মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৪৪ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::
ভোলার বিভিন্ন চরাঞ্চল অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত লালমোহনে ডা. আজাহার উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের সভাপতিকে সংবর্ধনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদ ও আহতদের স্মরণে স্মরণসভা সিংড়ায় পরিবেশ রক্ষার্থে ৫৩৬টি ডাস্টবিন বিতরণ কাজী আজিম উদ্দিন কলেজে শিক্ষার্থীদের সাথে ছাত্রদলের ৩১ দফা নিয়ে মতবিনিময় সভা পটুয়াখালীতে শিক্ষক দম্পতি হত্যাকান্ডের মূল রহস্য উদঘাটনের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন টুঙ্গিপাড়ায় ভিক্ষুক ও হতদরিদ্রদের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলো সমাজসেবা অফিস জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের আওতায় এনে সহায়ক কর্মচারী অন্তর্ভুক্ত ও বিচার বিভাগের আলাদা সচিবালয় গঠনের নিমিত্তে দাবি পেশ দাউদকান্দিতে সড়কের মাটি ধসে পড়ল খালে, দুর্ঘটনার আশংকা সীতাকুন্ডে বিতর্কিত মাদ্রাসা পরিচালকের করা মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে মানববন্ধন

মসজিদে নববীর জুমার খুতবা

শায়খ আব্দুল মুহসিন আল কাসেম হাফি;
  • আপডেট সময় সোমবার, ১১ অক্টোবর, ২০২১

অতঃপর! আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা যথাযথভাবে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করুন এবং ইসলামের রুজ্জুকে সুদৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরুন। হে মুসলমানগণ! আল্লাহকে চেনা ও জানা দ্বীনের মূলনীতি। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের কাছে নিজের নাম ও গুণাবলির পরিচয় দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে হালাল ও হারাম সম্পর্কিত আয়াতগুলোর তুলনায় আল্লাহর নাম, গুণাবলি ও কর্ম সম্পর্কিত আয়াত অনেক বেশি। আল্লাহ তায়ালার অন্যতম গুণবাচক নাম হচ্ছে ‘আল-হামিদ’ অর্থ- সর্বময় প্রশংসার অধিকারী। এ নামে এমন কিছু গুণ ও প্রশংসার উপকরণ রয়েছে যা তাঁর প্রশংসনীয় হওয়ার দাবি রাখে, এমনকি যদি তিনি ছাড়া অন্য কেউ তাঁর প্রশংসা না করে তবুও। তিনি কুরআনে এ নামের সাথে পরাক্রমশালী, অভিভাবক, মহিমান্বিত, অভাবমুক্ত ও প্রজ্ঞাময় বিশেষণও যুক্ত করেছেন। আল্লাহর প্রশংসা বলতে তাঁর প্রতি ভালোবাসা ও ভক্তির সাথে তাঁর পরিপূর্ণ গুণাবলি ও সম্মানজনক বৈশিষ্ট্যাবলি উল্লেখ করার মাধ্যমে তাঁর গুণকীর্তন করা এবং তাঁর সৌন্দর্যাবলি সম্পর্কে সংবাদ দেয়াকে বোঝায়। কাজেই আল্লাহ তায়ালার স্বীয় সত্তার পরিপূর্ণতা ও সৌন্দর্যতার জন্য এবং তাঁর কর্ম, সৃষ্টির ওপর দয়া ও ইহসানের জন্য তাঁরই প্রশংসা করতে হবে। স্বয়ং আল্লাহ নিজের প্রশংসা করেছেন এবং তিনি স্বীয় সত্তার প্রশংসা ও মহিমা প্রকাশ করাকে পছন্দ করেন। আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক স্বীয় সত্তার প্রশংসাই শ্রেষ্ঠ ও সর্বোচ্চ প্রশংসা; তিনি কেমন প্রশংসার যোগ্য তা প্রকৃতপক্ষে তিনি ছাড়া আর কেউই পূর্ণভাবে জানে না। কাজেই সৃষ্টির কেউ তাঁর গুণকীর্তন আয়ত্ত ও সম্পন্ন করতে পারবে না। রাসূল সা: বলেছেন, ‘আল্লাহর চেয়ে প্রশংসাপ্রীতি অন্য কারো নেই; তাই তিনি নিজেই নিজের প্রশংসা করেছেন’ (বুখারি ও মুসলিম) ইমাম নববী বলেন, ‘বস্তুত এটা বান্দাদের কল্যাণের জন্যই; কেননা তারা আল্লাহর প্রশংসা করে সওয়াব লাভ করে। ফলে তারাই এ থেকে উপকৃত হয়। আর আল্লাহ সৃষ্টিজগতের কারো মুখাপেক্ষী নন; তাদের প্রশংসায় তাঁর কোনো উপকার হয় না এবং প্রশংসা না করায় তাঁর কোনো ক্ষতিও হয় না।’
সর্ববিধ প্রশংসার সাথে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিজগতকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন, ‘সব প্রশংসা আল্লাহরই যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, আর সৃষ্টি করেছেন অন্ধকার ও আলো’ (সূরা আনয়াম-১)।
স্বীয় প্রশংসা ও মহিমা উল্লেখ করে আল্লাহ তায়ালা কুরআনের পাঁচটি সূরা আরম্ভ করেছেন; সেগুলোতে তিনি সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, কিতাব নাজিল করেছেন, রাসূল প্রেরণ করেছেন, তিনিই সৃষ্টিকে জীবন ও মৃত্যু দেন এবং কুরআনের শুরুতেই সর্বময় স্বীয় প্রভুত্বের অধিকারী তিনিই মর্মে ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘সব প্রশংসা আল্লাহর, যিনি সৃষ্টিকুলের প্রতিপালক’ (সূরা ফাতেহা-১)।
আরশ বহনকারী ফেরেশতাগণ নিরলসভাবে আল্লাহর প্রশংসায় ব্যস্ত রয়েছেন। এ মর্মে তিনি বলেন, ‘যারা আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা এর চারপাশে আছে, তারা তাদের রবের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে প্রশংসার সাথে এবং তাঁর ওপর ঈমান রাখে, আর মুমিনদের জন্য তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে’ (সূরা আল মুমিন-৭)। ‘এভাবে সকল ফেরেশতাই আল্লাহর প্রশংসা করে। আর ফেরেশতাগণ তাদের রবের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে’ (সূরা আশ-শুরা-৫)। সব নবীই বিভিন্ন সময়ে তাদের রবের প্রশংসা ও স্তুতি প্রকাশ করতেন। আল্লাহ তায়ালা নূহ আ:কে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘অতঃপর যখন তুমি ও তোমরা সঙ্গীরা নৌযানের ওপর স্থির হবে, তখন বলোÑ সব প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে উদ্ধার করেছেন জালেম স¤প্রদায় থেকে’ (সূরা আল মুমিনুন-২৮)। ইবরাহিম আ: বলেছেন, ‘সব প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি আমাকে আমার বার্ধক্যে ইসমাঈল ও ইসহাককে দান করেছেন’ (সূরা ইবরাহিম-৩৯)। দাউদ ও সুলাইমান আ: বলেছেন, ‘সব প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদেরকে তাঁর বহু মুমিন বান্দাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন’ (সূরা আন নামূল-১৫)। আল্লাহ তায়ালা আমাদের নবী মুহাম্মদ সা:কে তাঁর প্রশংসা করতে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘বলুন, সব প্রশংসা আল্লাহরই এবং শান্তি তাঁর মনোনীত বান্দাদের প্রতি’ (সূরা আন নামূল-৫৯)। এমনকি আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদেরকেও নির্দেশ দিয়েছেন যেন তারা তাঁরই প্রশংসা করে। তিনি বলেন, ‘আর বলুন, সব প্রশংসা আল্লাহরই, তিনি তোমাদেরকে সত্বর দেখাবেন তাঁর নিদর্শনাবলি; তখন তোমরা তা চিনতে পারবে’ (সূরা আন নামূল-৯৩)। জান্নাতের ওয়াদাপ্রাপ্ত মুমিনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তারা আল্লাহ তায়ালার প্রশংসাকারী বান্দা। