পুরোদমে শুরু হয়েছে পর্যটন মৌসুম। প্রতিবছর লাখ লাখ পর্যটক আসলেও বরাবরই অবহেলিত রয়ে যায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক থেকে শুরু করে টেকনাফের শাহপরিরদ্বীপ বদরমোকাম পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারেই অবস্থিত। পৃথিবীর আর কোথাও নেই এত দীর্ঘ রূপ-লাবণ্যের সৈকত। পর্যটন খাতের সিংহভাগ অর্থ আসছে কক্সবাজারের এই সৈকতকে ঘিরেই।
গত দুইদিন মৌসুমের শুরুতে ব্যাপক পর্যটক এসেছে কক্সবাজারে। কিন্তু অব্যবস্থাপনা-অবহেলা ও ভূমি দস্যুদের কবলে পড়ে প্রতিনিয়ত সৌন্দর্য হারাচ্ছে এই সৈকত। দীর্ঘতম এই সৈকত ঘিরে পর্যটন শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে কক্সবাজার। এখানে ডজন খানেক তারকা হোটেলসহ ৫০০ হোটেল-মোটেল ও রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠলেও যুগ যুগ ধরে তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি সৈকতে। গত এক সপ্তাহ ধরে সৈকতের ডায়াবেটিক পয়েন্ট থেকে ইনানী পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে সৈকতের বেহাল অবস্থা। অথচ এই সৈকতের আকর্ষণেই প্রতি বছর কক্সবাজার ভ্রমণ করেন লাখ লাখ পর্যটক। আর এই পর্যটন থেকেই জাতীয় অর্থনীতিতে যোগান হয় হাজার হাজার কোটি টাকা।
এই সৈকতে দাঁড়িয়েই অবলোকন করা যায় সূর্যাস্ত। দেখা যায় নীল সাগরের অথৈ জলরাশি। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার এলাকায় পর্যটকরা সৈকতের মেরিন ড্রাইভ দিয়ে উপভোগ করেন মহান আল্লাহর দেয়া অপরূপ সৌন্দর্য। সৈকতের বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে ভাঙন। উপড়ে গেছে শত শত ঝাউগাছ। নোংরা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে কোনো কোনো স্থানে। আর অবৈধ দখলে মøান হতে চলেছে সৈকতের সৌন্দর্য। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিটকট, ছাতা চেয়ার ও অপ্রয়োজনীয় ঘোড়ার বিচরণ এবং বাইকের উপদ্রবে কোন কোন সময় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন পর্যটকরা।
ডলফিন মোড়ের সৈকত থেকে সুগন্ধা পয়েন্ট পর্যন্ত এলাকায় লাইটিং ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিদিন চুরি ছিনতাইয়ের অভিযোগ রয়েছে। সৈকতে ওয়াশ রুম না থাকায় সমস্যা হয় এমন অভিযোগ পর্যটকদের। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকায় বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যটন এলাকার নোংরা পানি সৈকত দিয়ে সাগরে পড়ে। এছাড়াও কক্সবাজার থেকে ঢাকা, সৈয়দপুর, অতিরিক্ত বিমান ভাড়া থাকার কারণে পর্যটকরা সমস্যায় পড়ছেন। ইনানীতে হোটেল রয়েল টিউলিপ সোজা সৈকতে স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ করে নষ্ট করা হয়েছে সৈকতের সৌন্দর্য। এতে করে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতে বাঁধ দিয়ে দীর্ঘতম সৈকত দ্বিখ-িত করার বিষয়টি স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল এবং কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ পরিদর্শন করে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও সেই বাঁধ ঠিকই রয়েছে এখনো। তবে শুরু থেকে এই বাঁধের ব্যাপারে পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদ চলে আসলেও সংশ্লিষ্ট মহলের কানে যাচ্ছে না এই আওয়াজ।
কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন বলেন, সৈকতের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সৈকত রক্ষা ঠিকভাবে হচ্ছে না। কারণ সরকারি বিভিন্ন দফতর ও সংস্থার সমন্বয়হীনতার কারণে সৈকত উন্নয়নে জোরালো কোনো কাজ হচ্ছে না। ২০২১ সালে ৩৫টি দেশের নৌবাহিনীর একটি সমন্বিত যৌথ মহড়া কক্সবাজারে হওয়ার কথা ছিল। ওই মহড়া উপলক্ষে ইনানীতে সৈকত দ্বিখন্ডিত করে একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। ওই যৌথ মহড়া কর্মসূচি স্থগিত হয়ে গেলেও ওই বাঁধ রয়ে গেছে।
ইতোমধ্যে অনিয়ম করে ৭০০ একর বনভূমি লীজ দেয়ার বিষয়ে প্রতিবাদ করে আমরা সফল হয়েছি। দেশের সর্বোচ্চ আদালত ওই লীজ প্রক্রিয়া স্থগিত করে দিয়েছে। সৈকতের ওই বাঁধের ব্যাপারেও খুব দ্রুত আইনের আশ্রয় নেয়া হবে বলেও তিনি জানান। তিনি সৈকত রক্ষায় একটি সমন্বিত সৈকত সুরক্ষা জাতীয় কমিটি গঠন করার দাবি জানান।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস ও রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পর্যটন উদ্যোক্তা আলহাজ আবুল কাশেম সিকদার বলেন, এই মৌসুমে তারা আশানুরূপ পর্যটক কক্সবাজার আসবেন বলে আশা করছেন। তবে কিছু সমস্যার কথাও তুলে ধরে তিনি বলেন, ম্যানেজমেন্ট কমিটিতে হোটেল-মোটেল জোনের পর্যাপ্ত প্রতিনিধি না থাকায় সমস্যাগুলো যথাযথভাবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। যার কারণে কক্সবাজারে আগত পর্যটকরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তিনি বলেন, কলাতলীর ডলফিন মোড় থেকে হলিডে মোড় পর্যন্ত প্রায় আড়াই থেকে ৩০০ কোটি টাকা খরচ করে সরকার সড়ক উন্নয়ন কাজ করেছে। এখানে পর্যটকবাহী গাড়িগুলো অবাধ যাতায়াতের সুযোগ থাকার কথা থাকলেও ডলফিন মোড় এলাকায় দালাল ফরিয়াদের হাতে পর্যটকরা প্রতিনিয়ত হেনস্তার শিকার হচ্ছেন।
এছাড়াও কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নাজিরারটেক থেকে মহেশখালী সোনাদিয়া যাতায়াতের জন্য পর্যটকদের নিরাপত্তা ও আর্থিক বিষয়গুলো তদারকি হচ্ছে না। এখানেও পর্যটকেরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। একইভাবে কক্সবাজার থেকে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে যাতায়াতকারী পর্যটকদের হয়রানির শিকার হওয়ার খবর রয়েছে। এছাড়াও সেন্টমার্টিন পথে যথেচ্ছভাবে পর্যটকদের আনা নেয়া হচ্ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
কক্সবাজার বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব ও বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ম্যানেজার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সৈকত এখন অনেক ক্লিন। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি চমৎকার। পুরো এলাকা লাইটিং করা হয়েছে। লাবনী পয়েন্ট থেকে কলাতলী পর্যন্ত সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। পর্যটকরা সৈকতে সারারাত ঘুরে বেড়াতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। সৈকতের ঝাউবাগানসহ অব্যাহত ভাঙন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে জিও ব্যাগ দিয়ে ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
হোটেল শৈবাল সম্পর্কে তিনি বলেন, সর্বমোট ১৮৫ একর জমির উপরে দৃষ্টিনন্দন হোটেল শৈবাল প্রতিষ্ঠিত। তবে ইতোমধ্যে ক্রিকেট স্টেডিয়ামের জন্য ৫০ একর ভূমি ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সরকারি এই বিশাল সম্পদ একটি বেসরকারি সংস্থাকে নামমাত্র মূল্যে ছেড়ে দেয়ার কার্যক্রমটি এখন স্থগিত বলে জানান তিনি। কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের সুপারিন্টেন্ডেন্ট এসপি জিল্লুর রহমান বলেন, সৈকতে আইনশৃঙ্খখলা রক্ষায় ট্যুরিস্ট পুলিশ সতর্ক দায়িত্ব পালন করে চলেছে।