করোনার নিশ্চলতা কাটিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে দেশের সিমেন্ট উৎপাদন খাত। এর ফলে উৎপাদনও বেড়েছে। তবে উৎপাদন বাড়লেও চাহিদা বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে দেশের বাজারে এখন নির্মাণপণ্যটির দামও বাড়তির দিকে। কোম্পানিভেদে স্বাভাবিক সময়ে সিমেন্টের দাম থাকে ৪০০-৪২০ টাকা। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৪৫০-৪৭০ টাকায়। বাজারে এখন প্রতি বস্তা সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৪০-৫০ টাকা বেশিতে।
করোনা মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে দেশের নির্মাণ খাত। কর্মযজ্ঞ বেড়েছে আবাসন খাতে। গতি পেয়েছে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোও। অবকাঠামো খাতের সুদিন ফিরতে শুরু করলেও সংশ্লিষ্টদের ‘মাথাব্যথার’ কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সিমেন্ট সংকট। এরই মধ্যে পণ্যটির দামও বাড়তে শুরু করেছে।
সিমেন্টের মূল্যবৃদ্ধি ও সরবরাহ সংকটের জন্য একাধিক কারণের কথা বলছেন পণ্যটির উৎপাদনকারীরা। তারা বলছেন, বিশ্ববাজারে সিমেন্ট তৈরির প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকারের দাম অনেক বেড়েছে। ক্লিংকার বানানোর জন্য যে কয়লা প্রয়োজন হয়, দাম বেড়েছে সেটিরও। পাশাপাশি ক্লিংকারের পরিবহন খরচও বেড়েছে। যেখানে আগে একটি জাহাজের দিনপ্রতি ভাড়া ৮-১০ হাজার ডলারের মধ্যে ছিল, তা বেড়ে বর্তমানে ৩৫-৩৬ হাজার হয়েছে। এসব কারণে একদিকে সিমেন্টের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে সরবরাহ সংকটও দেখা দিয়েছে। আবার দেশে সিমেন্টের চাহিদাও এখন বাড়তির দিকে। এ বাড়তি চাহিদার কারণেই সংকট আরো ঘনীভূত হয়ে উঠেছে।
এ বিষয়ে প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে সিমেন্ট উৎপাদন ২০ শতাংশ বেড়েছে। উৎপাদন বেশি হওয়া সত্ত্বেও সংকট তৈরি হওয়ার প্রধান কারণ আসলে চাহিদা বেড়ে যাওয়া। কভিডের কারণে দীর্ঘ সময় দেশ-বিদেশের নির্মাণ খাত স্থবির ছিল। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসায় খাতটির স্থবিরতা কমেছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া কাজগুলো আবার শুরু হয়েছে। পাশাপাশি নতুন নতুন কাজ শুরু হচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশে সিমেন্টের চাহিদা এখন অনেক বেশি। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে সিমেন্টের বিভিন্ন কাঁচামালের দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত। পরিবহন খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। মূলত এসব কারণেই সিমেন্টের দাম বেড়েছে।
দীর্ঘদিন ধরেই মারাত্মক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সিমেন্ট উৎপাদন খাত। এর মধ্যে আবার চলমান কভিড-১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাবে শুরুতেই বড় ধরনের ধাক্কা খায় খাতটি। এ নিয়ে গত বছরের মাঝামাঝি বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) পক্ষ থেকে এনবি আরের কাছে একটি চিঠি দেয়া হয়। এতে উল্লেখ করা হয়েছিল, সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর ব্যবসা করার ক্ষমতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতেই নভেল করোনাভাইরাস সিমেন্ট শিল্পে বড় ধরনের আঘাত হেনেছে। মহামারীর শুরুর দিকে গত বছরের এপ্রিলেই দেশে সিমেন্ট বিক্রির পরিমাণ নেমে আসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৬ শতাংশ কমে।
সিমেন্ট উৎপাদনকারীরা বলছেন, মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর দেশে নির্মাণকাজ ছিল না বললেই চলে। এখন এর গতি অনেক বেড়েছে। অন্যদিকে ক্লিংকার তৈরিতে অপরিহার্য পণ্য কয়লার দামও এখন বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। করোনার কারণে দীর্ঘদিন বিশ্বের প্রায় সব দেশের অবকাঠামো প্রকল্পের কাজ অসম্পূর্ণ ছিল। ওই দেশগুলোয় টিকা গ্রহণ শুরুর পর বর্তমানে মানুষের আত্মবিশ্বাস ও সাহস ফিরে আসছে। এ প্রেক্ষাপটে এখন গোটা বিশ্বে খুব দ্রুততার সঙ্গে অসম্পূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ শুরু হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে সিমেন্টের চাহিদায়।