দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের জন্য ‘টকিং গ্লাস’ আবিষ্কার করেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের স্নাতকোত্তর তিন শিক্ষার্থী ও দু’জন শিক্ষক। নতুন এই উদ্ভাবনের অনুরূপ কোনো ডিভাইস বা প্রযুক্তি, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি বলে দাবি করেছেন তারা। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারে আইসিটি বিভাগের এটুআই’র ডিজেবিলিটি চ্যালেঞ্জ ফান্ডে ২০১৮ সালে এই প্রকল্পটি গৃহীত হয়। এরপর টানা দুই বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এই প্রযুক্তির কার্যকারী ব্যবহারে সফল হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক টিম।
টকিং গ্লাসের গবেষক টিমের সুপারভাইজার কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাহাত হোসাইন ফয়সাল বলেন, “দু’জন শিক্ষক ও তিনজন ছাত্র মিলে মোট পাঁচজনের একটি টিম ‘টকিং গ্লাস’ নামে এটুআইতে আবেদন করেছিলাম। এরপর এটুআই থেকে ফান্ড পাওয়ার পরে দীর্ঘ দিন কাজ করে এখন আমরা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছি। ‘টকিং গ্লাস’ ছয়টি ফিচার নিয়ে কাজ করছে। এখন এটাকে আরো ব্যবহার উপযোগী করার চেষ্টা চলছে।”
তিনি বলেন, ‘বায়োলজিক্যাল চক্ষু দেয়া সম্ভব নয়, কিন্তু অন্ধ ব্যক্তি এই চশমা পরে যেকোনো কিছু পড়তে পারবে। অন্ধ ওই ব্যক্তির অবস্থানের লোকেশন ও দিক-নির্ধারণ করে দেবে চশমাটি। এ ছাড়া রাস্তার হাঁটার সময় সামনে কিছু থাকলে দূরত্বসহ বলে দেবে, ব্যক্তির পরিচয় ও টাকার নোটের মান বলে দেবে। প্রাথমিকভাবে ছয়টি ইস্যু আমরা সংযুক্ত করেছি, যেটা এটুআই’র সাথে কথা ছিল। তবে, অন্ধদের আরো যত ধরনের চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে পর্যায়ক্রমে তার সমস্যাগুলোই এটাতে যুক্ত করার চিন্তাভাবনা ও চেষ্টা রয়েছে আমাদের।’
তিনি বলেন, ‘ক্যামেরাসহ বিভিন্ন ধরনের সেন্সর রাখা হয়েছে এই চশমার মধ্যে। এটা সাধারণ চশমার মতোই দেখতে মনে হবে। বিভিন্ন ধরনের প্রসেসিং উপাদান থাকবে। আর্টিফিশিয়াল থিংকিং ইন্টেলিজেন্স অ্যাপ্লাই করেছি আমরা। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে একজন অন্ধ যেন সাধারণ মানুষের মতো সবকাজ করতে পারেন। আমরা চশমাটি স্থানীয় ব্লাইন্ড স্কুলের শিক্ষকসহ আরো কিছু লোক দিয়ে টেস্ট করেছি, তারাও এটা নিয়ে আশাবাদী। এখন অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমে স্থানীয় প্রোডাক্টগুলো আমরা এখানে সংযুক্ত করেছি। তবে, প্লাস্টিক, কাচের ফ্রেম ও ফিনিশিং প্রোডাকশনে যেতে হলে বড় কোনো কোম্পানির সাথে আলোচনা করতে হবে।’
জানা গেছে, ‘টকিং গ্লাস’ অন্ধ মানুষের জন্য একটি লাইভ শোনার যন্ত্র যা অন্ধ ব্যক্তির সামনের সব ধরনের লেখা পড়তে পারে। যেকোনো বস্তু শনাক্ত করতে পারে। উদ্ভাবকরা এই ডিভাইসটিকে ‘টকিং গ্লাস’ নামকরণ করেছেন। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এই ‘টকিং গ্লাসে’। ব্যবহারকারীরা এটা গগলস বা চশমা হিসেবে ব্যবহার করবেন। চোখের সামনে লেখার ওপর দৃষ্টি নির্ধারণ করতে চশমায় সংযুক্ত থাকবে ক্যামেরা। ডিভাইসটি একটি স্থির চিত্র নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে চিত্রের লেখা ব্যবহারকারীকে পড়ে শোনাবে। একজন স্বাভাবিক মানুষ যেভাবে বই পড়তে পারেন ঠিক একইভাবে উপযুক্ত গতিতে শুনতেও পারবেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যবহারকারী। ভয়েস কমেন্টের মাধ্যমে ছবি সংক্রান্ত যেকোনো তথ্য সেভ করে রাখা যাবে। এই চশমা ব্যবহারকারীর সামনে কোনো ব্যক্তি বা বস্তু থাকলে নামসহ শনাক্ত করতে পারবেন। তাৎক্ষণিকভাবে তা জানিয়ে দেবে ব্যবহারকারীকে।
প্রাথমিকভাবে ‘টকিং গ্লা‘টিতে মোট ছয়টি ফিচার যুক্ত করা হয়েছে। ফিচার ছয়টি হলো, অপটিক্যাল ক্যারেক্টার রিকগনিশন(ওসিআর), ফেস রিকগনিশন, অবজেক্ট ডিটেকশন, অবজেক্ট রিকগনিশন, কারেন্সি রিকগনিশন, ডিরেকশন ডিটেকশন, লোকেশন আইডেন্টিফিকেশন। এটি মানুষের চেহারা চিহ্নিতকরণ, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণসহ বিভিন্ন দিক নির্ণয়, কোনো বস্তু দেখলে তার নামসহ চিহ্নিতকরণ, বাংলা ও ইংরেজি বইপড়া থেকে শুরু করে কোনটা কত টাকার নোট তাও নির্ণয় করতে পারবে।
‘টকিং গ্লাস’ উদ্ভাবক টিমে ছিলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাহাত হোসাইন ফয়সাল, সহকারী অধ্যাপক মো: মোস্তাফিজুর রহমান, এ বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী সোহেল মাহমুদ, রিপন চন্দ্র দাস ও ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী বিপুল ম-ল।
এ টিমের সুপারভাইজার ছিলেন সহকারী অধ্যাপক রাহাত হোসাইন ফয়সাল ও কো-সুপারভাইজার সহকারী অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান রাজু।
‘টকিং গ্লাসের’ উদ্ভাবক কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের ইচ্ছা এই ডিভাইসে আরো সুন্দর কিছু ফিচার যুক্ত করে খুব শিগগিরই প্রত্যেক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের কাছে পৌঁছে দেব। ডিভাইসটি একজন ব্লাইন্ডের হেল্পার হিসেবে কাজ করবে। যখন একজন অন্ধ ব্যক্তির কাছে কোনো মানুষ থাকবে না তখনো ওই ব্যক্তি নিজেকে স্বাবলম্বী ভাবতে পারবে। তিনি নিজ থেকে পথ তৈরি করতে পারবেন অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমে যাবে। শুধু যে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষ ব্যবহার করবে তা নয়, বরং একজন স্বাভাবিক মানুষও ব্যবহার করতে পারবে, তার একাকিত্বের সময় তিনি গান শুনতে পারবেন, অন্য ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন। এর ইন্টারনাল কার্যক্রম হলো এই ডিভাইস থেকে একটা পিকচার নিয়ে ওই পিকচারটি প্রসেস করে অডিও হিসেবে ইউজারকে শুনিয়ে দেবে।’