দীর্ঘ ২ বছর পর জট খুললো এনটিভির শেরপুর জেলা প্রতিনিধি কাকন রেজার ছেলে সাংবাদিক ফাগুন রেজা হত্যাকান্ডের। খুন হওয়ার আগে ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন তেজগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বিবিএ প্রফেশনাল ২য় সেমিস্টারের ছাত্র ছিলেন। তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি সাব এডিটর হিসেবে সংবাদ মাধ্যম প্রিয় ডটকমে কর্মরত ছিলেন।হত্যার দীর্ঘ দিনপর রহস্য উন্মোচনের দাবি করেছে জামালপুর জেলার পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সংস্থাটি বলছে, ট্রেনে ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের হাতে খুন হয়েছেন ফাগুন। তবে ফাগুনের বাবা সাংবাদিক কাকন রেজার দাবি, আড়ালে কেউ হয়তো এই হত্যাকা-ে মদদ যুগিয়েছে। এর কারণ হিসেবে সাংবাদিক কাজন রেজা জানান, ফাগুনকে হত্যার আগে তার একটা অনুসন্ধানী নিউজের কারণে তার উপর হুমকি এসেছিল। তাই শুধুমাত্র ছিনতাইকে কেন্দ্র করে হত্যার বিষয়টি রহস্যজনক দাবি করেন তিনি। নিহত সাংবাদিক ফাগুন রেজার পরিবার সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২১ মে বিকেল ৪টার দিকে নিজের বাড়ি শেরপুরে আসার জন্য তেজগাঁও রেলস্টেশন থেকে জামালপুরের কমিউটার ট্রেনে উঠেন ফাগুন। ওই দিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে ফাগুন তার বাবাকে মোবাইলে জানান তিনি ময়মনসিংহের কাছাকাছি চলে এসেছেন। এর কিছুক্ষণ পর থেকে ফাগুনের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরদিন জামালপুরের নান্দিনা রেলস্টেশনের কাছে রানাগাছা মধ্যপাড়া গ্রামের দক্ষিণ পাশে রেললাইনের পাশে ফাগুনের মরদেহ পাওয়া যায়। জামালপুর রেলওয়ে থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে পাঠায়। এ ঘটনায় বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে জামালপুর রেলওয়ে থানায় মামলা করেন ফাগুনের বাবা কাকন রেজা। জামালপুর রেলওয়ে থানার বহুল আলোচিত ফাগুন রেজা হত্যা মামলাটি এক বছর আট মাস পর রেলওয়ে পুলিশের কাছ থেকে পিবিআইয়ের কাছে আসে। এর চার মাসেই হত্যার কারণ উদঘাটনের দাবি করছে পিবিআই। জামালপুরের পিবিআই কনফারেন্স রুমে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার এমএম সালাহ উদ্দীন জানান, মামলায় গ্রেপ্তার এক আসামি হত্যাকা-ের বিবরণ দিয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন। আসামি জানিয়েছেন, ফাগুন হত্যাকা-ে জড়িত ছিলেন পাঁচ ব্যক্তি। এরা ট্রেনে সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের সদস্য। গ্রেফতার হওয়া ময়মনসিংহের তারকান্দা এলাকার মোঃ সোহরাব মিয়ার দেওয়া তথ্যসূত্রে জানা যায়, খাবারের সঙ্গে ঘুমের বড়ি কিংবা চেতনানাশক দ্রব্য মিশিয়ে যাত্রীদের অজ্ঞান করে টাকা-পয়সা, মোবাইলসহ মালপত্র হাতিয়ে নেয়াই এদের কাজ। সাংবাদিক ফাগুনের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। জামালপুরের জেলা পিবিআই জানিয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদে এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত একমাত্র আসামি সোহরাব মিয়া জানায়, তিনি প্রায় ৪ বছর ধরে গাজীপুরের উত্তর মাওনা নয়নপুরে ভাড়া বাসায় থাকেন। তার সঙ্গে আসামি মাজহারুল ইসলাম রুমানও ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকেন। আসামি শফিক খান আন্তঃজেলা অজ্ঞান পার্টির সক্রিয় সদস্য ও ছিনতাইকারী। শফিক খানের নেতৃত্বে সোহরাব মিয়া, মাজহারুল ইসলাম রুমান, নজরুল ও শফিকুল ইসলাম ট্রেনে ও বাসে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাবারে মিশিয়ে কৌশলে যাত্রীদের খাওয়ান। এর পর তাদের অজ্ঞান করে যাত্রীদের সঙ্গে থাকা মোবাইল, টাকা-পয়সাসহ অন্যান্য জিনিসপত্র কৌশলে ছিনতাই করেন। ঘটনার দিন বিকেল ৫ টার সোহরাব, শফিক, নজরুল, রুমান ও শফিকুল সিএনজিচালিত অটোরিকশায় গফরগাঁও রেলস্টেশনে যান। