রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩২ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
আমার কথা বলে চাঁদা-সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করলে পুলিশে দিন : আসিফ নজরুল তিস্তার পানি দ্রুত বাড়ছে আজ আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন মাহমুদুর রহমান ঢাকার খাল দিয়ে ব্লু নেটওয়ার্ক তৈরির পরিকল্পনা করছে সরকার : পানিসম্পদ উপদেষ্টা শিক্ষাব্যবস্থায় হিন্দুত্ববাদ ও নাস্তিক্যবাদ বরদাস্ত করা হবে না : মামুনুল হক নৌকা থাকায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন হতে পারে : উপদেষ্টা আদর্শিক ভিন্নতা থাকলেও সবাই একসঙ্গে জাতি গঠনে কাজ করবে: মঞ্জুরুল ইসলাম জাতিসংঘে ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা মাহমুদ আব্বাসের মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ভাষাসৈনিক অধ্যাপক আব্দুল গফুরের দাফন ছাত্র-জনতার অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয় স্বৈরাচার থেকে আমাদের মুক্তি দিয়েছে

মুসলিম সভ্যতায় জাহাজবিদ্যা

ইসলাম ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আরব উপদ্বীপের মক্কা নগরীতে ইসলামের আগমন ঘটে। যে নগর ও সমাজের বেশির ভাগ মানুষ ছিল নিরক্ষর। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে যাদের দূরতম কোনো সম্পর্কও ছিল না। কিন্তু বিস্ময়কর বিষয় হলো ইসলামের প্রথম প্রত্যাদেশ ছিল ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে’, যা সমকালীন অনেক ব্যক্তিকেই অবাক করেছিল। মাত্র এক শতাব্দী কাল না যেতেই মানুষের এই ঘোর কেটে যায়। কেননা মুসলিম সমাজে ‘পড়ো’ প্রত্যাদেশের প্রতিফলন ছিল বিস্ময়কর। মুসলিম সমাজে শুরু বহুমুখী জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা। একসময়ের নিরক্ষর আরবরা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। আধুনিক বিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি শাখায় মুসলমানদের মৌলিক অবদান আছে। আধুনিক নৌবিদ্যা তার ব্যতিক্রম নয়।
সুপ্রাচীন কাল থেকে আরব উপদ্বীপের উপকূলীয় অ লে নৌবিদ্যার চর্চা ছিল। আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল। ইসলাম আগমনের পর সেই যোগাযোগকে বৈশ্বিক যোগাযোগে উন্নীত করে। মুসলিমরা নৌবাণিজ্যকে লোহিত সাগর, পারস্য উপসাগর, ভারত মহাসাগর হয়ে ইন্দোনেশিয়ার মালাক্কা প্রণালি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। মূলত খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর পর থেকে মুসলিম শাসনাধীন অ ল দ্রুত বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে এসব অ লের বাণিজ্য ও নগরসভ্যতা দ্রুত বাড়তে থাকে। আর তা পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে।
এটা ছিল এশিয়া-আফ্রিকা থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত।
মুসলিম ভূখ-গুলোর পারস্পরিক যোগাযোগ, বৈশ্বিক বাণিজ্য ও নেতৃত্বের তাগিদেই খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে প দশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলমানরা নৌবিদ্যার উন্নয়নে মনোযোগী হয়। তারা নৌবিদ্যার অধীনে জাহাজ নির্মাণ, পাল তোলার কৌশল, সমুদ্র ভ্রমণে সুষ্ঠু পরিকল্পনা, গন্তব্যে পৌঁছা, দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার কৌশল রপ্ত করা ইত্যাদি বিষয়ের উন্নয়ন ঘটায়।
নৌবিদ্যার উন্নয়নে মুসলিম ভূগোলবিদ, নাবিক ও গবেষকদের আনুষঙ্গিক নানা জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজন হয়। প্রথমত, এমন ভূমির সন্ধান পাওয়া যেখানে নৌযানে করে পৌঁছানো সম্ভব। দ্বিতীয়ত, সেখানকার অধিবাসী, জলবায়ু ও প্রাণিজগৎ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। তৃতীয়ত, সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানব উৎপন্ন পণ্যের উপযোগিতা সম্পর্কে জানা, যেন নৌ অভিযানটি বাণিজ্যিকভাবেও লাভজনক হয় এবং পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা সম্ভব হয়। চতুর্থত, সে এলাকার ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। যেমন—পর্বতমালা, উপকূলীয় অ ল, পোতাশ্রয়, শহর-নগর, স্থানীয়দের ভাষা ও সংস্কৃতি।
