তিন সন্তানকে নিয়ে জাপানি মা ও বাংলাদেশি বাবার আলোচিত মামলায় আপিলের রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। রায়ে বলা হয়েছে, বিচ্ছেদ হওয়া এই দম্পতির দুই শিশু জেসমিন মালিকা (বড়) ও তার ছোট বোন সোনিয়া তাদের জাপানি মা নাকানো এরিকোর কাছে এবং মেজো মেয়ে লাইলা লিনা বাংলাদেশি বাবা ইমরান শরীফের কাছে থাকবে। এছাড়া প্রথম ও তৃতীয় মেয়েকে নিয়ে এরিকো বাংলাদেশে বা যেকোনও দেশে বসবাস করতে পারবেন, তবে বাবা সন্তানদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবেন বলেও রায়ে বলা হয়েছে। একইভাবে দ্বিতীয় মেয়ে লাইলা লিনা বাবা ইমরান শরীফের কাছে থাকবে। তবে দ্বিতীয় মেয়ের সঙ্গে দেখার সুযোগ পাবেন মা। এ বিষয়ে একটি আপিল আবেদনের আংশিক মঞ্জুর করে গতকাল মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) বিচারপতি মামনুন রহমানের নেতৃত্বাধীন একক হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। আদালতে ইমরান শরীফের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার আখতার ইমাম, রাশনা ইমাম ও অ্যাডভোকেট নাসিমা আক্তার লাভলী। অন্যদিকে এরিকোর পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কেসি ও অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির।
এর আগে, ঢাকার জেলা জজ আদালত রায় দেন বাংলাদেশে থাকা জেসমিন মালিকা ও লাইনা লিনা জাপানি মায়ের কাছে থাকবে। পরে সে রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেন ইমরান শরীফ। ২০২৩ সালের ৯ মার্চ জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনাকে বিদেশে নিয়ে যেতে তাদের মায়ের আবেদন নাকচ করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে দুই শিশু কার জিম্মায় থাকবে এ সংক্রান্ত আপিল জেলা জজ আদালতকে তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন আদালত। এ সময় পর্যন্ত জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনা যেভাবে আছেন সেভাবেই থাকবে। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন ৭ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
এর আগে, ইমরান শরীফ ও এরিকোর দুই শিশুকে মায়ের জিম্মায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। নাবালিকা দুই শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনা কোথায় থাকলে কল্যাণ হবে সেদিক বিবেচনায় রেখে এ রায় দেওয়া হয়। ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমান এ রায় দেন।
আদালতের পর্যবেক্ষণ: রায়ে আদালত বলেছেন, মামলা করার কারণ আদালতের কাছে প্রমাণ করতে পারেনি বাদীপক্ষ। বরং আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, জাপান থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা দুই শিশুর বেড়ে ওঠা জাপানে। সেখানে তারা লেখাপড়া করেছে। তাদের মা পেশায় একজন চিকিৎসক। তিনটি সন্তান জন্মের পর মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে সন্তানদের পাশে ছিলেন। পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, জাপানে বেড়ে ওঠা দুই শিশুর প্রাথমিক শুশ্রূষাকারী তাদের মা। অথচ তাকে কিছু না জানিয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়া হঠাৎ অন্য একটি দেশে নিয়ে আসাটা মাতৃত্বের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন রূপটিকে অসম্মান করার নামান্তর।
রায়ে আদালত আরও বলেছেন, বাবা হিসাবে ইমরান শরীফ নাবালিকা দুই সন্তানের সঙ্গে দেখা করার পূর্ণ হকদার। তবে মায়ের কাছে দুই নাবালিকার হেফাজত তাদের শারীরিক, মানসিক ও পারিপার্শ্বিক, তথা সার্বিক মঙ্গলজনক বলে আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এই রায়ের বিরুদ্ধে জেলা জজ আদালতে আপিল ও পরবর্তিতে হাইকোর্টে আবেদন জানান ইমরান শরীফ।
২০০৮ সালে জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকোর সঙ্গে বাংলাদেশি প্রকৌশলী ইমরান শরীফের বিয়ে হয়। দাম্পত্য কলহের জেরে ২০২০ সালের শুরুতে বিচ্ছেদের আবেদন করেন এরিকো। এরপর ইমরান স্কুলপড়ুয়া বড় দুই মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। আর ছোট মেয়ে থেকে যান জাপানে মা এরিকোর সঙ্গে। তবে ওই দুই মেয়েকে জিম্মায় পেতে ২০২১ সালে বাংলাদেশে আসেন ওই জাপানি নারী। দুই মেয়েকে হাইকোর্টে হাজির করাতে রিট করেন তিনি।