আল্লাহতায়ালা মানব জাতিকে অসংখ্য নিয়ামতে ভরপুর করে দিয়েছেন। এদের মধ্যে বড় নিয়ামতগুলোর একটি হলো শরিয়ত। একজন মানুষ এর যথাযথ অনুসরণ করলে সে দুনিয়াতে যেমন সফল হবে আখিরাতেও তেমনি সাফল্য লাভ করবে। তেমনি এই অনুসরণে যদি সঠিক পদ্ধতিটি মানা না হয় তাহলে তার দুনিয়া ও আখিরাত দু’টিই ব্যর্থ হবে। শরিয়ত কাকে বলে? আল্লাহর বিধিবিধান এবং নবীজী সা:-এর দেখানো পথই হলো শরিয়ত। একজন মানুষ যে পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করে সত্যিকারভাবে ইসলামের ওপর অবস্থান করতে পারে তাকে শরিয়ত বলতে পারি। আল্লাহ প্রদত্ত দলিলই শরিয়ত : আল্লাহ প্রদত্ত সব বিধিবিধানই শরিয়তের দলিল। সেই দলিল রাসূল সা:-এর দেখানো পদ্ধতি হলো শরিয়তে আইন। সেই দলিল ছাড়া শরিয়ত যেমন অচল, আবার রাসূল সা:-এর দেখানো পথ ছাড়া অন্য কারো দেখানো পথও অচল। সেই অচল শরিয়তের মনগড়া আমলও অচল, যার কোনো মূল্য নেই। শরিয়ত মানার আগে অবশ্য এর দলিল দেখব, দলিলের প্রমাণ দেখব, সে দলিল প্রমাণহীন হলে সাথে সাথে তা পরিহার করব।
আমাদের যত আমল হবে তা সেই দলিল অনুযায়ীই হওয়া চাই। এখন কাজ হবে আমি যা আমল করব বা করছি তা দলিল অনুযায়ী হচ্ছে কি না তা জেনে নেয়া। না জেনে আমল করলে সবই বৃথা হয়ে যাবে। এখন বই পুস্তক হাদিস কুরআন বাংলায় দোকানে দোকানে বিক্রয় হচ্ছে। একটু খোঁজ নিলেই হাতের নাগালে পাওয়া যায়। যেখানে বুঝবে না সেখানটা প্রশিদ্ধ আলেমকে দিয়ে দেখায়ে নিতে পারি। আর যদি পড়াশোনা না থাকে যারা শরিয়তের দলিল দ্বারা সিদ্ধান্ত দেন, তাদের জিজ্ঞেস করুন। আল্লাহ না জানলে জিজ্ঞেস করতে বলেছেন, ‘সুতরাং তোমরা যদি না জানো, তবে যারা কুরআন সুন্নতে অভিজ্ঞ তাদেরকে জিজ্ঞেস করো।’ ( সূরা নাহল-৩৪)
‘আপনার প্রতি যে ওহি নাজিল করা হয়, আপনি তারই অনুসরণ করুন।’ (সূরা ইউনুস-১০৯)
আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীজী সা:-এর প্রতি অনুরূপ আরো বহু কঠোর নির্দেশনা রয়েছে যে, আল্লাহ যাই নাজিল করেছেন শুধু তারই অনুসরণ করতে হবে। এমন কি রাসূল সা: ওহি ছাড়া শরয়ী বিষয়ে কোনো কথাও বলতেন না।
কেউ প্রশ্ন করলে জিবরাইল আ:-এর আগমনের জন্য অপেক্ষা করতেন। (বুখারি, হা-৪৬২৭) ‘কারণ আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি নাজিল না হওয়া পর্যন্ত তার নিজের পক্ষ থেকে কিছু বলার অধিকার ছিল না। তিনি তার উম্মতকে শরিয়ত হিসেবে যা কিছু দিয়েছেন তা সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে শেখানো অভ্রান্ত বিধান।’ (সূরা ইউসুফ-৬৮) এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করা যাবে না। ওই হাদিস প্রমাণ করেÑ তাবলিগ করলে, যেকোনো হাদিস বলি না কেন তা কোন হাদিস গ্রন্থে কত নম্বর হাদিস, কে বর্ণনা করেছেন ইত্যাদি পরিষ্কার করে বলতে হবে। কোনো ব্যক্তিই মনগড়া কোনো কথা হাদিস বলে চালিয়ে দিতে পারবে না। আবার সে হাদিসের অপব্যাখাও করতে পারবে না। সাহাবিদের সময়ে তারাও দলিল খুঁজতেন। কেউ কোনো হাদিস বললে তখনই তার দলিল তলব করতে বলতেন। ফলে কারো হাদিস জানা থাকলে হাদিস বলতে ভয় পেতেন। এ প্রসঙ্গে একটি চমৎকার হাদিস রয়েছে। আবু সাঈদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি বললেন, আমরা একদিন এক বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম, সেখানে আবু মুসা রা: আতঙ্কিত অবস্থায় উপস্থিত হলেন। আমরা বললাম, কী হয়েছে? তিনি বললেন, সেদিন আমি হজরত উমর রা:-এর বাড়িতে গিয়ে তিনবার সালাম দিলাম, উত্তর না পেয়ে চলে এলাম।
