ঔপনিবেশিক সময়ে বৃটিশ ভারতের দরিদ্রতম অংশগুলোর একটি ছিল পূর্ববঙ্গ। ১৯৪৭ সালে বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ ও দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গই পরিণত হয় পাকিস্তানের দরিদ্রতম অংশ বা পূর্ব পাকিস্তানে। আবার ১৯৭১ সালে সেই পূর্ব পাকিস্তানই বাংলাদেশ হিসেবে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। যুদ্ধে আরো দরিদ্র হয় দেশটি। পাকিস্তানিদের হাতে খুন হয় দেশের সেরা ও মেধাবী মানুষজন। এটা বিশ্লেষণ করেছে দ্য ইকোনমিস্ট।
সেই অবস্থা থেকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় পরিবর্তন খুব কম মানুষই অনুমান করতে পেরেছেন। চলতি সপ্তাহে দেশটি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তখন থেকে আজ অবদি দেশটির জনপ্রতি আয় পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে ভারতের কাছাকাছি চলে এসেছে। করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির আগে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার টানা চার বছর ৭ শতাংশের বেশি ছিল, যা পাকিস্তান, ভারত ও চীনের চেয়েও বেশি।
বাংলাদেশিরা বর্তমানে কেবল আগের তুলনায় বেশি ধনীই নন, একইসঙ্গে তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ৯৮ শতাংশ বাংলাদেশি শিশু প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে থাকে। আশির দশকে এমন শিশুর পরিমাণ ছিল মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। বেড়েছে স্বাক্ষরতার হার। কমেছে শিশু মৃত্যুর হার। প্রায় সকলেই উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগের বদলে টয়লেট ব্যবহার করেন। সব দিক থেকেই পাকিস্তান ও ভারতের চেয়ে ভালো করছে বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধ যতটাই বিপর্যয়কারী হোক না কেন, এটা কিছু দিক দিয়ে বাংলাদেশকে সফলতার পথে নিয়ে গেছে। দেশকে উদ্ধারে ফিরে এসেছিলেন অনেক প্রবাসী। বৃটেনের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সস্তায় জেনেরিক ওষুধ ও গর্ভনিরোধক বিলি করতে দাতব্য সংস্থা স্থাপন করেন জাফরুল্লাহ চৌধুরি। লন্ডনে নিজের ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়ে আরেকটি দাতব্য সংস্থাÍব্র্যাকÍ খোলেন ফজলে হাসান আবেদ। সংস্থাটি ডায়রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
দাতব্য সংস্থা ও এনজিওগুলোকে খুশিমনেই এসব কাজ করতে দিয়েছে তৎকালীন সরকার। আশির দশকে শিশুদের পোলিওর মতো রোগের টিকা দেওয়ার কর্মসূচীর অর্ধেক সম্পন্ন করেছিল সরকার ও বাকি অর্ধেকের দায়িত্ব নিয়েছিল ব্র্যাক। ওই দশক শেষ হওয়ার আগে দেশটির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার হার ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮০ শতাংশে পৌঁছায়।
ব্র্যাকের মতো দাতব্য সংস্থাগুলোর বড় প্রভাব ফেলতে পারার পেছনে অন্যতম একটি কারণ ছিল, সংস্থাগুলো নারীদের টার্গেট করেছিল। নব্বইয়ের দশকের দেশে ৬৪ হাজার স্কুল পরিচালনা করছিল ব্র্যাক। এসব স্কুলে মেয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হতো। তাদের শেখাতে নিয়োগ দেওয়া হতো নারীদের। বর্তমানে দেশটির উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ বেশি।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)-এর সভাপতি রুবানা হক বলেন, বাংলাদেশের সমৃদ্ধ পোশাক শিল্প নারীদের উন্নয়নেও ভূমিকা রেখেছে। মজুরিসম্পন্ন কাজে নারীদের অংশগ্রহণ ৫০ বছর আগে ৩ শতাংশ ছিল। এখন তা ৩৬ শতাংশে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের ৪০ লাখ পোশাককর্মীর ৮০ শতাংশই নারী। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বর্তমানে পুরো বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। দেশের জিডিপির ১১ শতাংশ এবং রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশই আসে এই খাত থেকে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন যেমন অনুপ্রেরণাদায়ী, এর রাজনীতি ততটাই হতাশাজনক। দেশটিকে একদলীয় রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা করেছিলেন শেখ মুজিব। কিন্তু খুন হন তিনি। