বাংলাদেশী ধনী ব্যবসায়ীদের বিদেশে পাড়ি জমানোর জোরালো হয়ে উঠেছে। গত কয়েক বছরে বিদেশে নিবাস গড়েছেন প্রচুর বাংলাদেশী উদ্যোক্তা। মূলত প্রযুক্তির সুবিধা কাজে লাগিয়ে বিদেশে বসেই দেশের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তারা। প্রয়োজন অনুযায়ী আসা-যাওয়ার মধ্যেও রয়েছেন। একাধিক পাসপোর্টের অধিকারী এসব ব্যবসায়ীর বড় একটি অংশের পরিবার-পরিজন এরই মধ্যে বিদেশে স্থানান্তর হয়েছে। যাদের পরিবার এখনো পুরোপুরি স্থানান্তরিত হয়নি, তাদের সন্তান-সন্ততি বিদেশে পড়াশোনার পর সেখানেই থেকে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। সন্তানদের এ আগ্রহে সাড়া দিয়ে শেষ পর্যন্ত তারা বিদেশেই পাড়ি জমাচ্ছেন। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে স্থিতিশীলভাবে উচ্চপ্রবৃদ্ধির দেখা পেয়েছে দেশের অর্থনীতি। শিল্প ও সেবাসহ অর্থনীতির প্রায় সব উপখাত স¤প্রসারিত হয়েছে নিয়মিতভাবে। তার পরও দেশের ধনী উদ্যোক্তাদের বড় একটি অংশ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। বাংলাদেশে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের দেশত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতটি জানতে বণিক বার্তা আলোচনা করেছে তৈরি পোশাক, আবাসন, ব্যাংক, শেয়ারবাজারসহ নানা শিল্প ও সেবা খাতের উদ্যোক্তা ও অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে। দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক চেম্বার থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাতের শিল্প সংগঠনের সদস্য, ব্যাংক মালিক, পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিকসহ অনেকের সঙ্গেই কথা বলা হয়েছে। এসব আলোচনার ভিত্তিতে ব্যবসায়িক সংগঠনসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া প্রাথমিক এক রক্ষণশীল হিসাব বলছে, তিন থেকে পাঁচ হাজার উদ্যোক্তা ও অতি ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বাংলাদেশের বাইরে এক বা একাধিক দেশে তাদের নিবাস গড়ে তুলেছেন। বাংলাদেশে ব্যবসা চালু থাকলেও বসবাসের ক্ষেত্রে পুরোপুরি দেশবিমুখ প্রবণতা তৈরি হয়েছে এ উদ্যোক্তাদের মধ্যে। কেউ কেউ আবার এরই মধ্যে বিদেশেও নতুন ব্যবসা শুরু করেছেন। দেশান্তরী এসব ব্যবসায়ী বসবাসের স্থান হিসেবে বেছে নিচ্ছেন কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দুবাই, হংকং, সিঙ্গাপুরসহ বড় বড় বাণিজ্যিক ও আর্থিক হাবকে।
শুধু ভারত নয়, গোটা এশিয়াতেই অন্যতম শীর্ষ ধনী মুকেশ আম্বানি। চলতি বছরই যুক্তরাজ্যে ৫ কোটি ৭০ লাখ পাউন্ড (৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ) ব্যয়ে বিলাসবহুল বাংলোসহ ভূসম্পত্তি কিনেছে তার মালিকানাধীন কোম্পানি রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ। এ সম্পদ ক্রয়ের খবরকে কেন্দ্র করে স¤প্রতি সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, সপরিবারে ভারত ছাড়ছেন মুকেশ আম্বানি। মুকেশ আম্বানি বর্তমানে সপরিবার বসবাস করছেন মুম্বাইয়ে। অ্যান্টিলিয়া নামে পরিচিত ২৭ তলাবিশিষ্ট এক বিলাসবহুল মেগাস্ট্রাকচারে। বলা হয়, বাড়িটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে অন্তত ২০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয়ে নির্মিত এ নিবাস ছেড়ে তার বিদেশে পাড়ি জমানোর খবরটি ছড়িয়ে পড়তেই শুরু হয় নানা গুঞ্জন। কেউ কেউ অভিমতও দিয়ে বসেন, বছরে কিছু সময় মুম্বাই ও বাকি সময় লন্ডনে অবস্থান করবেন মুকেশ আম্বানি। ব্যবসার দেখভালের জন্য স্বদেশে আসা-যাওয়ার মধ্যেই থাকবেন তিনি। বিষয়টি নজর কাড়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেরও। একপর্যায়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই এ বিষয়ে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রি। তাতে বলা হয়, মুকেশ আম্বানির সপরিবারে ভারত ত্যাগের খবরটি পুরোপুরি ‘ভিত্তিহীন’। যুক্তরাজ্যের সম্পত্তি কেনা হয়েছে স্রেফ ব্যবসায়িক কারণে।
