রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৬ অপরাহ্ন

সময়ের মূল্য

মুহাম্মাদ আব্দুল কাদির:
  • আপডেট সময় বুধবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১

জীবন সময়ের সমষ্টি। বলা হয়ে থাকে; সময়ই জীবন। যার আপন জীবনের প্রতি মায়া আছে সে সময়ের যথাযথ মূল্যায়ন করে। জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতা লুকিয়ে আছে সময়ের কররেখায়। শক্তি ও সাধনা দিয়ে যে জয় করতে পারে সময়কে, সময়ের বাঁকে বাঁকে নিহিত সম্ভাবনাকে, সেই হয় সময়ের রাজা।
ইমাম আবু ওয়াফা ইবনে আকীল রহ: বলেন, ‘জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান সবাই এ কথায় একমত যে, মানুষের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পুঁজি হলো সময়। সময় ও অবসর মূল্যবান সম্পদ। কেননা মানুষের দায়িত্ব ও করণীয় অধিক, কিন্তু সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায়।’
আরবিতে প্রবাদ বাক্য আছে; যার বাংলা অর্থ হলো, ‘সময় সোনার চেয়ে দামি।’ প্রবাদটিতে যদিও সময়কে সোনার সাথে তুলনা করা হয়েছে, প্রকৃতার্থে সময়কে তুলনা করার মতো পরিপক্ব কোনো বস্তু নেই!
সময়ই জীবন : সময়ের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য দয়াময় প্রভু তাঁর পাক কালামে সময়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। মানবজীবনে সফলতা ও ব্যর্থতার কথা বলতে গিয়ে সূরা আসরের শুরুতে ‘সময়ের শপথ’ করেছেন। ( সূরা আসর, আয়াত : ১-৩)
সূরা ফাজরের শুরুতেও করেছেন (ঊষার শপথ) ‘সময়ের শপথ।’ (সূরা ফাজর, আয়াত : ০১)
এমনিভাবে কুরআনুল কারিমের বহু স্থানে রয়েছে সময়ের শপথ। এ জন্যই ইসলামের যত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যেমন : নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদির জন্য সময়কে নির্ধারিত করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই নির্দিষ্ট সময়ে নামাজ আদায় করা মুমিনদের কর্তব্য।’ (সূরা নিসা, আয়াত : ১০৩) উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ পাক নামাজের গুরুত্বের সাথে সাথে সময়ের প্রতিও বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন।
রাসূল সা:-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সবচেয়ে ভালো মানুষ কে? তিনি বললেন : যার আয়ু দীর্ঘ হয়েছে এবং আমলও ভালো। (তিরমিজি : ২৩২৯)
হুজুর সা:-এর পবিত্র জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, তাঁর পুরো জীবনই ছিল সময়ের তালে নির্দিষ্ট নিয়ম মাফিক। ইবনুল জাওজি রহ: লিখেন- ‘মনে রাখবেন, সময় খুবই দামি। একটি মুহূর্তও নষ্ট করার নয়! মানুষ সময় নষ্ট করে, অথচ এই সময়ে সে বেহিসাব নেকি কামাই করে নিতে পারত। সময় হলো আবাদি জমির মতো। যদি আমরা একটি বীজ বপন করি তবে হাজারটা শস্য পাবো। এরকম পরিস্থিতিতে কোনো জ্ঞানী মানুষ কি বীজ বপন করা থেকে বিরত থাকতে পারে?’
সময়কে কাজে লাগালেই ধরা দেয় সফলতা। প্রকৃতপক্ষে যারা সফল, তাদের ভিন্ন কোনো গুণ নেই! তাদের গুণ এটাই যে, তারা সময়কে কাজে লাগায়।
সময়কে যারা কাজে লাগাতেন
প্রসিদ্ধ তাবেঈ আমর ইবনে কায়েস রহ:-কে জনৈক ব্যক্তি বলল, হজরত আসুন একটু কথা বলি। তিনি উত্তরে বলেন, ‘সূর্যের যাত্রা থামিয়ে দাও, তোমার সাথে কথা বলব! ’ সময় কতই না মূল্যবান ছিল তাদের কাছে।
ইমাম ফখরুদ্দিন রাজি রহ:- বলেন, ‘আল্লাহর কসম! খানাপিনার সময়টুকুকে কাজে লাগাতে না পারায় আমার ভীষণ আফসোস হয়! কেননা সময় অতি মূল্যবান।’ অথচ আমরা কোথায়?