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী ও তার কন্যা শেখ হাসিনা, আপাতদৃষ্টিতে পিতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলেই মনে হয়। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের বিধান বাতিল করে দেন তিনি। তৎকালীন প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়াকে ২০১৫ সালে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার দাবি, তার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অভিযোগ তোলে, তাদের ৭ হাজারের বেশি কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার মতো অনেককে দোষী সাব্যস্ত আসামী হওয়ার কারণে নির্বাচনে লড়তে দেওয়া হয়নি। ওই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতেই জয়ী হয় আওয়ামী লীগ।
কেবল বিরোধীদলীয় কর্মী নয়, সাংবাদিক ও সরকারের সমালোচকদেরও জেলে পাঠানো হচ্ছে। ধর্মীয় উগ্রবাদ ও অনলাইনে পর্নোগ্রাফি ঠেকানোর উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে সরকার। কিন্তু এর অস্পষ্ট ধারাগুলোর আওতায় সরকারের বিরুদ্ধে আগ্রাসী বা ভীতিমূলক পোস্টদাতাদের জন্য কঠোর কারাদ-ের বিধান রয়েছে। সব ধরণের সমালোচকদের বিরুদ্ধে এসব ধারার প্রয়োগ ঘটছে। করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের প্রতিক্রিয়া নিয়ে ফেসবুকে এক পোস্ট দেওয়ায় গত বছর গ্রেপ্তার করা হয় লেখক মোশতাক আহমেদকে। গত মাসে কারাগারে থাকাকালেই মৃত্যু হয় তার। এর আগে ছয় বার তাকে জামিন দিতে অস্বীকৃতি জানান আদালত।
অপরদিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গুরুতর অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়ার পরও সহজেই জামিন পেয়ে যাচ্ছেন। সরকারি চুক্তিগুলো প্রায়ই দলীয় নেতাদের ঘনিষ্ঠরা পেয়ে থাকেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণের বোঝায় নুয়ে পড়েছে। দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে যাদের, তারা ঋণ পরিশোধ করছেন না। আদালতেও গিয়েও লাভ নেই: সেখানে সবসময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা ব্যক্তিরাই জয়ী হন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদিন মালিক বলেন, এখন আর চুক্তির শর্ত লঙ্ঘনের মামলা দায়েরই হয় না। দেশের শুল্ক নীতিমালাও ধনী ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের জন্য সুবিধাজনক।
এই পদ্ধতিগুলো কতটা অন্যায্য, তা অর্থনৈতিক উপাত্তে ফুটে উঠছে। ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে সবচেয় ধনী পরিবারগুলোর আয় বেড়েছে প্রায় এক-চতুর্থাংশ। অন্যদিকে, এ সময়ের মধ্যে দরিদ্র পরিবারগুলোর আয় কমেছে এক-তৃতীয়াংশ। এজন্য ব্যবসায়ী এলিটদের ‘রেন্ট-সিকিং’-কে দায়ী করা হচ্ছে। অর্থনীতিতে রেন্ট-সিকিং ধারণার মাধ্যমে বোঝানো হয় যে, সমাজের কোনো সুবিধা বা সম্পদ সৃষ্টি না করেই কোনো ব্যক্তির নিজস্ব অর্থ-সম্পদ বৃদ্ধির চেষ্টা। এতে ব্যক্তি অর্থনৈতিক সম্পদের বণ্টনে কারসাজি করে অর্থনৈতিক অর্জন ও সুবিধা বাড়িয়ে থাকেন। কিন্তু সমাজের কোনো লাভ হয় না। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধি দুই শতাংশ কম হয়ে থাকে। দেশে কমছে বৈদেশিক বিনিয়োগও।
করোনা ভাইরাস মহামারীতে ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। দরিদ্রসীমার নিচে চলে গেছেন লাখ লাখ মানুষ। ব্র্যাকের প্রধান আসিফ সালেহ বলেন, জাতীয় দরিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী জনসংখ্যার পরিমাণ মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ থেকে বেড়ে ৪০ শতাংশ হয়েছে। কাজের সন্ধানে কেউ বিদেশ যেতে পারছে না। এতে ভবিষ্যতে দেশে রেমিট্যান্স প্রবেশের হার কমার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। গত বছর দেশে ঢোকা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ হাজার কোটি ডলারের সমান। এদিকে, বিদেশে লকডাউনের ফলে কাপড়ের চাহিদা কমেছে। যার ফলে ক্রয়াদেশ বাতিলের শিকার হয়েছে দেশের পোশাক কারখানাগুলো।