আজ দেখা হলে বললেন, হে আবু মুসা আমার কাছে আসতে সেদিন কে বাধা দিয়েছে। আমি বললাম, নবীজী সা: বলেছেন, কেউ যদি তিনবার অনুমতি চায় আর যদি না পায়, তাহলে সে যেন ফিরে আসে। উমর রা: বলেছেন তুমি তোমার কথার সাক্ষী হাজির করো, নইলে কঠিন শাস্তি দেবো। আবু সাঈদ খুদরি রা: বলেছেন, ‘তখন আমি গিয়ে সাক্ষী হলাম।’ (সহিহ মুসলিন, হা-২১৫, বুখারি, হা-৬২৪৫) পরে হজরত উমর রা: আবু মুসাকে ডেকে বললেন, ‘আমি তোমার প্রতি কঠোর হতে চাইনি। আমি আশঙ্কা করছিলাম লোকেরা রাসূল সা:-এর নামে মিথ্যা রচনা করছে কি না।’ (ইবনে মালেক)
শরয়ী বিষয়ে দলিল ছাড়া কথা বলা, আলোচনা করা, লেখা সবই নিষিদ্ধ। সাহাবায়ে কেরাম তাবেই, তাবেইন যেভাবে দলিলের ওপর স্থির ছিলেন সেভাবে আমরাও যদি তাদের অনুসরণ করি তাহলে ইসলামে শিরক বিদআত দূরীভূত হবে, মূল ইসলামে অবস্থান করতে পারব। দলিল তালাশ না করার কারণে শিরক-বিদআদ ছড়িয়ে পড়েছে : শরিয়ত বিলুপ্তির কারণ বিদআদ। আলোচনা বক্তৃতা খুতবা লেখালেখি দারস দলিল ভিত্তিক না হওয়ার কারণে বিদআদ সৃষ্টি হচ্ছে। নবীজী সা: জীবনকালে প্রত্যেক খুতবার বিদআত বিষয়ে হুঁশিয়ার করে বলতেন, ‘সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ কুরআন, সর্বোত্তম আদর্শ রাসূল সা:-এর আর্দশ আর সর্ব নিকৃষ্ট কাজ হলো বিদআত।’ (মুসলিম, হা-৮৬৭)। পরবর্তী যুগের লোকেরা এই হুঁশিয়ারি ভুলে গেছে। ফলে তারা কুরআন-সুন্নাহ থেকে ছিটকে পড়ছে। তাই অনেক মানুষ পথভ্রষ্ট দিকভ্রান্ত। এই ভ্রষ্টতার কাজে সব চেয়ে বেশি ইন্ধন জুুগিয়েছে এক ধরনের বক্তা। (বুখারি, হা-৭০৮৪) তারা দুনিয়ার ব্যবসাকে জমজমাট করার জন্য অসংখ্য জাল হাদিস তৈরি করেছে।
জাল হাদিস মুসলিম উম্মার ঐক্য নষ্ট করেছে: ইসলামকে ক্ষতিগ্রস্ত এবং মুসলিম উম্মাহকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করতে যা যা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে তার মধ্যে জাল জইফ হাদিস অন্যতম। মুসলিম ঐক্য বিনষ্টকারী, ইসলামকে ছোট করতে, বিভ্রান্ত করতে ইহুদি-খ্রিষ্টান চক্রের সাথে পথভ্রষ্ট অর্থলোভী কিছু আলেম এই কাজ করছে। জাল হাদিস তৈরি, প্রচার ও আমল করা হারাম।
সালাফে সালেহিনদের মানহাজের অনুসরণ করা : রাসূলুল্লাহ, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেই, তাবেইদের যুগের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সালাফ বলা হয়। রাসূল সা: তাদের যুগকেই স্বর্ণযুগ বলেছেন।’ (সহিহ বুখারি, হা-২৬৫২) ‘আল্লাহতায়ালা তাদেরকেই শ্রেষ্ঠ উম্মত বলেছেন’। (সূরা ইমরান-১১০) ‘তাই তাদের অনুসরণ করলে আমরাও হেদায়েত পাব’। (সূরা নিসার ১১৫ নং আয়াতে আল্লাহ সালাফদের মানহাজকে আঁকড়ে ধরা আবশ্যক করেছেন। (তাফসিরে ত্ববারি) সংক্ষিপ্ত হলেও বোঝা গেল, ঈমান-আকিদা-আমল, সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, আদব-আখলাখসহ মানব জীবনের সব ক্ষেত্রে সালাফে সালেহিনদের মানহাজের অনুসরণ করতে হবে। আকিদা কিংবা আমল সহিহ হলেই হবে না। মানহাজ সহিহ হতে হবে। অর্থাৎ সার্বিক জীবনে সালাফি মানহাজের অনুসরণ করতে হবে। সেই মানহাজেরই অনুসরণ করা ফরজ। ওই মানহাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কারণে মুসলিমরা অসংখ্য দলে বিভক্ত হয়ে গেছে। আল্লাহ আমাদের দ্বীনের সঠিক বুঝ ও আমল করার তাওফিক দিন। আমিন।