আরবি শব্দ ফেরাউন। ইংরেজি ফারাও, বাংলা ফেরাউন। ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দেশীয় রাজা মেনেসের নেতৃত্বে সারা মিসর ঐক্যবদ্ধ হলে ফারাও রাজবংশের সূচনা। প্রাচীন মিসরীয় সম্রাটের রাজকীয় উপাধি ফারাও বা ফেরাউন। প্রচলিত ফেরাউন বলতে দ্বিতীয় রামসিসকে (১২৭৯-১২১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বোঝায়। সে তুতেন খামেন, কাবুস ইত্যাদি পরিচয়ে কুখ্যাত। ইবনে কাসিরে ফেরাউনের পূর্ণ নাম হলো ওয়ালিদ ইবনে মুসাইয়্যিব ইবনে রাইয়্যান। এই পাপিষ্ঠের নাম পবিত্র কোরআনের ২৭ সুরায় ৭৪ বার আছে। ফেরাউনের কিছু ভালো গুণও ছিল! সেগুলো হলো: (ক) গভীর রাতে আল্লাহর ইবাদত। (খ) সারা দিনের অপকর্মের জন্য রাত জেগে অনুতাপ ও ক্ষমা প্রার্থনা(গ) আশ্রয়হীন, ক্ষুধার্ত ও অসহায় মানুষকে সাহায্য। (ঘ) গোপনে আল্লাহকে স্বীকার করা, তাঁরই সাহায্য কামনা। (ঙ) দুর্বলের প্রতি শক্তি দেখানোতে বিরত থাকা। (চ) সাধ্যমতো দান-খয়রাত।
প্রাচীন মিসরের রাজধানী পেন্টাটিউক দ্বিতীয় রামসিস নামধারী ফেরাউনের আবাসস্থল। তার ছিল ১১১ পুত্র ও ৬৭ কন্যা। বর্ণিত আছে, একবার ফেরাউন দারুণ দুঃস্বপ্ন দেখে, ব্যাখ্যাকারীর মাধ্যমে জানতে পারে, বনি ইসরাঈল গোত্রে জন্মগ্রহণকারী এক পুত্রসন্তানের নেতৃত্বে ফেরাউনের রাজত্বের অবসান ঘটবে। তখন ফেরাউন গুপ্তচর লাগিয়ে দেয়, যেন কোনো পুত্রশিশুর জন্ম না হয়। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ‘ফেরাউন পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল এবং সে তার জনগণকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছিল। তাদের এক শ্রেণিকে সে অত্যন্ত দুর্বল করে রেখেছিল, যাদের পুত্রসন্তানকে সে জবাই করত ও নারীদের (ভোগের জন্য) জীবিত রাখত…।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ০৪) এমন পরিবেশে হজরত মুসা (আ.)-এর জন্ম হয়। ক্ষমতার দাপট, ঔদ্ধত্যে বিভোর ফেরাউন নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপালক ‘রাব্বুল আলা’ ঘোষণা করে। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ‘সে বলল, আমিই তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিপালক বা রব। পরিণামে সে আল্লাহর ইহ-পারলৌকিক শাস্তিতে নিপতিত হলো। নিশ্চয়ই এর মধ্যে আছে ধর্মভীরুদের জন্য পরম শিক্ষা।’ (সুরা : নাজিয়াত, আয়াত : ২৪-২৬)
যখন চরমে পৌঁছে ফেরাউনের অবাধ্যতা ও অনাচার, তখন নিপীড়িত জনতার আর্তি পৌঁছায় আল্লাহর দরবারে : ‘হে আমাদের রব! আমাদের এই অত্যাচারীর জনপদ থেকে মুক্তি দাও…।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৭৫)
শুধু তা-ই নয়, ফেরাউন ছয় হাজার কিবতি সেনা নিয়ে মুসা (আ.)-এর অনুসারীদের তাড়া করে লোহিত সাগরের তীরে নিয়ে আসে। তখনই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরাউনের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করা হলো। আল্লাহ ঘোষণা করলেন, ‘সুতরাং আমি তাকে ও তার বাহিনীকে ধরলাম এবং তাদের সাগরে নিক্ষেপ করলাম।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৪০)
অত্যাচারী ফেরাউনের পতন ও পরাজয় হয়। মুসা (আ.)-এর দুর্বল, অসহায় অনুসারীরা পেল মুক্তি-স্বাধীনতা। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি বনি ইসরাঈলকে সাগর পার করিয়ে দিলাম। তখন ফেরাউন ও তার বাহিনী অত্যাচার ও সীমা লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। তারপর যখন সে ডুবে মরার উপক্রম হলো, তখন বলতে লাগল, আমি বিশ্বাস করলাম, বনি ইসরাঈল যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং আমি অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত। (আল্লাহর পক্ষ থেকে জবাব এলো) এখন ঈমান আনছিস? অথচ এর আগে তো তুই অবাধ্যতা করেছিস এবং তুই তো অশান্তি সৃষ্টিকারীদের মধ্যে ছিলি।’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৯৯, ৯১)
১৮৮১ সালে মিসরের নিলের উপত্যকায় ফেরাউনের লাশ পাওয়া যায়। সম্পূর্ণ অবিকৃত ওই লাশ তখনো মমি হয়নি। ১৮৮১, মতান্তরে ১৮৯৮ সালে মমি করে ফেরাউনের লাশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। সাগরে ডুবে মরার কারণে ফেরাউনের শরীরে স্পষ্ট লবণাক্ততা। তিন হাজার ১১৬ বছরের অধিককাল ফেরাউনের লাশ সংরক্ষিত থাকার মধ্যে পবিত্র কোরআনের বাণীর নিত্যতা প্রমাণিত হয়—‘আজ আমি তোর দেহ সংরক্ষণ করব, যাতে তুই তোর পরবর্তীকালের মানুষের জন্য নিদর্শন হয়ে থাকিস…।’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৯২)
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান,ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ,কাপাসিয়া, গাজীপুর