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন : এরা তাওবাকারী, ইবাদতকারী, আল্লাহর প্রশংসাকারী … (সূরা আত-তাওবাহ : ১১২)। এমনকি বজ্রধ্বনিও আল্লাহর সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করে এবং ফেরেশতারাও তা-ই করে তাঁর ভয়ে।
মহান আল্লাহ সংবাদ দিয়েছেন যে, প্রত্যেক কাল ও স্থানে তাঁর প্রশংসা ও গুণকীর্তন বিদ্যমান রয়েছে। এ মর্মে তিনি বলেছেন, ‘কাজেই তোমরা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো যখন তোমরা সন্ধ্যা এবং ভোরে উপনীত হও এবং বিকেলে, আর যখন তোমরা দুপুরে উপনীত হও আর তাঁরই জন্য সমস্ত প্রশংসা আসমানে ও জমিনে’ (সূরা আর-রুম : ১৭-১৮)। আসমান ও জমিনÑ এ দুয়ের মধ্যবর্তী সব কিছু আল্লাহর প্রশংসায় পরিপূর্ণ; সৃষ্টিজগতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর প্রশংসা করে ও পবিত্রতা বর্ণনা করে। আল্লাহ বলেন, ‘সাত আসমান ও জমিন এবং এগুলোর অন্তর্র্বতী সব কিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা বর্ণনা করে না; কিন্তু তাদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা বুঝতে পার না’ (সূরা বনি ইসরাঈল-৪৪)।
আল্লাহর প্রশংসা একটি গুরুত্বপূর্ণ জিকির, যা আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন। তাই বান্দা রাত-দিন যেসব কথা বলে তার মধ্যে আল্লাহর প্রশংসামূলক জিকির থাকা অধিক হকদার ও জরুরি। রাত-দিনের কোনো সময় যেন এমন জিকিরবিহীন না কাটে। দ্বীনের সব বিষয় তাওহিদ ও হামদকে কেন্দ্র করে পরিচালিত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, ‘তিনি চিরঞ্জীব, তিনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই। কাজেই তোমরা তাকেই ডাকো, তাঁর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে। সব প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহরই’ (সূরা আল মুমিন-৬৫)। শায়খুল ইসলাম রহ: বলেন, ‘তাওহিদের মাধ্যমেই হাদ/প্রশংসা পরিপূর্ণ হয়। এটি তাওহিদের সাথে সম্পর্কযুক্ত ও তার প্রারম্ভিকা; এ জন্যই প্রথমে প্রশংসা তারপর তাশাহহুদ দিয়ে বক্তব্য শুরু করা হয়।’
ইবাদতের মধ্যে, বিশেষ করে সালাতকে প্রশংসা/হাদ দিয়ে শুরু করা বান্দাদের জন্য আল্লাহ তায়ালা বৈধ করেছেন। নবী সা: রাত ও দিনের সালাতের প্রথম অংশের হামদের বাক্যগুলো পরিবর্তন করতেন ও তাতে ভিন্নতা আনতেন। একদা রাসূল সা: এক ব্যক্তিকে সালাতে বলতে শুনলেন : ‘আল্লাহু আকবার কাবীরা, ওয়াল হামদুলিল্লাহি কাসীরা, ওয়া সুবহানাল্লাহি বুকাতান ওয়া আসীলা।’ তারপর তিনি বললেন : এগুলো আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। কারণ এ বাক্যগুলোর জন্য আসমানের দরজা খুলে দেয়া হয়েছে (সহিহ মুসলিম)। সূরা ফাতেহা প্রশংসা ও গুণকীর্তনের সূরা; এ সূরা ব্যতীত সালাত বিশুদ্ধ হয় না। বান্দা যখন রুকু থেকে মাথা উঠায়, তখন সে বলে :