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় তারা ট্রেনের একটি বগিতে উঠেন। ট্রেনে উঠার পর একজন ফাগুনকে টার্গেট করেন। ফাগুন তখন তার সিটে বসে ল্যাপটপ চালাচ্ছিলেন। এরপর আসামিরা ফাগুনের পাশে বসে ভাব জমাতে থাকেন। ময়মনসিংহ স্টেশনে ট্রেন এসে থামার পর শফিক সোহরাবকে ১০০ টাকা দিয়ে সবার জন্য কোক কিনে আনতে বলেন। সোহরাব ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্মের একটি দোকান থেকে ১৫ টাকা করে ৬টি কোকের বোতল কিনে ট্রেনে উঠেন এবং একটি বোতলের মুখ খুলে তার ভেতরে ঘুমের বড়ির গুঁড়া মেশান। ট্রেনে ওঠার পর তারা প্রত্যেকে একটা করে বোতল নেন। শফিক ঘুমের বড়ির গুঁড়া মেশানো বোতলটি ফাগুনকে দিলে তিনি রাজি হননি। পরে সবাই মিলে অনুরোধ করলে ফাগুন কোকের অর্ধেক খেয়ে রেখে দেন। রুমান সেই বোতলটি ফেলে দেন। ময়মনসিংহ স্টেশন হতে ট্রেন ছাড়ার পর ফাগুন তার ল্যাপটপ বন্ধ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখেন এবং পকেটে থাকা মোবাইল ফোন বের করে কথা বলেন। আসামিরা সবাই মিলে ফাগুনের সঙ্গে গল্প করতে থাকেন। ট্রেন ময়মনসিংহের বিদ্যাগঞ্জ স্টেশনে থামার পর আরও কয়েকজন যাত্রী নেমে যান। ফাগুন তন্দ্রাচ্ছন্ন হলে আসামিরা তার সঙ্গে থাকা মোবাইল ও টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পুরোপুরি অচেতন না হওয়ায় তারা ফাগুনের সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিতে পারেন নি। এরই মধ্যে ট্রেন পিয়ারপুর স্টেশন হয়ে নুরুন্দি স্টেশনে এসে থামে। আসামিরা ও ফাগুন বাদে সব যাত্রী নেমে যায়। নুরুন্দি স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার পর আসামি সোহরাব ফাগুনের পকেট থেকে কৌশলে মোবাইল নিয়ে নেন। রুমান ও শফিকুল ইসলাম ফাগুনের পকেটে থাকা ১২০০ টাকা নিয়ে নেন। শফিক ফাগুনের সঙ্গে থাকা ব্যাগ টান দিয়ে নিতে চাইলে ফাগুন উঠে দাঁড়িয়ে ট্রেনের দরজায় গিয়ে দুই হাতে ব্যাগ ধরে রাখেন। আসামিরা সবাই ট্রেনের দরজার কাছে এসে দাঁড়ান। নুরুন্দি হতে ট্রেন নান্দিনা স্টেশনের কাছাকাছি আসার পর শফিক এবং রুমান দুজন মিলে ফাগুনকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেন থেকে লাইনের পাশে ঝোপের মধ্যে ফেলে দেন। ট্রেন নান্দিনা স্টেশনে আসার পর আসামিরা সবাই ট্রেন থেকে নেমে মেইন রোডে গিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ময়মনসিংহ ব্রিজে যান। আসামিরা ময়মনসিংহ থেকে বাসে রাত ১২টার দিকে গাজীপুরের মাওনায় যান। শফিক ২০০ টাকা করে দেন এবং সোহরাবকে ফাগুনের মোবাইলটি বিক্রি করে দিতে বলেন। ল্যাপটপসহ ব্যাগটি তিনি নিজের কাছে রাখেন। পরদিন দুপুরে সোহরাব ফাগুনের মোবাইলে তার নিজের সিমটি ভরে তিনদিন ব্যবহার করেন এবং বিক্রির চেষ্টা করেন। তিনি মোবাইলটি বিক্রি না করতে পেরে রুমানকে বিক্রি করার জন্য দেন। পরে রুমান মোবাইলটি ২৭০০ টাকায় একজনের কাছে বিক্রি করেন। এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার এমএম সালাহ উদ্দীন বলেন, ঘটনায় জড়িত অন্যান্য আসামিদের গ্রেপ্তারসহ লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধার এবং হত্যাকা-ের পেছনে অন্য কারও সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ফাগুনের বাবা কাকন রেজা বলেন, একজন লোককে চেতনানাশক খাইয়ে সহজেই মালামাল লুট করা যায়। কিন্তু ট্রেন ও বাসে যারা এই কাজে জড়িত থাকে তারা সহজেই কাউকে হত্যা করে না। এর পেছনে আরও ঘটনা আছে।