ক্রমেই চড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম। রোজার আগে একের পর এক পণ্যের দাম বাড়ছে। বাড়ছে মাছ-মুরগি ও সবজির দামও। আলু-পেঁয়াজের দাম সেই যে বেড়েছে আর কমার কোনো আশা নেই। পাস্তুরিত দুধের দাম ইতোমধ্যে লিটারে ১০ টাকা বেড়েছে। রোজায় এসব পণ্যের দাম কততে গিয়ে দাঁড়ায় তাই নিয়ে সবাই এখন থেকেই চরম দুশ্চিন্তায়। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মুরগির গোশতের দাম বেড়েছে। ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকায়। লাল লেয়ার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকায়। আর পাকিস্তানি কক মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৭০ টাকায়। ব্রয়লার মুরগি বৃহস্পতিবারের চেয়ে কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা। আর অন্যান্য মুরগির গোশত কেজিতে ২৫-৩০ টাকা বেড়েছে এক দিনের ব্যবধানে। পেঁয়াজ ও আলুর দাম সেই আগের মতোই আছে। পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪৫ টাকায়। আর আলু বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়। মানিকনগরের ব্যবসায়ী আবু বকর বলেন, পেঁয়াজের দাম কেজিতে ফাঁচ টাকা কমেছে; কিন্তু আলুর দাম সেই আগের মতোই আছে।
সবজির দাম এখন বেশ চড়া। গত সপ্তাহ থেকেই সবজির মূল্য বেশি। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি করলা ৬০ টাকা, ঢেঁড়স ৬০ থেকে ৭০ টাকা, বরবটি ৭০ থেকে ৮০ টাকা, শিম ৫০-৬০ টাকা, পটোল ৬০ টাকা, লতি ৭০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০ টাকা, সজনে ২০০ থেকে ২২০ টাকা, গাজর ২০-৩০ টাকা, বেগুন ৪০-৪৫ টাকা, টমেটো ২০-২৫ টাকা, প্রতি পিস লাউ আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৩০-৫০ টাকায়, বাঁধাকপি প্রতি পিস ২০ টাকা, ফুলকপি প্রতি পিস ২০ টাকা, মিষ্টি কুমড়ার কেজি ৩০ টাকা, কাঁচামরিচ ৬০ টাকা, পেঁপে প্রতি কেজি ৩০ টাকা, খিরাই ৪০ টাকা, শসা ৫০ টাকা, মটরশুঁটি ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লেবুর হালি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৫০ টাকায়। ইন্ডিয়ান ও চায়না রসুন প্রতি কেজি ১২০ টাকা, দেশী রসুন ৭০-৮০ টাকা, দেশী আদা ৬৫-৭০ টাকা এবং চায়না আদা ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় কেজি পাওয়া যাচ্ছে।
চালের বাজার আগের মতোই আছে। সেই যে বেড়েছে দাম আর কমেনি। প্রতি কেজি বি আর-২৮ চাল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকায়, মিনিকেট ৬৫ টাকায়, নাজির ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়, স্বর্ণা চাল ৪৮ টাকায়, পোলাওয়ের খোলা চাল ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্যাকেট ১০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
ডিমের দাম এখনো কমই আছে। এক ডজন লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়। কোনো কোনো ডিম ১৪টি মিলছে এক শ’ টাকায়। হাঁসের ডিমের ডজন ১৫০ টাকা। দেশী মুরগির ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে গরুর গোশত। আর খাসির গোশত মিলছে ৮৫০ টাকায়। বকরির গোশত পাওয়া যায় ৭০০-৭৫০ টাকায়। মাছের দাম বাজার ভেদে এবং মাছের মান ভেদে কমবেশিতে বিক্রি হচ্ছে। তবে গড়ে মাছের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে একাধিক ক্রেতা জানান। নুরে আলম নামের এক ক্রেতা বলেন, এখন ছোট সাইজের নদীর চিংড়ি কিনতে হচ্ছে ১০০০-১১০০ টাকা কেজি। তিনি বলেন, অন্যান্য দেশী মাছের দামও গত সপ্তাহের তুলনায় কেজিতে গড়ে ৫০ টাকা বেড়েছে। শুধু চাষের মাছই এখন নিম্ন আয়ের মানুষের একমাত্র ভরসা বলে নুরে আলম বলেন।
গতকাল বুধবার শেয়ার বিজ অন লাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে,পরিকল্পিতভাবে বাড়ানো হচ্ছে চাল ডাল তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে,আর মাত্র ১৫ দিন পরেই রমজান। এরই মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কয়েক দফা বেড়ে গেছে। বাজারে পণ্যের ঘাটতি নেই। তবুও একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট পণ্য মজুত করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। করোনার কারণে মানুষের আয় কমে গেছে। পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের কষ্ট আরও বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট পরিকল্পিতভাবে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বিশেষ প্রতিবেদন দিয়েছে।