রুবানা হক বলেন, কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির গতি ধীর হয়ে গেছে। ২০০৫ থেকে ২০১০ এর মধ্যে কাজ করা নারীর সংখ্যা প্রতি বছর গড়ে ১.৭ শতাংশ করে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এরপর থেকে এ বৃদ্ধির হার কমে ০.৭ শতাংশে নেমে এসেছে। তার মতে, নারীদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়ার হারও বেড়েছে। তিনি বলেন, আইনের সুশাসন ও রাজনৈতিক জবাবদিহিতা ছাড়া নারীদের প্রতি সহিংসতা অনিয়ন্ত্রিতই থেকে যাচ্ছে।
এদিকে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে করতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার একটি উপাদানও যোগ করেছেন শেখ হাসিনা। দেশের উপর তার নিয়ন্ত্রণ যতটাই জোরালো হোক না কেন, তার মৃত্যুর পর পর্যন্ত তা টিকে থাকবে না। তার বয়স বর্তমানে ৭৩ বছর। এখন অবদি তার কোনো নিশ্চিত উত্তরসূরী নেই। যদিও পদটির জন্য আত্মীয় ও অন্যান্য ঘনিষ্ঠ মিত্ররা সারি ধরে আছেন। তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ সরকারের একজন উপদেষ্টা। কানাডায় বাসরত তার বোন সায়মা ওয়াজেদকে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি সরকারি কাজ দেওয়া হয়েছে। এতে জল্পনার সৃষ্টি হয়েছে যে, ক্ষমতা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে তাকে। অন্যান্য প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন তার চাচাতো ভাই রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। সম্প্রতি সরকারি নীতিমালা বিষয়ে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করা শুরু করেছেন তিনি। তালিকায় আরও আছেন শেখ ফজলে নূর তাপস, দক্ষিণ ঢাকার মেয়র। ১৯৭৫ সালে হাসিনার পিতা-মাতার সাথে তার বাবা-মা’কেও খুন করা হয়েছিল। কিন্তু এসব প্রার্থীদের কারোর অবস্থানই শেখ হাসিনার মতো শক্ত নয়। আর কেউই সম্ভাব্য কোনো সংস্কারকও নন।
অনেকের ধারণা, পরিবর্তন আসতে পারে সেনাবাহিনী থেকে। ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার ক্ষমতার দখল নিয়েছে তারা। কিন্তু বাহিনীটির উপর শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণও বেশ জোরালো। সম্প্রতি কাতার-ভিত্তিক টিভি চ্যানেল আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বর্তমান সেনাপ্রধান ও হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক প্রকাশ পেয়েছে।
অনেকে আবার ইসলামী উগ্রবাদের আশঙ্কা করেন। ২০১৬ সালে ধর্মীয় চরমপন্থিরা ঢাকার একটি রেস্তোরাঁয় ২৪ জনকে হত্যা করেছিল। শেখ হাসিনা কিছু ইসলামবাদী দলের বিরুদ্ধে দমন অভিযান চালিয়েছেন। রাজনৈতিক দল জামাত-ই-ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। এই দলটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পক্ষে লড়েছিল। কিন্তু একইভাবে হেফাজত-ই-ইসলামের মতো দলগুলোকে কাছেও টেনে নিয়েছেন হাসিনা। তাত্ত্বিকভাবে আওয়ামী লীগ যেই ধর্ম নিরপেক্ষ অবস্থানে রয়েছে, হেফাজত তার বিরোধীতা করে। ৯০ শতাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির সাধারণ মানুষজন সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ধর্মীয় আচারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তবে এদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক মানুষই ধর্মীয় শাসনের জন্য উদগ্রীব।
আদতে, আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ এতটাই পুঙ্খানুপুঙ্খ যে, সাধারণ বাংলাদেশিরা কী চায় তা বোঝা কঠিন। গত ৫০ বছরের মতো ভবিষ্যতেও ব্যক্তিগত অর্থ-সম্পদ বাড়তে থাকলে বেশিরভাগ নাগরিকই হয়তো তুষ্ট থাকবে। আর সেটা হয়েছে এই রাজনীতিকরা থাকা সত্ত্বেও; তাদের অবদানে নয়। (দ্য ইকোনমিস্ট থেকে অনূদিত)