জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ- শীর্ষক বাজেট উপস্থাপন করছেন অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল। সরকারের এই বাজেট প্রস্তাবনায় রয়েছে বিশ্বময় করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নবিভোর পরিকল্পনা। বাজেট প্রস্তাবনায় রয়েছে করোনার কারণে কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার পরিকল্পনা। তাই এবার বাড়ছে সামাজিক নিরাপত্তার বলয়। বাড়ছে মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ও বাৎসরিক ভাতার পরিমাণ। সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে খাদ্য নিরাপত্তার। জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় এসব তথ্য জানা গেছে।জানা গেছে অর্থমন্ত্রীর ১৫৮ পাতার বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, করোনার কারণে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্থ হয়েছে। মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছে। জমানো পুঁজি ভেঙে খেয়েছে সাধারণ মানুষ। মোট কথা বিশ্বময় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তার পরেও সকল সংকট মোকাবিলা করে দেশের জিডিপি বেড়েছে। বেড়েছে মানুষের মাথাপিছু গড় আয়। এগুলো নিসন্দেহে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে। এই সমৃদ্ধিকে পুঁজি করে মাথা উচু করে বিশ্ব দরবারে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।
সরকার আগামী অর্থবছরের বাজেটে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, কর্মসংস্থান বাড়ানো, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতি বিশেষ নজর দিয়েছে। এ জন্য বাজেটে দিক নির্দেশনা রয়েছে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে চলতি অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় আগামী বাজেটেও করপোরেট করে ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব করেছে অর্থমন্ত্রী।
গতকাল বৃহস্পতিবার (০৩ জুন) আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করছেন অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল। অর্থমন্ত্রীর ভাষায় এবারের বাজেট হচ্ছে “মানুষের জন্য”। জাতীয় সংসদের মন্ত্রিসভা কক্ষে মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে বাজেট অনুমোদন করা হয়। মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত বাজেট সংসদে উপস্থাপনের অনুমতি দিয়ে তাতে সম্মতিসূচক স্বাক্ষর করেছেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। এর পরই অর্থমন্ত্রীকে সংঙ্গে নিয়ে সংসদের অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় সংসদ সদস্যরা করতালি ও টেবিল চাপরিয়ে তাদেরকে স্বাগত জানান।
প্রসঙ্গত, এবারের বাজেটের আকার দাড়িয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী হিসেবে আহম মুস্তফা কামালের এটি তৃতীয় বাজেট, বাংলাদেশের জন্য এটি হবে ৫০তম বাজেট। পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ১৮তম বাজেট হলেও ২০০৮ সাল থেকে বর্তমান সরকারের টানা ১৩তম বাজেট। এর আগে ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনা সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে শাহ এসএম কিবরিয়া পাঁচটি বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন।
করোনা মোকাবিলায় এবারও থোক বরাদ্দ ১০ হাজার কোটি: মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় যা যা করা দরকার সরকার করে যাবে। এ কারণে গত অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরেও জরুরি চাহিদা মেটাতে আবারও ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। গতকাল বৃহস্পতিবার (৩ জুন) জাতীয় সংসদে বাজেট বক্তৃতাকালে অর্থমন্ত্রী এ প্রস্তাব করেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, বিগত বাজেটে করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আওতায় বিশেষ কার্য়ক্রম বাস্তবায়নের জন্য বিপুল বরাদ্দ রাখা হয়। এছাড়া যেকোনো জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়। তিনি বলেন, ‘তবে প্রথম প্রাদুর্ভাবের পর বছর ঘুরে এলেও বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির ভয়াবহ প্রকোপ বিদ্যমান রয়েছে। বিগত বাজেটের মতো এবারও করোনা মোকাবিলায় যা যা করা দরকার সরকার করে যাবে। এ কারণে আগামী অর্থবছরে জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য পুনরায় ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী।
উন্নয়ন বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে: আগামী অর্থবছর দেশের উন্নয়ন খাতে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮ কোটি খরচ করবে সরকার। গত কয়েক বছরের মতো ২০২১-২২ অর্থবছরেও পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
উন্নয়ন ব্যয়ের ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ ব্যয় হবে খাতটিতে। উন্নয়ন বাজেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দ পাচ্ছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত। একইভাবে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে ১৫ দশমিক ১ শতাংশ, জ্বালানি ও বিদ্যুতে ১১ দশমিক ৫, স্বাস্থ্যে ৬ দশমিক ৬, জনপ্রশাসনে ৬ দশমিক ৪, কৃষিতে ৫ দশমিক ৬, সামাজিক নিরাপত্তায় ৩ ও অন্যান্য খাতে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
বিগত কয়েক বছরের ধারা বজায় রেখে উন্নয়ন বাজেটে এবারো সর্বোচ্চ বরাদ্দের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে। আগামী অর্থবছর পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৬১ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের জন্য চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট ধরা হয়েছে ৫০ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত মোট বাজেটের (পরিচালন ও উন্নয়ন মিলিয়ে) ১১ দশমিক ৯ শতাংশ বরাদ্দ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে। আর চলতি অর্থবছর বাজেটের ১১ দশমিক ২ শতাংশ পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বরাদ্দ ছিল।
জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগে ২৮ হাজার ৪২ কোটি টাকা, রেলপথ মন্ত্রণালয়ে ১৩ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে ৪ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে ৩ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে ১ হাজার ৪২০ কোটি টাকা এবং সেতু বিভাগে ৯ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন।
মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেল ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট: মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেয়েছে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট। আজ বৃহস্পতিবার (৩ জুন) দুপুরে সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। এর আগে বেলা ১২টায় জাতীয় সংসদ ভবনের পশ্চিম ব্লকের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত মন্ত্রিসভা কক্ষে এই বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এতে অনুমোদন দিয়ে স্বাক্ষর করেন।
বৈঠকে যোগদান ও সংসদে বাজেট উপস্থাপন করতে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সংসদ ভবন এলাকায় পৌঁছন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বেলা ১২টায় বৈঠক শুরুর আগেই প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভবনে প্রবেশ করেন। এর পর শুরু হয় বিশেষ বৈঠক। সংসদ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে সীমিতসংখ্যক মন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয় বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের তৃতীয় বাজেট এটি। ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামের এবারের বাজেটটি প্রস্তুত হয়েছে সরকারের অতীতের অর্জন এবং উদ্ভূত বর্তমান পরিস্থিতির সমন্বয় ঘটিয়ে। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার বা ব্যয় ধরা হচ্ছে ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে বাজেটের আকার বাড়ছে ৩৫ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
আগামী বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হচ্ছে তিন লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে আয় বাড়ছে ১১ হাজার কোটি টাকা। মোট আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরেও এনবিআরকে একই পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া রয়েছে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত কর থেকে আসবে ১৬ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত প্রাপ্তি ধরা হচ্ছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। আগামী বছরে বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার পরিমাণ ধরা হচ্ছে তিন হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ধরা হয়েছে দুই লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। এডিপি এরই মধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) অনুমোদন করেছে। বাজেটে অনুদান ব্যতীত ঘাটতির পরিমাণ ধরা হচ্ছে দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৬.২ শতাংশ। আর অনুদানসহ সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হচ্ছে দুই লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৬.১ শতাংশ।
অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নেবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। আর জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য খাত থেকে নেওয়া হবে পাঁচ হাজার এক কোটি টাকা। বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭.২ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি ৫.৩ শতাংশের মধ্যে সহনীয় পর্যায়ে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।