বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত হন শিক্ষক সেলিম রেজা। তার মৃত্যুতে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন স্ত্রী জেসমিন আরা। এ অবস্থায় দেড় বছরের সন্তান তাশরিফও বার বার বাবাকে খুঁজে ফিরছে। তাশরিফ জানে না তার বাবা আর কোনো দিন ফিরবেন না। কথাগুলো বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে ৪ আগস্ট ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন হওয়া শিক্ষক সেলিম রেজার স্ত্রী জেসমিন আরা। সেলিম রেজা বগুড়া লাইট হাউস স্কুল ও কলেজের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তার বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার পানিকান্দা গ্রামে। তবে তিনি স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানকে নিয়ে বগুড়া পৌরসভার ছিলিমপুর এলাকায় ভাড়া বাড়িতে থাকতেন।
স্বামীকে হারিয়ে অনেকটা নির্বাক জেসমিন। অনেক প্রশ্নের ভিড়েও মুখ থেকে কথা বের হচ্ছিলো না তার। জেসমিন আরা জানান, তার স্বামী তার শিক্ষার্থীদের খুব ভালোবাসতেন। যে কারণে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে প্রথম থেকেই তাদের সাথে থাকতেন সেলিম রেজা। শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করতেন তিনি। ৪ তারিখ বেলা ১১টায় তিনি বাড়ি থেকে বের হন আন্দোলনে যোগ দিতে। এরপর বিকেলে লাশ হয়ে ফেরেন।
শিক্ষক সেলিম রেজা হত্যাকা-ের ঘটনায় নিহতের বাবা সেকেন্দার আলী গত বৃহস্পতিবার রাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে হুকুমের আসামি করে মোট ১০১ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছেন। মামলায় আরও ৩৫০ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, শেখ হাসিনা এবং ওবায়দুল কাদেরের হুকুমে গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বেলা ৩টায় বগুড়া শহরের সাত মাথা স্টেশন সড়কে আইএফআইসি ব্যাংকের সামনে আওয়ামী লীগের সাবেক দুই সংসদ সদস্যসহ সাত নেতার নেতৃত্বে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালিয়ে ককটেল ও পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে। এ সময় শিক্ষক সেলিম হোসেন রক্তাক্ত হন। বগুড়া পৌরসভার কাউন্সিলর আবদুল মতিন সরকার ও আমিনুল ইসলাম রামদা দিয়ে কুপিয়ে এবং কাউন্সিলর আরিফুর রহমান হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে তাকে জখম করেন। পরে অন্য হামলাকারীরা অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যায়।
সেলিম হত্যাকা-ের বিচার চেয়ে তার স্ত্রী জেসমিন আরা আরও বলেন, যারা হত্যার সাথে জড়িত, তাদের সঠিক বিচার চাই আমি। এখন তো সব কিছুই থেমে গেছে। সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। আমার স্বামী আমার সাথে নেই। সংসারে তো তিনিই একমাত্র উপার্জন করতেন। আমার সংসার চালানোর মতো কেউ নাই। জানি না সামনে কি হবে। আমি তো এখন একা, এখন আমি কি করবো? আমি আমার স্বামীর জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।
সেলিম রেজার ভাই উজ্জল হোসেন জানান, সেদিন তিনিও আন্দোলনে গিয়েছিলেন। দুই দফা টিয়ারশেল এবং একবার ককটেলের মুখে পড়ে অসুস্থ হওয়ার পর বাসায় চলে যান তিনি। পরবর্তীতে আবারও আন্দোলনে যোগ দিতে সাতমাথার উদ্দেশ্যে বের হতেই তাকে মোবাইল ফোনে জানানো হয় তার ভাইকে কুপিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি জানান, পুলিশ যখন সাতমাথা থেকে টিয়ারশেল ছুড়ে তখন কিছু শিক্ষার্থী সেন্ট্রাল মসজিদের দিকে যায়। রেজা ভাই ডাকবাংলোর ভেতরে যান। সেখানে বিগত সরকার দলীয় লোকজন ছিলো। যারা প্রথমেই তাকে রড দিয়ে পেছন থেকে আঘাত করে। এরপর তার পেটে ছুরিকাঘাত করে এবং পেছন থেকে চাইনিজ কুড়াল এবং চাপাতি দিয়ে বেশ কিছু আঘাত করে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।
তিনি আরও জানান, হত্যাকা-ের শিকার হওয়ার আগে তিনি (নিহত রেজা) হত্যাকারীদের বলছিলেন তিনি শিক্ষক। তাকে পাল্টা প্রশ্ন করা হয় আপনি শিক্ষক হলে এখানে কেন আসছেন। আমরা পারিবারিকভাবে এর আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা চাই এই হত্যাকা-ের সাথে জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তি হোক।