মুকেশ আম্বানির ভারত ছাড়ার খবর সাধারণ পরিসরে কিছুটা বিস্ময় ছড়ালেও বিষয়টিকে স্বাভাবিক হিসেবেই দেখছেন অর্থনীতির পর্যবেক্ষকরা। গত কয়েক বছরে ভারতীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মধ্যে দেশত্যাগের প্রবণতা বেড়েছে। মরগান স্ট্যানলির এক পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশত্যাগ করেছেন ২৩ হাজার হাই-নেট-ওর্থ ইনডিভিজুয়াল (এইচএনডব্লিউআই বা ১০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ নগদ অর্থসম্পদের মালিক)। দেশটির অর্থনীতিবিদদের ধারণা, বর্তমানে এ সংখ্যা ৩৫ হাজারে পৌঁছেছে।
ধনাঢ্য উদ্যোক্তাদের ভারত ত্যাগের কারণ খুঁজতে গিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, গত কয়েক দশকে দেশটির অর্থনীতির আকার বহুলাংশে বেড়েছে। জিডিপির আকারের দিক থেকে বিশ্বব্যাংকের তালিকায় দেশটির অবস্থান উঠে এসেছে সপ্তমে। কিন্তু জনসাধারণের জীবনযাপনসংশ্লিষ্ট অনেক সূচকে অর্থনৈতিক এ উন্নয়নের কোনো ছাপই পড়েনি। এখনো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ সুবিধাসহ সার্বিক গণঅবকাঠামো, সংস্কৃতি ও পরিবেশ এবং সামাজিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার মতো অনেক সূচকেই বিশ্বের অন্য বড় অর্থনীতির দেশগুলোর তুলনায় যোজন যোজন পিছিয়ে ভারত। অর্থনৈতিক বৈষম্যের দিকগুলো সংক্রমিত হয়েছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিম-লেও। উন্নত জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধাদির অপর্যাপ্ততাই ভারতীয় ধনাঢ্যদের দেশের বাইরে ঠেলে দিচ্ছে। মহামারীর প্রাদুর্ভাবজনিত দুর্বিপাক বর্তমানে এ প্রবণতাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সর্বশেষ প্রকাশিত গ্লোবাল লিভ্যাবিলিটি ইনডেক্স প্রতিবেদনেও এর সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে বাসযোগ্যতার দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ শহরগুলোর মধ্যে রাজধানী ঢাকার অবস্থান চতুর্থ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ সুবিধাসহ সার্বিক গণঅবকাঠামো, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, সামাজিক নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতাসহ প্রতিটি সূচকেই পিছিয়ে ঢাকা। প্রায় একই অবস্থা অন্যান্য শহরের ক্ষেত্রেও।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের বসবাসযোগ্যতার সূচক যে খুব একটা ভালো না, সেটি ঠিক। এছাড়া বিদেশে অবস্থানকালে সেখানকার পাসপোর্ট থাকলে বাড়িসহ অন্যান্য সুবিধা পাওয়া সহজ হয়। যাদের সামর্থ্য আছে তারা পাসপোর্টের মাধ্যমে সে সুবিধাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করছেন। অনেক সামর্থ্যবানের সন্তানরা দেশের বাইরে পড়ালেখা করছে। পরবর্তী সময়ে সে সন্তানদের অনেকে থেকে যাচ্ছে। জীবনযাপনের মান, বসবাসযোগ্যতা, সন্তানদের কাছাকাছি থাকাÍএসব বিষয় এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। এছাড়া অনেকে হয়তো সামগ্রিকভাবে নিরাপত্তার প্রেক্ষাপটেও একটি বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করে রাখার তাগিদ বোধ করছেন। সামর্থ্য থাকায় অনেকেই স্বস্তিকর পরিস্থিতির পরিধি বাড়িয়ে রাখছেন। সাধারণ মানুষের বিকল্প সৃষ্টি করে রাখার সুযোগ নেই। অভিজাত শ্রেণীর এ সুযোগ যখন থাকে, তখন দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের জন্য চাপ সৃষ্টির পরিবেশ ব্যাহত হয়। শিক্ষা, বাসস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থা যে ক্ষেত্রই হোক না কেন অভিজাত ও সামর্থ্যবানদের আবাসস্থল যদি দেশের মধ্যে না থাকে, তাহলে উন্নয়নের চাপটা থাকে না। অভিজাতরা বৈশ্বিক হয়ে গেলে তখন এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভারতের ক্ষেত্রেও এখন দেখা যাচ্ছে, উন্নয়নের চাপ আসছে মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে।
দেশে বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তফসিলভুক্ত বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা ৪৩। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানিক উদ্যোগে গড়ে ওঠা এসব ব্যাংকের পরিচালকদের বড় অংশই ব্যবসায়ী। বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ থাকা এসব ব্যবসায়ীর সন্তানদের উল্লেখযোগ্য অংশ স্থায়ীভাবে বসবাস করছে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয়। অনেক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা বিদেশে স্থায়ী নিবাস গড়ছেন। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এমডিরাও এদিক থেকে পিছিয়ে নেই। ব্যাংক থেকে অবসর নিয়েই বিদেশে সন্তানদের কাছে স্থায়ী হচ্ছেন তারা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের (বিএবি) চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, বহুমুখী কারণে আমাদের দেশ থেকে ব্যবসায়ীরা বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এটিও মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে মানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। স্বাস্থ্যনিরাপত্তা তৈরি না হওয়া, বিষাক্ত পরিবেশ, ঘনবসতি, যানজট, মানসম্মত শিক্ষার অভাবে প্রতিটি সামর্থ্যবান নাগরিক তার সন্তানদের উন্নত দেশগুলোয় পাঠিয়ে দিতে চাচ্ছেন। এভাবেই দেশ থেকে মেধার বৃহৎ অংশ পাচার হয়ে যাচ্ছে। আবার যানজটের কারণে ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারাও এখন ঢাকায় আসতে চায় না। দেশের আবাসন খাতের বৃহৎ বেশ কয়েকটি কোম্পানির উদ্যোক্তারা এখন সপরিবারে বিদেশে বসবাস করছেন। তাদের কেউ কেউ দেশের বাইরে ব্যবসা স¤প্রসারণ করেছেন। আবার বাংলাদেশের ব্যবসাও চালু রেখেছেন বেশ জোরেশোরেই।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন মনে করছেন, অতিধনী উদ্যোক্তারা মূলত ব্যবসায়িক কারণেই বিদেশে চলে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, যাদের কথা বলা হচ্ছে; বাংলাদেশে এমন মানুষের অংশ খুবই কম। এটা হতেই পারে। সব দেশে এ ধরনের ঘটনা দেখা যাচ্ছে। ভারতে বেশি, চীনে আরো বেশি। চীনের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিয়েছে। পরে আবার দ্বৈত করের ঝঞ্ঝাটে অনেকে পাসপোর্ট সারেন্ডার করেছে। এছাড়া বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং এখনো সেভাবে হয়নি। ফলে দেখা যায়, সিঙ্গাপুর বা যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পাসপোর্টধারীদের জন্য ব্যাংক হিসাব খোলা অনেক কঠিন। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের পাসপোর্টধারী হলে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়। বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়া-আসাও অনেক সহজ হয়। এগুলো মাথায় নিয়েই অনেকে হয়তো বিকল্প পথটা গ্রহণ করছেন। বসবাসযোগ্যতার প্রেক্ষাপটও রয়েছে। বাংলাদেশ স্বাবলম্বী হওয়ার পথে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। একটা শ্রেণীর মধ্যে দুই পা দুই দিকে রাখার প্রবণতা কিছুটা থাকবেই। তবে এ অংশটা খুবই কম।