হাসান আল বাসরি রাহি:- বলতেন, ‘প্রতিটি দিন তোমার মেহমান, আর প্রতিটি মেহমানই একসময় বিদায় নেয়।’ তাই মেহমানকে অবহেলা আর অযতেœ ছেড়ে দেয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ?
সফলতার কোমল স্পর্শ : পূর্বেই বলেছি, সফল ব্যক্তিদের সফলতার মূল খুঁটিই হলো, সময়কে কাজে লাগানো। বাংলার খ্যাতিমান অন্যতম কবি হলেন, আল মাহমুদ। সব ছেড়ে কৈশোরে এসেছিলেন ঢাকায়। সঙ্গে টিনের একটি স্যুটকেস ছাড়া কিছুই ছিল না! ঢাকায় এসে ডুবে থাকলেন নিমগ্ন সাধনায়, হয়ে গেলেন সফলতার আকাশে ধ্রুবতারা। অর্থের অভাবে স্কুল ছাড়তে হয়েছিল স্মৃতি ইরানিকে, সময়কে বুঝলেন, সময়কে কাজে লাগিয়ে শেষমেশ হয়ে গেলেন, বিশাল ভারতের শিক্ষামন্ত্রী।
বাবা একজন সামান্য ট্যাক্সিচালক আর মা ক্যাটরিনা দোকান চালাতেন। ১২ বছর বয়সে দৈনিক পত্রিকার ব্যবসা শুরু করলেন। রাতদিন মেহনতের মাধ্যমে সময়কে কাজে লাগিয়ে এক সময় নাম লেখালেন, পৃথিবীর সেরা ধনীদের লিস্টে। যার নাম- শেলডন অ্যাডেলসন। এসবই মূলত জীবনের শ্রেষ্ঠ ধন সময়কে কাজে লাগানোর নান্দনিক সুফল। সময়কে মূল্যায়ন না করলে!
প্রিয় হাবিব সা:-এর বাণী- দু’টি নেয়ামতের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে অনেকেই প্রবঞ্চিত হয়। নেয়ামত দু’টি হলো, সুস্থতা এবং অবসর। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৪১২)
অন্যত্র বলেছেন, ‘পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞাসিত না হওয়া পর্যন্ত কেয়ামতের দিন কোনো মানুষ তার পা নাড়াতে পারবে না। ১. তার হায়াত সম্পর্কেÑ তা কোথায় ব্যয় করেছে, ২. তার যৌবন সম্পর্কেÑ তা কোথায় বিলীন করেছে, ৩. সম্পদ সম্পর্কেÑ তা কোথা থেকে আয় করেছে, ৪. অর্জনকৃত সম্পদ কোথায় খরচ করেছে, ৫. সে যা জেনেছে সে অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪১৬)
উক্ত হাদিসটির দিকে দৃষ্টিপাত করলে সহজেই অনুমেয় যে, প্রতিটি মানুষকে প্রথম প্রশ্নটি করা হবে তার হায়াত সম্পর্কে। আর হায়াত হলো সময়ের সমষ্টি বিধায় বলা যায় প্রথম প্রশ্নটিই করা হবেÑ সময় সম্পর্কে। সুতরাং যে আদম সন্তানই সময়ের অপব্যয় করবে, সে কেয়ামতের দিন রবের দরবারে আটকে যাবে।
রাসূলুল্লাহ সা:-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ কে?
তিনি বললেন- ‘যার আয়ু দীর্ঘ অথচ আমল মন্দ।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৩৩০)
ইমাম শাফেঈ রহ:- বলেন, ‘সময় তরবারির মতো, যদি তুমি সময়কে কর্তন না করো (কাজে না লাগাও) সে তোমাকে কর্তন করবে। (বরফের মতো গলে গলে তোমার জীবন নিঃশেষ করবে। তোমার বিরুদ্ধে হাশরের ময়দানে সাক্ষী হবে এবং তোমাকে ধ্বংস করবে।)’
এ জন্যই মানবতার শ্রেষ্ঠ বন্ধু হজরত মুহাম্মদ সা: উপদেশ দিয়ে বলেছেনÑ
‘পাঁচটি বিষয়ের পূর্বে অপর পাঁচটি বিষয়কে সুযোগ হিসাবে বরণ করে নাও।
১. বার্ধক্য আসার পূর্বে তারুণ্যকে, ২. অসুস্থ হওয়ার পূর্বে সুস্থতাকে, ৩. অভাব আসার পূর্বে সচ্ছলতাকে, ৪. কর্মব্যস্ততা আসার পূর্বে অবসরকে এবং ৫. মৃত্যু আসার পূর্বে জীবনকে।’ (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদিস : ৭৮৪৬)
বর্ণিত হাদিসের পাঁচটি উপদেশেই মূলত সময়কে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছে। খাজা মাজযুব রহ:-এর একটি বিশেষ কবিতাংশ ; যার অনুবাদ হলো-
‘জীবন গলে যাচ্ছে বরফের মতো,
ধীরে-ধীরে চুপিসারে অবিরত।’
আল্লাহ পাক আমাদের সময়ের গুরুত্ব বোঝার এবং সময়কে কাজে লাগানোর তাওফিক দান করুন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com