলনায়তনে ‘সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লিগাল রিচার্স’ আয়োজিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মাস উপলক্ষ্যে ‘মানবাধিকারের ধারণা ও বাস্তবতা: বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লিগ্যাল রিসার্চ-এর প্রধান অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ শফিকুর রহমানের সভাপতিত্ব এবং অ্যাভোকেট আসাদ উদ্দীন ও অ্যাডভোকেট মীর নূরুন্নবী উজ্জলের যৌথ পরিচালনায় প্রধান আলোচকের আলোচনা পেশ করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ।
সেমিনারে কি-নোট উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এ কে এম বদরুদ্দোজা এবং বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন সিনিয়র আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোটেক জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অব:) এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট অ্যাডভোকেট মো: মাসদার হোসেন এবং সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ও বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ।
বিচারপতি আব্দুল মতিন বলেন, আমাদের বিচারবিভাগ কার্যত স্বাধীন নয়। স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের বিষয়টি কোনো সঙ্কীর্ণ বৃত্তে আবদ্ধ নয়। বরং একগুচ্ছ অধিকারের নাম। মানুষের অনেকগুলো মৌলিক ও প্রাকৃতিক অধিকার রয়েছে। যা কোন আইন দ্বারা লঙ্ঘন করা যায় না। মানুষ কতিপয় জন্মগত অধিকার নিয়ে জন্মায়। এসব সময়ই অলঙ্ঘনীয়। কোনোভাবেই ভায়োলেট করার সুযোগ নেই। কিন্তু রাষ্ট্র নাগরিকের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। দেশে গুম, অপহরণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
প্রধান বক্তার বক্তব্যে অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, অধিকার মানুষের জন্মগত। তাই আইন তৈরি করে মানুষের অধিকার লঙ্ঘনের কোনো সুযোগ নেই। মানুষের অধিকার তখনই লঙ্ঘিত হয় যখন বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারে। আর আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকলেও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। মূলত রাষ্ট্রের মাধ্যমেই মানবাধিকারের লঙ্ঘন ঘটে। তাই মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করতে হবে। অন্যথায় কোনো কিছুই মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে না।
কি-নোটে অ্যাডভোকেট এ কে এম বদরুদ্দোজা বলেন, মূলত বিশ্বনবী সা:-এর মদীনা সনদই মানবাধিকারের সুস্পষ্ট দলিল। এই সনদে শুধু মুসলমান নয় বরং ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকারের নিশ্চয়তা প্রধান করা হয়েছে। ঘোষণা করা হয়েছে সর্বজনীন মানবাধিকার, নারী অধিকার, মানুষের সম্মান ও জানমালের নিরাপত্তার কথা। তাই সকল শ্রেণির মানুষের অধিকারের নিশ্চয়তার জন্য আমাদের মদীনার সনদের আদর্শই অনুসরণ করতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অ্যাডভোটেক জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, মানবাধিকরের সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু রাষ্ট্রই এখন মানুষের অধিকারের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত দেশে এখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের মহোৎসব চলছে। জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার নেই। দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এখন খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। তাই এ অবস্থা থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে সম্মিলিত প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই।
অ্যাডভোকেট মাসদার হোসেন বলেন, বিচারবিভাগ স্বাধীন না হলে দেশে গণতন্ত্র থাকে না। মানুষের অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা যায় না। আর বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা না গেলে আমাদের কোন অর্জন ফলদায়ক ও ইতিবাচক হবে না। তিনি দেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সকলকে সোচ্চার ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।