সম্প্রতি এ প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়, যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এরই মধ্যে অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে উল্লেখ করে বলা হয়, জনগণের মধ্যে এ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে এক ধরনের ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া দুর্বল বাজার মনিটরিং ব্যবস্থাপনা, ঢাকাসহ দেশের স্থানীয় বাজারগুলোয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর প্রয়োজনীয় তদারকি কার্যক্রমের অভাবে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মজুত, সরবরাহ ও বাজারমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এ প্রতিবেদনের কপি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবি আর) চেয়ারম্যানকে দিয়েছে।
গোপনীয় এ প্রতিবেদনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির জন্য ১২টি কারণ তুলে ধরা হয়, যাতে বলা হয়, দুর্বল বাজার মনিটরিং ব্যবস্থাপনা এবং ঢাকা মহানগরসহ দেশের স্থানীয় বাজারে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর প্রয়োজনীয় ও যথাযথ তদারকি নেই। ফলে চাল, ভোজ্যতেল, ছোলা, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। রমজানকে সামনে রেখে অসাধু চক্র এবং সরকারবিরোধী গোষ্ঠীর দুরভিসন্ধিমূলক প্রয়োসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করে জনগণের কাছে সরকারকে ব্যর্থ হিসেবে প্রমাণ করার অপচেষ্টা করা হতে পারে।
আরও বলা হয়, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে প্রতিটি পণ্যের ক্রয়মূল্য ও বিক্রয়মূল্য তালিকা দৃশ্যমান স্থানে ঝুলিয়ে রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এ সুযোগ ব্যবহার করে আড়তদার এবং পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য পরিকল্পিতভাবে বৃদ্ধি করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম এরই মধ্যে অনেকাংশে বেড়ে গেছে। ফলে জনগণের মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে এক ধরনের ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বাজার নিয়ন্ত্রণে ১৪টি সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে-রমজানকে সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের প্রকৃত চাহিদা নিরূপণ এবং চাহিদার বিপরীতে তা মজুত করতে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে নির্দেশনা দেয়ার সুপারিশ করা হয়। দ্রব্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি বা অযৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধিকারী ব্যবসায়ী ও মজুতকারীদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে জেলা, উপজেলা প্রশাসন, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা প্রদানের সুপারিশ করা হয়। আরও বলা হয়, অসাধু ব্যবসায়ী চক্র চিহ্নিত এবং এ চক্রের বাজার অস্থিতিশীল করার যেকোনো অপচেষ্টা রোধ করতে কার্যক্রম গ্রহণ করতে প্রয়োজন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে নির্দেশনা প্রদান, ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিক্রিতে ব্যবসায়ীদের উদ্ধুদ্ধকরণ, জেলা পর্যায়ে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নেতৃত্বে নিয়মিত বাজার তদারকি ও পর্যবেক্ষণ এবং ব্যবস্থা নিতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা। ভোক্তা অধিকার ও উৎপাদনকারীর ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তির অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রয়োজন দেশের সকল বাজারে দেশে উৎপাদিত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে উৎপাদনকারী থেকে পাইকারি বিক্রেতা, পাইকারি বিক্রেতা থেকে খুচরা বিক্রেতা এবং খুচরা বিক্রেতা থেকে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতিটি দ্রব্যের মূল্যের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ ধাপ নির্ধারণ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।
একইভাবে আমদানি করা পণ্যের ক্ষেত্রে আমদানিকারকের কাছ থেকে পাইকারি বিক্রেতা, পাইকারি বিক্রেতা থেকে খুচরা বিক্রেতা এবং খুচরা বিক্রেতা থেকে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি দ্রব্যের মূল্যের সর্বনি¤œ ও সর্বোচ্চ ধাপ নির্ধারণ করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। রমজানের আগেই টিসিবিসহ সরকারি-বেসরকারি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রয়োজনীয় আমদানি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষজ্ঞ কমিটির দিক-নির্দেশনায় প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ, সরবরাহ ও বিপণন ব্যবস্থাপনার ওপর সমন্বিত গাইড লাইন তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে হবে। রমজানে অতিরিক্ত চাহিদা ও কিছু পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে দেশে চাল, তেল, পেঁয়াজ ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং এনবি আরের কার্যকর ভূমিকার মাধ্যমে আমদানিকারক, ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ প্রয়োগ, প্রয়োজনে সাময়িক কর ও ভ্যাট হ্রাসসহ প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।