ডাক দিবস প্রতিষ্ঠার বয়স বেশি না হলেও বহুকাল আগে থেকেই চিঠি আদান-প্রদানের প্রচলন শুরু হয়েছিল। বহু পয়গাম্বর ও শাসকরা যুগে যুগে নানা প্রয়োজনে দূরে কিংবা কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। এ কাজে দ্রুতগ্রামী অশ্বারোগী, কবুতরসহ অনেক পাখি ব্যবহারর প্রচলনও ছিল। ডাক দিবস এলেই মনে পড়ে যায় বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিঠি প্রেরণের কথা। মোহরে নবুয়তের সীল সমৃদ্ধ তাঁর এসব চিঠি গিয়েছিল তৎকালীন সময়ে রাজা-বাদশাহদের হাতে। মানুষের কল্যাণে কত চমৎকারভাবেই না তিনি এসব চিঠি লিখেছিলেন! রাজা-বাদশাহদের কাছে পাঠানো সেসব চিঠি ও দাওয়াতের অনেক নিদর্শন আজও পৃথিবীর বুকে বিদ্যমান। রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছেও তিনি চিঠি পাঠিয়েছেন। সম্রাটের কাছে পাঠানো সেই ঐতিহাসিক চিঠিতে আছে খতমে নবুয়তের সীল। জর্ডানের জাদুঘরে আজও এ চিঠি সংরক্ষিত। এ চিঠিতে স্থান পেয়েছে তাঁর অসাধরণ কথা।
সম্রাট হেরাক্লিয়াসকে লেখা তাঁর চিঠি
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর বান্দা ও রাসুল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পক্ষ থেকে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বরাবর। ন্যায়ের পথের অনুসারীদের প্রতি সালাম। এরপর আমি আপনাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করছি। যদি প্রশান্তি লাভ করতে চান, তবে ইসলাম গ্রহণ করুন। যদি আপনি ইসলাম গ্রহণ করেন, তবে আল্লাহ আপনাকে দ্বিগুণ প্রতিদান দেবেন। আর যদি প্রত্যাখ্যান করেন, তবে আপনার সব প্রজাসাধারণের পথভ্রষ্টতার দায় আপনার ওপরই বর্তাবে।
(এরপর তিনি লেখেন)-
হে আহলে কিতাবের অনুসারিরা! বিতর্কিত সব বিষয় স্থগিত করুন। আমরা এমন এক বিষয়ে (তাওহিদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের বিষয়ে) ঐকমত্যে পৌঁছেছি; যাতে তোমাদের ও আমাদের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য নেই। আর তা হচ্ছে-
‘আমরা এক আল্লাহ ছাড়া আর কারও ইবাদত করব না; যদি এ বিষয়গুলো আপনি অস্বীকার করেন, তবে শুনে রাখুন, আমরা সর্বাবস্থায় আল্লাহর একত্ববাদের বিশ্বাসে অবিচল থাকব।’ আল্লাহ রাসুল মুহাম্মাদ (মোহরে নবুয়তের সীল) চিঠি লেখা যেখানে শেষ হয়েছে, ঠিক সেখানেই প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মোহরে নবুয়তের সীল মেরেছিলেন।
চিঠি আদান-প্রদান তথা ডাক ব্যবস্থা দাওয়াতের অন্যতম মাধ্যম। কোনো কালেই এ ডাক ব্যবস্থা একেবারেই অকার্যকর ছিল না। বরং সব যুগেই ডাক ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু দূত মারফত চিঠি পাঠিয়েই বিরত হননি। ইসলামের বার্তাবাহক হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাওহিদের দাওয়াত পৌঁছে দিতে চষে বেড়িয়েছেন পবিত্র নগরী মক্কা-মদিনাসহ আরবের অনেক শহর।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলিইহি ওয়া সাল্লামের এ চিঠিগুলো এখনো সংরক্ষিত আছে। এরমধ্যে কয়েকটি চিঠি ইস্তাম্বুল জাদুঘরে রাখা হয়েছে। সৌদি আরবের মদিনা জাদুঘরেও কয়েকটি চিঠির মূল অনুলিপি সংরক্ষিত আছে। আর রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াসের কাছে পাঠানো সেই ঐতিহাসিক চিঠি জর্ডানের জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
তিনি যাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে মোহরে নবুয়তের সীল সমৃদ্ধ চিঠি ও দূত পাঠিয়েছিলেন; তারা হলেন- > রোম তথা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সম্রাট হেরাক্লিয়াস > পারস্যের রাজা মুসির ইবনে সাওয়া । > মিসরীয় শাসক আল-মুকাওকিস। > ইথিওপিয়ার সম্রাট আশামা ইবনে আবজার। > ইয়েমেনের রাজপুত্র হিমায়ারি হরিথ, এবং হরিথ গাসানিকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। > শামের রাজ্যপালের কাছেও চিঠি পাঠিয়েছিলেন বিশ্বনবি। > স্যাসানীয় সাম্রাজ্যের শেষ মহারাজা খসরু পারভেজ বা কিসরা আবরুভেজ। যিনি ৫৭৯ সাল থেকে ৬২৮ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। নবি সাল্লাল্লাহু আলিইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছেও ইসলামের দাওয়াত নিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। যা সে ছিঁড়ে ফেলেছিল।
সে সময় ইয়েমেন নিযুক্ত শাসক বাযানকে হিজায থেকে মুহাম্মদকে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বন্দী করে আনার জন্য দুজন লোক পাঠানোর নির্দেশ দেন। এদিকে বিশ্বনবির দূত হজরত আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু ফিরে এসে বিশ্বনবিকে সব ঘটনা খুলে বললে তিনি মহারাজা খসরু পারভেজের ধ্বংসের প্রতিশ্রুতি দেন। পরবর্তীতে নিজ পুত্র দ্বিতীয় কাভাধ কর্তৃক খসরু পারভেজ মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত হন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এসব দাওয়াতি কার্যক্রম ব্যাপকভাবে হয়েছিল মদিনায় তাঁর পরিচালিত শাসন ব্যবস্থায় স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনার সময়। এ সময়টি ছিল ইসলামের দাওয়াত নিয়ে চিঠি ও প্রতিনিধি প্রেরণের শ্রেষ্ঠ সময়। আল্লাহ তাআলা তাঁকে যে মিশন নিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, এগুলো ছিল তার বহিঃপ্রকাশ। আল্লাহ তাআলা বলেন- তিনিই সেই মহান সত্ত্বা, যিনি তাঁর রাসুলকে পথ নির্দেশ ও সত্য জীবন ব্যবস্থা দিয়ে পাঠিয়েছেন; যাতে একে (সত্য ধর্ম ইসলামকে) সব ধর্ম তথা জীবন ব্যবস্থার উপর প্রবল করে দেন; যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।’ (সুরা সফ : আয়াত ১৯)