‘আল্লাহ সে ব্যক্তির ডাকে সাড়া দেন যে তাঁর প্রশংসা করে। কাজেই আল্লাহর প্রশংসা করার সাথে বান্দার ডাকে সাড়া প্রদানের বিষয়টি জড়িত; ফলে এটি হামদকে সালাতের রূহ ও ভিত্তি বানিয়েছে। সালাতের এ স্থানে রাসূল সা: তার রবের বেশি করে হামদ পাঠ করতেন ও হামদের শব্দে ভিন্নতা আনতেন এবং সেটাকে অধিক, পবিত্র, বরকতময় ইত্যাদি বিশেষণে বর্ণনা করতেন। একদা রাসূল সা: সালাতে এক ব্যক্তিকে রুকুর পর এ দোয়া পাঠ করতে শুনলেন : তারপর তিনি বললেন : আমি দেখলাম, ত্রিশেরও বেশি ফেরেশতা তা নিয়ে তাড়াহুড়ো করছে, কে তা সর্বাগ্রে লিপিবদ্ধ করবে (সহিহ বুখারি)। যে ব্যক্তি সালাত শেষে আল্লাহর প্রশংসা/তাহমীদ, তাকবির ও তাসবিহ পাঠ করে, তার গোনাহগুলো মাফ করে দেয়া হয়। যদিও তা সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হয়। এর মাধ্যমে ব্যক্তি তাদের স্তরে পৌঁছে যায় যারা স্বীয় সম্পদ মুক্তহস্তে দান করে (সহিহ মুসলিম)।
হজ সম্পাদনের সময়ও রাসূল সা: অধিকাংশ ক্ষেত্রে আল্লাহর হামদ বা গুণকীর্তন করতেন। হজের শি’আর বা সেøাগান হলো তালবিয়া পাঠ করা। এখানেও পূর্ণ হাদ-এর সাথে আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দিয়ে বলা হয়Ñ নিশ্চয় যাবতীয় প্রশংসা, নেয়ামত ও রাজত্ব একমাত্র আপনারই (বুখারি ও মুসলিম)।
শরয়ি খুতবাগুলো যেমন জুমার খুতবা, ঈদের খুতবা এবং ইসলামী মাহফিলসহ আরও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে শুরুতে আল্লাহর হাম্দ ও মহিমা প্রকাশ করে সেগুলো আরম্ভ করা হয়। আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর গুণকীর্তন বিবেক-বুদ্ধিকে স্পর্শ করে। একদিন যিমাদ আযদী নামক জনৈক ব্যক্তি নবী সা:-এর কাছে এসে শুনতে পেলেন যে, তিনি বক্তব্যের শুরুতে রবের প্রশংসা ও গুণকীর্তন করেন। তারপর যিমাদ বললেন : ‘আমি অনেক গণক, জাদুকর ও কবির কথা শুনেছি, কিন্তু আপনার এ কথাগুলোর মতো কোনো কিছু শুনিনি! এ কথাগুলো সমুদ্রের গভীর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। অতঃপর তিনি নবী সা:-কে বললেন : আপনার হাত প্রসারিত করুন, আমি আপনার কাছে ইসলামের বায়আত গ্রহণ করব। বর্ণনাকারী বলেন : তারপর তিনি তাকে বায়আত করালেন। অতঃপর রাসূল সা: বললেন : তোমার স¤প্রদায়ের ক্ষেত্রেও কি বায়আত প্রযোজ্য? সে বলল : আমার স¤প্রদায়ের ক্ষেত্রেও (সহিহ মুসলিম)।
জিকিরের মজলিসগুলো যেখানে আল্লাহর গুণকীর্তন করা হয়, সেখানে ফেরেশতাগণ উপস্থিত হন। তারপর তারা আল্লাহকে সংবাদ দেন যে, এরা তাঁর তাসবিহ, তাকবির, তাহলিল ও তাহমিদ পাঠ করছে এবং তাঁর কাছে দোয়া করছে; ফলে তাদের ক্ষমা করে দেয়া হয় (বুখারি ও মুসলিম)। যে দোয়ার শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা করা হয়, তা কবুল হওয়ার অধিক উপযোগী। নবী সা: বলেছেন : তোমাদের কেউ যখন দোয়া করে, তখন সে যেন আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন দিয়ে শুরু করে (সুনানে তিরমিজি)। আল্লাহর হাম্দ যেমন বান্দার ইবাদতগুলোর সাথে সম্পৃক্ত তেমন তা বান্দার প্রত্যেক অবস্থার সঙ্গী। রাসূল সা: খাবার খেয়ে বলতেন : পবিত্র বরকতময় অনেক অনেক প্রশংসা আল্লাহর জন্য (সহিহ বুখারি)। পানাহার শেষে আল্লাহর প্রশংসা করা তাঁর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। রাসূল সা: বলেন : অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা সে বান্দার ওপর সন্তুষ্ট হন, যেকোনো খাবার খেয়ে তার জন্য আল্লাহর প্রশংসা করে অথবা কোনো পানীয় পান করে তার জন্য আল্লাহর প্রশংসা করে (সহিহ মুসলিম)।