ভৌগোলিক জরিপের ক্ষেত্রে মুসলিম বিজ্ঞানীরা ইসলাম-পূর্ব যুগের আরব লেখককের রচনা থেকেও সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন। প্রাথমিক যুগে মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে ইয়াকুত, আল মাসুদি প্রমুখ ব্যক্তিরা নিজস্ব গবেষণা ও বিশ্লেষণও তুলে ধরে ছিলেন। মুসলিম নাবিক ও পর্যকটরাও স্থানগুলোর অবস্থান আবিষ্কার ও চিহ্নিতকরণে নানামুখী চেষ্টা করেছিলেন।
নৌবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সঠিক পথ ধরে পৃথিবীর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া এবং নির্ভুলভাবে জাহাজের অবস্থান নির্ণয় করা। মুসলিম বিজ্ঞানীরা নক্ষত্র ও সূর্যের অবস্থান বিশ্লেষণ করে সমুদ্র পথ ও জাহাজের অবস্থান নির্ণয়ের আধুনিক কৌশল রপ্ত করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা গ্রিক ও অন্যান্য প্রাচীন জাতিগোষ্ঠীর গবেষণা থেকেও উপকৃত হয়েছিলেন। তাঁরা আকাশের নক্ষত্র, স্রোতের গতিশীলতা ও ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের মিলিয়ে নির্ভুলভাবে অক্ষাংশ নির্ণয় করতে পারতেন।
মুসলিম বিজ্ঞানীরা অত্যাধুনিক অ্যাস্ট্রোল্যাব আবিষ্কার করেছিলেন। আর সেটা সম্ভব হয়েছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিত শাস্ত্রের সমন্বয়ের মাধ্যমে। চুম্বকীয় কম্পাসের আবিষ্কার চীনে হলেও তার উন্নয়ন ও ব্যাপক প্রসারের ক্ষেত্রে মুসলমানদের ভূমিকা ছিল। মুসলমানদের মাধ্যমেই ইউরোপে অ্যাস্ট্রোল্যাবের বিস্তার ঘটেছিল। এটা সমুদ্রবিদ্যার পাশাপাশি ভূমি জরিপ, দূরবর্তী কোনো জিনিসের উচ্চতা বা গভীরতা নিরূপণের কাজে ব্যবহৃত হতো।
নৌবিদ্যার উন্নয়নে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্থানাঙ্ক ব্যবহার করে কোনো স্থানের মানচিত্র অঙ্কন ও তথ্যবিবরণী লিপিবদ্ধ করা। মুসলিম বিজ্ঞানীরা গাণিতিক ভূগোলবিদ্যার উন্নয়নের মাধ্যমে তুলনামূলক নির্ভুল মানচিত্র অঙ্কনে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁদের এই সাফল্যের পেছনে ধর্মীয় অনুপ্রেরণাও বিদ্যমান ছিল। কেননা মসজিদ নির্মাণ ও নামাজ আদায়ের জন্য মুসলমানদের সময় ও কিবলা নির্ণয়ের প্রয়োজন হয়। এটা মুসলিম সমাজকে নির্ভুলভাবে দিক নির্ণয়ের বিদ্যা অর্জনে উৎসাহিত করে। মধ্যযুগে প্রায় সব বড় মুসলিম শহরে স্থানাঙ্কের মাধ্যমে কিবলার দিক চিহ্নিত করে রাখা হতো।
নাবিকদের জন্য পোর্টলেন (সামুদ্রিক অ লবিষয়ক) বিদ্যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে বিভিন্ন সামুদ্রিক অ ল, তার গভীরতা ও বৈশিষ্ট্য, নৌপথ, উপকূল ইত্যাদির বিবরণ তুলে ধরা হয়। নাবিকরা সামুদ্রিক অভিযান পরিচালনার আগে এটা রপ্ত করে থাকেন। মুসলিম নাবিকরা তাঁদের সংগৃহীত তথ্য ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এমন অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেগুলো রাহমানি নটিক্যাল ম্যানুয়ালস নামে পরিচিত।
সুলাইমান বিন আহমদ আল মাহরি তাঁদের অন্যতম। তিনি খ্রিস্টীয় দশম শতকের একজন মুসলিম নাবিক। তিনি লিখেছেন, সানদিব ও ফারানদিব থেকে সাথি জামের দিকে যাত্রা হবে ইএসই (ইস্ট-সাউথ-ইস্ট বা পূর্ব-দক্ষিণ-পূর্ব)। সাথি জাম থেকে জানজিলিয়া দ্বীপ দক্ষিণে। জানজিলিয়া থেকে নাজিরাশির পথ হবে এসএসই। নাজিরাশি থেকে মারতাবানের পথ হবে ইএসই।…মালাক্কা থেকে সিঙ্গাপুর হলো সিয়াম থেকে দক্ষিণের শেষ বিন্দু।
অপর একজন মুসলিম নাবিক ছিলেন আহমদ বিন মাজিদ। তিনি ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে নৌযাত্রার নিয়ম-নীতি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বই লেখেন। কারো কারো মতে, এই বই ভাস্ক দা গামাকে পূর্ব আফ্রিকা থেকে ভারত গমনে উৎসাহিত করেছিল।
জাহাজের নকশা ও পাল নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি নৌবিদ্যার আরেকটি গুরুত্ব অংশ। যার মধ্যে ছিল জাহাজের কাঠামো, মাস্তুল, পাল নিয়ন্ত্রণ, স্টিয়ারিং (গতিপথ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র) ইত্যাদি। মুসলিম নাবিক ও গবেষকরা এ ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রাখেন। এ ক্ষেত্রে মুসলিম নাবিকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ছিল কবজাযুক্ত হাল, যা এখনো ব্যবহৃত হয়। মুসলিমরা গোলার্ধিক নৌপথের জন্য বিশেষ নকশার নৌকা নির্মাণ করেন। এটা কিছুটা আরবি ‘দাল’ বর্ণের মতো ছিল। যাকে কার্ভেল বিল্ট হুল বলা হতো। মোটকথা, নৌবিদ্যার সূচনা সুপ্রাচীন কাল থেকে হলেও এবং এর উন্নয়নে বহুজাতিক অবদান থাকলেও এ ক্ষেত্রে মুসলিম অবদান অবশ্যই উল্লেখযোগ্য ও স্মরণীয়। -ইসলামিক স্পেন ডটটিভি অবলম্বনে




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com