রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে ছয় শতাধিক যানবাহনকে মামলা দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন অনিয়মের কারণে ট্রাফিক সার্জেন্টরা সড়কে মামলা করছেন। মোটরসাইকেল চালকদের এই গ্যাঁড়াকলে পড়তে হচ্ছে বেশি। বর্তমান সড়ক পরিবহন আইনে জরিমানা বেড়ে গেছে, এ কারণে তাদের ওপর যেন অনেকটা মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরো চিত্র। মামলায় পেরে না উঠে হতাশা থেকে অনেকে নিজের মোটরসাইকেল রাস্তায় পুড়িয়ে ফেলছেন। গত ২৭ সেপ্টেম্বর বাড্ডায় ট্রাফিক সার্জেন্টের মামলার হাত থেকে বাঁচার আকুতি-মিনতি জানানোর একপর্যায়ে নিজের মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন শওকত আলম সোহেল নামের এক ব্যক্তি। এর আগে গত ২১ অক্টোবর পলাশী এলাকায় আনসারুল হক নিজের মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন। তার নামে আগে একটি মামলা ছিল। ট্রাফিক সার্জেন্ট গাড়ির কাগজপত্রে ত্রুটি দেখে নতুন করে একহাজার টাকার মামলা দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের বাহনে আগুন ধরিয়ে দেন ওই ব্যক্তি। লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম মোরশেদ বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে ব্যক্তিকে গত বৃহস্পতিবার জিজ্ঞাসাবাদ করার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। একটি মামলা থাকার পরও পরবর্তী সময়ে আরেকটি মামলা দেওয়ায় তিনি হতাশা থেকে মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন বলে পুলিশকে জানিয়েছেন।
ডিএমপি’র লালবাগ ট্রাফিক বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মেহেদি হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আইন অনুযায়ী কাজ করছি আমরা। বিভিন্ন সময় মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা সেন্টিমেন্ট তৈরির জন্য কিংবা ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে হতে পারে।’ উপ-পুলিশ কমিশনার মেহেদি হাসানের দাবি, ‘ভুক্তভোগী ব্যক্তি নিজের বিষয়গুলো ঠিকঠাকভাবে উপস্থাপন করতে পারলে আমরা অনেক ক্ষেত্রে ছাড় দেই। তবে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনা আমাদের জন্য বিব্রতকর। যদিও এ ধরনের কর্মকা-ে আমাদের ট্রাফিকিং কাজ বাধাগ্রস্ত হবে, এটা আমি মনে করি না।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ১ লাখ ৭২ হাজার ৯৬১টি মামলা করা হয়েছে, যার জরিমানা আসে ৩৯ কোটি ২৯ লাখ ৫৩ হাজার ৭২৫ টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৮৬০টি মামলা থেকে আদায় করা জরিমানা পরিমাণ ৩২ কোটি ১১ লাখ ৮৯ হাজার ৮৬১ টাকা। গত আগস্টে রাজধানীজুড়ে ১৯ হাজার ২১৪টি মামলা হয়। জুলাইয়ে এই সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ১৪২টি। জুনে রাজধানীতে মামলা হয় ২৫ হাজার ১০৫টি। মে মাসে তা ছিল ১৩ হাজার ৯০৬টি। এর আগে এপ্রিলে ২০ হাজার ৫৫৯টি, মার্চে ২৪ হাজার ৭৪৯টি, ফেব্রুয়ারিতে ২৫ হাজার ১২৫টি এবং জানুয়ারিতে ২৫ হাজার ১৬১টি মামলা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট স্বীকার করেছেন, মোটরসাইকেলে তুলনামূলক মামলা দেওয়া হয় বেশি। এর কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেন তিনি। মোটরসাইকেলে কেউ হেলমেট ছাড়া থাকলে দূর থেকে তা বোঝা যায়, এ কারণে মামলা হজম করতে হয় অনেককে। এখনও অনেকের ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায় না এবং কাগজপত্রে অনেক ধরনের ত্রুটি থাকে এমনকি কারও কারও কাছে মোটরসাইকেলের কাগজপত্র পর্যন্ত থাকে না। এছাড়া সিগন্যাল অমান্য করে হুটহাট চলে যাওয়াসহ অনেকের মধ্যে আইন মেনে না চলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ট্রাফিক সার্জেন্টরা লক্ষ্য করেছেন, অনেক ক্ষেত্রে প্রাইভেটকারের কাগজপত্র ও ফিটনেস সনদ আপডেট পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে মোটরসাইকেল চালকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে।
মোটরসাইকেল চালকেরা এখন বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে অবস্থান করেন। তাদের অনেকেই চুক্তিতে যাত্রী পরিবহন করছেন। এতে করে পুরো ভাড়া নিজের পকেটে রাখা যায়। কারণ অ্যাপভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় থাকলে সেই প্রতিষ্ঠানকে ভাড়ার ভাগ দিতে হয়। এ কারণে রাজধানীতে অদক্ষ চালকের সংখ্যা বেড়েছে। লালবাগ ট্রাফিক বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মেহেদি হাসান বলেন, রাজধানীজুড়ে মোটরসাইকেল চালকদের বেশিরভাগই অনেক ক্ষেত্রে আইন মানতে চায় না। তাদের মধ্যে সিগন্যাল অমান্য করে দ্রুত চলে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এসব কারণেই কিন্তু মামলা করা হয়। আর যা কিছু হচ্ছে, আইনের মধ্যে হচ্ছে।’ ডিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ট্রাফিক বিভাগের মামলা থেকে পাওয়া জরিমানার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা পড়ে। এখানে পুলিশ সদস্যদের কোনও লাভ নেই। সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখার মতো সরকারি দায়িত্ব পালনে আমরা মাঠে আছি।’