পরিধেয় বস্ত্রও পানাহারের মতো একটি নেয়ামত। রাসূল সা: যখন কোনো পোশাক পরিধান করতেন, তখন সেটার নাম উল্লেখ করতেন ও বলতেন : হে আল্লাহ! আপনার জন্যই প্রশংসা, আপনিই তো এটি আমাকে পরিধান করিয়েছেন (মুসনাদে আহমাদ)।
কেউ হাঁচি দিলে তাকে রাসূল সা: আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করতে নির্দেশ দিয়েছেন (সহিহ বুখারি)।
রাসূল সা: সফর শেষ করে ফিরে আসার সময় বলতেন : আমরা প্রত্যাবর্তনকারী, তাওবাকারী, আমাদের প্রভুর ইবাদতকারী ও প্রশংসাকারী (বুখারি ও মুসলিম)।
রাসূল সা: পরামর্শ দিয়েছেন যে, ‘কেউ বিছানায় গেলে, ঘুমানোর আগে তেত্রিশ বার আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করবে। এর সাথে সুবহানাল্লাহ ও আল্লাহু আকবার পাঠ করা একজন খাদেম থাকার চেয়েও উপকারী’ (সহিহ মুসলিম)। নিদ্রা যাওয়ার পর যাকে আল্লাহ তায়ালা রূহ ফেরত দিয়ে জাগ্রত করালেন, তাকে মূলত আয়ু বৃদ্ধি করে নেয়ামত প্রদান করলেন; যাতে সে বহু কল্যাণ লাভ করতে পারে। তাই রাসূল সা: ঘুম থেকে জেগে বলতেন : প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদের মৃত্যুদানের পর আমাদেরকে পুনর্জীবিত করেছেন এবং তাঁর দিকেই আমাদের প্রত্যাবর্তন হবে (সহিহ মুসলিম)। আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর মহিমা বর্ণনা করা বক্ষকে প্রসারিত করে এবং কাজে শক্তি জোগায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন : আর অবশ্যই আমি জানি, তারা যা বলে তাতে আপনার অন্তর সঙ্কুচিত হয়; কাজেই আপনি আপনার রবের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন এবং আপনি সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হন (সূরা আল হিজর : ৯৭-৯৮)।
যে ব্যক্তি হামদ পাঠে নিজের জিহ্বাকে একবার নাড়াবে, এতে সে প্রতিবার তাহমিদ ‘আলহামদুল্লিাহ’ পাঠের বিনিময়ে ধন-সম্পদ সদকা করার সমান সওয়াব পাবে। রাসূল সা: বলেছেন : প্রতিটি তাহমিদ তথা আলহামদুলিল্লাহ বলা একটি সদকা (সহিহ মুসলিম)। আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় চারটি কালেমার মধ্যে আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করা অন্যতম। এটি রাসূল সা:-এর কাছেও বেশি প্রিয় সেসব বস্তুর চেয়ে, যার ওপর সূর্য উদিত হয় (সহিহ মুসলিম)।
যে ব্যক্তি সর্বদা নিজেকে হামদ পাঠে ব্যস্ত রাখে সে সবার চেয়ে অগ্রগামী। রাসূল সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি সকাল ও সন্ধ্যায় উপনীত হয়ে ১০০ বার পাঠ করবে ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াবি হামদিহি’ কিয়ামতের দিন অন্য কেউ তার চেয়ে উত্তম কোনো আমল নিয়ে আসতে পারবে না। তবে যদি কেউ অনুরূপ বা এর চেয়েও বেশি আমল করে সে ব্যতীত। (সহিহ মুসলিম)
