৬ এপ্রিল। ফেনীর সোনাগাজীর আলোচিত মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির গায়ে অগ্নিসংযোগের দুই বছর। ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষার আরবী প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে গেলে হল থেকে ডেকে পাশের ভবনের ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা তুলে নিতে রাজি না হওয়ায় তাকে তার সহপাঠীরা গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে হত্যার চেষ্টা চালায়। নুসরাত হত্যার ২ বছরে নুসরাতের বাড়িতে চলছে সুনসান নীরবতা। নিরাপত্তার জন্য ৩ পুলিশ সদস্য পাহারা দিচ্ছেন। সেই ঘটনায় নুসরাতের শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। চার দিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ৯ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টায় মৃত্যুবরণ করে নুসরাত। ১০ এপ্রিল বিকেলে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে সোনাগাজী মোহাম্মদ ছাবের সরকারি মডেল পাইলট হাইস্কুল মাঠে নামাজে জানাজা শেষে তাকে সামাজিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। নুসরাতের মা শিরিন আক্তারের কাছে তার প্রিয় কন্যা রাফির শূন্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বিচারিক আদালতে ন্যায় বিচার পেয়েছি। শুনেছি উচ্চ আদালতে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামিরা আপিল করেছেন। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসামিদের রায় দ্রুত কার্যকরের ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। তিনি বলেন, আজ দুই বছর আমি আমার মেয়ের কণ্ঠে মা ডাকটি শুনতে পাই না। রাতে ঘুম হয় না। কারণ আমার মেয়ের হাত-পা বেঁধে যখন তারা আগুন লাগিয়েছিল, তখন আমার মেয়ে কি করেছিল? সেদিন আমি খবর পেয়ে ফেনী সদর হাসপাতালে ছুটে যাই, তখন পুলিশ সদস্যরা আমার মেয়ের কাছে ভিড়তে দেয় নাই। তার পুরো শরীর ব্যান্ডেজ করে ফেলে ডাক্তাররা। পুলিশরা আমাকে বলে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। বাঁচে কিনা সন্দেহ? আপনি মেয়ের আগুনে পোড়া এই শরীর দেখলে সহ্য করতে পারবেন না। ডাক্তাররা আপনাকে দূরে থাকতে বলেছে। তখন আমার মেয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। আমার মেয়েকে মহান আল্লাহ চার দিন বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, তার জবান থেকে খুনিদের নাম বেরিয়ে আসার জন্য। ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ নিজ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা কর্তৃক যৌন নিপীড়নের শিকার হন রাফি। ওই ঘটনায় তার মা বাদি হয়ে অধ্যক্ষ সিরাজকে একমাত্র আসামি করে মামলা করেন। একই দিন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। ওই মামলা তুলে নিতে অধ্যক্ষের অনুসারী ওই মাদরাসার ছাত্ররা রাফি ও তার পরিবারের সদস্যদের চাপ দিতে থাকে। ২০১৯ সালের ৩ এপ্রিল খুনিরা সিরাজের সঙ্গে কারাগারে পরামর্শ করে এসে ৪ এপ্রিল মাদরাসার ছাত্রাবাসে নুসরাতকে খুন করার পরিকল্পনা নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৬ এপ্রিল নুসরাত মাদরাসায় আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে খুনিরা পরিকল্পিতভাবে সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে নুসরাতকে হত্যার চেষ্টা চালায়। ঘটনাস্থল থেকে নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। এরপর তাকে স্থানান্তর করা হয় ফেনী ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় সেখান থেকে নুসরাতকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে ৮ এপ্রিল মামলা দায়ের করেন। এদিকে ৯ এপ্রিল মারা যান নুসরাত। এই মামলায় ২৮ মে অভিযোগপত্র দাখিলের পর ২০ জুন অভিযোগ গঠন করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। পরে সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শেষে ৩০ সেপ্টেম্বর আদালত রায়ের জন্য ২৪ অক্টোবর নির্ধারণ করেন। মামলাটি মাত্র ৬১ কার্যদিবসে ৮৭ সাক্ষির সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্ততর্ক গ্রহণ করা হয়। ২৪ অক্টোবর রায়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ ১৬ আসামিকে মৃত্যুদ- দেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানার দ-ে দ-িত করেন।