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে দেশের অন্যতম সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মেট্রোসেম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিসিএমএর প্রথম সহসভাপতি মো. শহিদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশে অবকাঠামো ও নির্মাণ খাতের কাজগুলোর গতি ছিল না বলে তেমন অগ্রসর ছিল না। এখন চলমান কভিড পরিস্থিতির মধ্যেই মানুষ কাজগুলো এগিয়ে নিতে শুরু করেছে। আবার কভিড প্রেক্ষাপটেই মানুষ এখন সঞ্চয় কাজে লাগিয়ে আবাসন নির্মাণপ্রবণও হয়েছে। কভিডকালে বিনিয়োগমুখী ভাবনার ধারণ ও বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে মানুষের মধ্যে। দেশে স্বাভাবিক সময়ে প্রতি মাসে ৩৫-৩৬ লাখ টন সিমেন্ট ব্যবহার হয়। গত মাসে ব্যবহার হয়েছে ৩৮ লাখ টন। চলতি মার্চেও ৪০ লাখ টন সিমেন্টের চাহিদার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। একদিকে চাহিদা বেড়েছে ব্যাপক হারে, অন্যদিকে কাঁচামাল সরবরাহ খুবই কম। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকারের তীব্র সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে। অব্যাহত দর বৃদ্ধি তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে উৎপাদনকারীদের আরো কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। এ কারণে বর্তমানে চাহিদা বাড়লেও সিমেন্টের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদনকারীদের ক্ষতিই দেখতে পাচ্ছে বিসিএমএ। সংগঠনটি মনে করছে, অব্যাহত দর বৃদ্ধি সিমেন্ট নির্মাতাদের অনেক বড় অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিয়েছে। গতকালও গণমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে সংগঠনটি।
এতে বলা হয়েছে, একদিকে এক বছর ধরে নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারীর প্রভাব, অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে সিমেন্টের মূল কাঁচামাল ক্লিংকারের অস্বাভাবিক ও অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধিতে দেশের সিমেন্ট খাতে নেমে এসেছে চরম দুর্দিন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের সিমেন্ট খাতের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা এখন আর অনুমান করা যাচ্ছে না।
এ অবস্থায় সিমেন্ট উৎপাদনে ব্যবহূত মৌলিক কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানিতে নির্ধারিত শুল্ক প্রতি টন ৫০০ টাকার পরিবর্তে ৫ শতাংশ হারে নির্ধারণ করার আহ্বান জানিয়েছে বিসিএমএ। সিমেন্টের অব্যাহত দর বৃদ্ধি চিন্তায় ফেলে দিয়েছে ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদারদেরও। বাড়তি দাম দিয়েও চাহিদা অনুযায়ী সিমেন্ট পাচ্ছেন না তারা। ঠিকাদার ও নির্মাতারা বলছেন, সিমেন্ট সংকটের কারণে চলমান প্রকল্পগুলোর কাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এতে আর্থিক লোকসানের পাশাপাশি প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নকালও পিছিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা তাদের।
দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডিয়েনকো লিমিটেড। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, বাংলাদেশ রেলওয়ে, রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে সড়ক ও জনপথ অধিপ্তরের ঢাকা-টাঙ্গাইল চার লেন, ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক উন্নয়ন, ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ ব্রিজ ইমপ্রুভমেন্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ডিয়েনকো। তবে সিমেন্ট সংকটের কারণে প্রকল্পগুলোর কাজ এগিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
জানতে চাইলে ডিয়েনকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম খোরশেদ আলম বলেন, চলমান প্রকল্পগুলোর কাজ সচল রাখতে আমাদের প্রতিদিন অন্তত ২-৩ লরি সিমেন্ট দরকার হয়। তবে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে বর্তমানে ২-৩ দিন পর পর মাত্র এক লরি সিমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় সিমেন্টের অভাবে আমরা প্রকল্পগুলোর কাজ এগিয়ে নিতে পারছি না। এরই মধ্যে সিমেন্ট সংকটের বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আমাদের প্রকল্পগুলোতে। একই ধরনের কথা বলেছেন আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিনও। তিনি বলেন, সংকটের কারণে সিমেন্টের দাম এরই মধ্যে ব্যাগপ্রতি ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছে। সিমেন্টের এ সংকট দেশের আবাসন খাতকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।