‘আলহামদুলিল্লাহ’ এর সাথে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করা গোলাম আজাদের সমান এবং তা গোনাহ মোচন আবশ্যক করে দেয়। হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি বলবে সুবহানাল্লাহিল আজিম ওয়াবি হামদিহি; তবে তার জন্য জান্নাতে একটি খেজুরগাছ রোপণ করা হবে। (সহিহ মুসলিম)
হামদ পাঠের একটি বাক্য রয়েছে যার সওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধি করা হয়। রাসূল সা: জুয়াইরিয়া রা:কে বললেন, ‘আমি তোমার কাছ থেকে বের হওয়ার পর চারটি কালেমা তিনবার পড়েছি। আজকে তুমি এ পর্যন্ত যা পাঠ করেছ তার সাথে সেগুলো ওজন করা হলে এগুলোর ওজনই ভারী হবে।’ (সহিহ মুসলিম)
হামদ ও তাসবিহ এমন দু’টি বাক্য যা উচ্চারণে হালকা এবং ওজনে ভারী। এ মর্মে রাসূল সা: বলেছেন, ‘দু’টি বাক্য এমন যা মুখে উচ্চারণ করা অতি সহজ, পাল্লায় অতি ভারী আর দয়াময়ের নিকট অতি প্রিয়। তা হলো সুবহানাল্লাহি ওয়াবি হামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আজিম।’ (বুখারি ও মুসলিম)
আলহামদুলিল্লাহ মিজানের পরিমাপকে সওয়াবে পরিপূর্ণ করে দেয়, আর সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী স্থানকে পরিপূর্ণ করে দেয়। যেমনভাবে প্রত্যেক ভালো কাজ হামদ ও সানা দিয়ে সূচনা হয়, তেমনি তার সমাপ্তিতেও হামদ রয়েছে। ‘যদি কেউ এমন কোনো বৈঠকে বসে যেখানে নানা রকম অহেতুক কথাবার্তা হয়, তাহলে বৈঠক ত্যাগের আগে যদি বলে, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার প্রশংসাসহ পবিত্রতা ঘোষণা করছি, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি ছাড়া সত্য কোনো মাবুদ নেই, আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি ও তওবা করছি। তাহলে ওই বৈঠকে যা হয়েছে তা ক্ষমা করে দেয়া হবে।’ (সুনানে তিরমিজি) যখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী মুহাম্মাদ সা:-এর হাতে দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলেন এবং তাঁর ওপর নেয়ামতকে সম্পূর্ণ করলেন ও তাঁর আয়ু ঘনিয়ে এলো, তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে বললেন, ‘আপনি আপনার রবের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন।’ সৃষ্টিকুলের মধ্য হতে আমাদের নবী মুহাম্মাদ সা: আল্লাহর সবচেয়ে বেশি প্রশংসা করেছেন। কিয়ামতের দিন তাকে আল্লাহ তায়ালা প্রশংসিত স্থান তথা মাকামে মাহমুদে দাঁড় করাবেন, সৃষ্টির সবাই তার প্রশংসা করবে। তার হাতে দৃশ্যত ও বাস্তবিকভাবে হামদের (প্রশংসার) পতাকা থাকবে যার নিচে সব মানুষ একত্রিত হবে। এ মর্মে রাসূল সা: বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি সব আদম সন্তানের নেতা হবো, এতে গর্বের কিছু নেই। আমিই প্রথম ব্যক্তি যার জন্য জমিন বিদীর্ণ করা হবে, এতেও গর্বের কিছু নেই। আর আমার হাতেই হামদের প্রশংসার- পতাকা থাকবে, তাতেও গর্বের কিছু নেই; আদম ও তার পরের সবাই সেদিন আমার পতাকার নিচে একত্র হবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ) আল্লাহ তায়ালা যেমনভাবে সৃষ্টির সূচনা করেছেন প্রশংসাসহ, তেমনি এ মহাবিশ্বের সমাপ্তিও ঘটাবেন নিজ প্রশংসার ধ্বনি দিয়ে। তিনি বলেন, ‘আর তাদের মাঝে বিচার করা হবে ন্যায়ের সাথে এবং বলা হবে, সব প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য।’ (সূরা আযযুমার : ৭৫) ইবনে কাসির রহ: বলেন, ‘সেদিন সৃষ্টির বাক ও নির্বাক সব প্রাণীই বিশ্বপ্রভু আল্লাহর বিচার ও ইনসাফের জন্য তাঁর প্রশংসায় কথা বলবে; এ কারণেই ওই আয়াতে উক্তিকারীকে নির্দিষ্ট করেননি, বরং তা উন্মুক্ত রেখেছেন। ফলে এটা প্রমাণ করে যে, সৃষ্টিকুলের সবাই তাঁর জন্য সপ্রশংস সাক্ষ্য দেবে।’ যেমনিভাবে আল্লাহর প্রশংসা দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত, তেমনি তা পরকালেও চলমান। জান্নাতিরা যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে, তারা সর্বপ্রথম যে কথাটি বলবে তা হলো- আলহামদুলিল্লাহ। এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তারা বলবে, যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহরই যিনি আমাদের এ পথের হেদায়াত করেছেন। আল্লাহ আমাদের হেদায়াত না করলে আমরা কখনো হেদায়াত পেতাম না।’ (সূরা আল আরাফ-৪৩) সেখানে তাদের মনে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই তাসবিহ ও তাহমিদ পাঠের ইলহাম (মনে উদিত করে দেয়া) করা হবে। মহান আল্লাহ বলেন, “সেখানে তাদের ধ্বনি হবে- হে আল্লাহ! আপনি মহান, পবিত্র! এবং সেখানে তাদের অভিবাদন হবে ‘সালাম’। আর তাদের শেষ ধ্বনি হবে সব প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য।” (সূরা ইউনুস-১০)
পরিশেষে, হে মুসলমানগণ! আল্লাহর হাম্দ বা প্রশংসা দুনিয়া, আখিরাত, আসমান ও জমিন এবং এ দুয়ের মধ্যবর্তী স্থান ও তাতে যা কিছু আছেÑ সবকিছুকে পরিপূর্ণ করে দেয়। বান্দাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সেটাকে বা যেকোনো নেয়ামতকে অস্বীকার করে, আল্লাহ তায়ালা তাদের থেকে মুক্ত। এ মর্মে তিনি বলেন, ‘যদি তোমরা কুফরি করো তবে (জেনে রাখো) আল্লাহ তোমাদের মুখাপেক্ষী নন। আর তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য কুফরি পছন্দ করেন না। আর যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় করো তবে তিনি তোমাদের জন্য তা-ই পছন্দ করেন।’ (সূরা আযযুমার-৭) সব নেয়ামত তাঁরই প্রশংসায় শুরু হয় এবং তাঁরই প্রশংসায় সম্পন্ন হয়। প্রশংসা করা ও শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে নেয়ামতগুলো স্থায়ী হয় ও তা বৃদ্ধি পায়। মহান আল্লাহই একমাত্র উপাস্য ও প্রশংসনীয়; কাজেই আপনারা অধিক পরিমাণে আল্লাহর প্রশংসা করুন, গুণকীর্তন করুন ও তাঁর আনুগত্য করুন এবং তাঁর বিধান ও দ্বীনের সুনাম ও স্তুতি বর্ণনা করুন। কেননা আল্লাহ তায়ালা যা পছন্দ করেন, সেটার প্রশংসা করা তাঁরই প্রশংসার শামিল। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তিনিই আল্লাহ, তিনি ছাড়া সত্য কোনো ইলাহ নেই; দুনিয়া ও আখিরাতে সব প্রশংসা তাঁরই, বিধান তাঁরই। আর তোমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সূরা আল কাসাস : ৭০)
অনুবাদ : হারুনুর রশীদ ত্রিশালী, পিএইচডি গবেষক, মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com