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনেক বড় অবদান রেখেছেন সেখানকার বহিরাগত ব্যবসায়ীরা। তাদের অনেকেই বাইরে থেকে এসে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন। বর্তমানে বন্দরনগরী হয়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় ট্রেডিং হাব। এ অবস্থায় এখন অতীতের বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে চট্টগ্রামে। এখানকার ব্যবসায়ীদের অনেকেই এখন পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে। চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম মনে করছেন, ধনী ব্যবসায়ীরা যে কারণেই দেশত্যাগ করুক, তা বাংলাদেশ ও সংশ্লিষ্ট গন্তব্য দেশের আইনকানুনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হওয়া জরুরি।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে যাওয়া উদ্যোক্তাদের এখন বিনিয়োগ কোটায় রেসিডেন্সি বা দীর্ঘস্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ দিচ্ছে বেশকিছু দেশ। যেমন ইবি-৫ ক্যাটাগরিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিয়েছেন বেশকিছু বাংলাদেশী। কানাডা সরকারের তথ্য অনুযায়ী, মহামারীর আগে ২০০৬ থেকে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশটিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি (পিআর) পেয়েছেন ৪৪ হাজার ১৮৬ জন বাংলাদেশী। তাদের মধ্যে বড় একটি অংশ ছিলেন বিনিয়োগকারীরা। ব্যবসায়ীদের বিদেশে আবাসস্থল বেছে নেয়ার কারণ সম্পর্কে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি এবং আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এ ধরনের জনগোষ্ঠীর সংখ্যাটা খুব বেশি বলে মনে করি না। এ মানসিকতার নানা আঙ্গিক থাকতে পারে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে নানা জটিলতার মুখোমুখি হওয়ার বিষয় থাকতে পারে। ফলে যাদের টাকা আছে, তারা মনে করছে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডার মতো দেশের পাসপোর্ট নিয়ে রাখলে যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় চলে যাওয়া সম্ভব। এছাড়া আরো আছে সন্তানের শিক্ষা ব্যবস্থার সুবিধা। বাংলাদেশের লেখাপড়া আর যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থাও এক নয়। এ পরিস্থিতির মানে এই নয় যে দেশ বসবাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। বরং আমরা দেশের বসবাসযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। আগের চেয়ে পরিস্থিতি অনেক উন্নত হয়েছে। যেকোনো দেশে যখন উন্নয়ন হয়, যখন মানুষের হাতে টাকা-পয়সা আসে, তখন তারা দ্বিতীয় একটা বিকল্প রাখার চেষ্টা করে। যদিও জাতীয় প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে দেশের মানুষ দেশেই থাকা কাম্য। তার পরও সুযোগ-সুবিধার দিক বিবেচনা করেই বিকল্প হিসেবে অন্য দেশের কথা ভাবছেন কেউ কেউ। কিন্তু আসলে নিজ দেশের বিকল্প কখনো হয় না। উন্নয়নের একটা পর্যায়ে এ ধরনের প্রবণতা কিছুটা হয়েই থাকে। তবে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় তারা আবার ফিরেও আসে। এশিয়া-প্যাসিফিকের ফাইন্যান্সিয়াল ও এনার্জি হাব হিসেবে পরিচিত অঞ্চলগুলোও এখন দেশের ধনী ব্যবসায়ীদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান হয়ে উঠেছে। বিদেশীদের জন্য থাইল্যান্ডের রয়েছে ‘এলিট’ রেসিডেন্সি অফার। এ অফার অনুযায়ী, ওই দেশে বসবাস করতে বিদেশীদের প্রতি বছর কমপক্ষে ৩ হাজার ডলার খরচ করতে হবে। সেখানে বসবাসের জন্য সাতটি প্যাকেজ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্যাকেজটি হলো ২০ বছরের জন্য বসবাসের অনুমতি। এক্ষেত্রে ৬০ হাজার ডলার খরচ করতে হবে। এছাড়া আরো বিভিন্ন মেয়াদি কর্মসূচিও রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, দেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ঘটছে। বাড়ছে জাতীয় আয়ও। বৃদ্ধির এ হার নিচের ও মধ্যবর্তী স্তরের জনগোষ্ঠীর তুলনায় উচ্চস্তরে অনেক বেশি। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেশে রিটার্ন অন ক্যাপিটাল এবং রিটার্ন অন লেবারও অনেক বেশি। আবার বৃদ্ধির এ হারেও ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি ঘটছে। এখন তাহলে প্রশ্ন করা যায়, যেখানে রিটার্ন এত বেশি, সে জায়গা ছেড়ে বিদেশে চলে যাওয়ার কারণ কী? এক্ষেত্রে কেউ কেউ গণতন্ত্রহীনতা কিংবা নিরাপত্তাহীনতার মতো বিভিন্ন ধাঁধার কথা বলেন। আসলে বিষয়টি তেমন নয়। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সুস্পষ্ট কিছু কার্যকারণ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই এ দেশান্তর ও পুঁজির স্থানান্তর প্রক্রিয়া ঘটছে। সিঙ্গাপুর ও কোরিয়ার মতো দেশগুলোয় গণতন্ত্রের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে তো এ ধরনের দেশান্তর ও স্থানান্তর ঘটছে না। কারণ তারা আইন, নিয়মকানুন ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে পুরস্কার, শাস্তি ও নিয়মানুবর্তিতার চর্চা করছে। যেমন কোরিয়ায় চেবল গোষ্ঠীর সদস্য হয়েও স্যামসাংয়ের প্রধান নির্বাহীকে বিচারের সম্মুখীন হয়ে কারাবাস করতে হয়েছে।
তিনি আরো বলে, দেশে সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে ইকোনমিক ফ্যাক্টরের তুলনায় নন-ইকোনমিক অনেক ফ্যাক্টর বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রিটার্ন বাড়াতে হলে রিসোর্স ডিস্ট্রিবিউশন সিন্ডিকেটের অন্তর্ভুক্ত হতে হয়। অন্যথায় ওই গোষ্ঠীর কারো সমর্থন প্রয়োজন পড়ে। এটা আনুভূমিক ও উল্লম্ব্বÍদুই স্তরেই ঘটে। সব মিলিয়ে জোরজবরদস্তির মাধ্যমে সম্পদ লাভের একটি যজ্ঞ চলে। এসব কারণে উপস্বত্বজীবী (রেন্টিয়ার) এ শ্রেণী একসময় সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাদের পরবর্তী প্রজন্মও বিদেশে ভিন্ন সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠার কারণে দেশকে আর নিজের মনে করে না। তবে এত কিছুরও পরও দেশান্তরী ব্যক্তি নিজ ও পারিবারিক জীবনে সুখানুভূতি পায় না। কারণ একটা পর্যায়ে গিয়ে দেখা যায়, ওই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী না ঘরকা না ঘাটকা। একটা পর্যায়ে নিজেই নিজের জালে পর্যবসিত হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতেও (ইউএই) বিনিয়োগ কোটায় স্থায়ী আবাস গড়ছেন বাংলাদেশীরা। বিনিয়োগকারীদের জন্য ২০১৯ সাল থেকে ১০ বছরের আবাসিক ভিসা চালু করেছে দেশটি। এ ভিসা পেতে কমপক্ষে ১ কোটি দিরহামের সমপরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হয় দেশটিতে। এটি চালুর পর বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী ও ব্যাংক পরিচালক দুবাইয়ে গোল্ড কার্ড রেসিডেন্সি ভিসা পেয়েছেন।
সম্পদশালীদের দেশ ছাড়ার কারণ নিয়ে আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের অর্থনীতি বড় হয়েছে, কিছু মানুষ সম্পদশালী হয়েছে, কিন্তু জীবনযাত্রার মান বাড়েনি। উন্নত শিক্ষা বা চিকিৎসা তো দূরের কথা, দেশে ন্যূনতম মানসম্মত চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যবস্থাও নেই। দূষিত পরিবেশ, সীমাহীন যানজট আর অনিরাপদ খাদ্য ধনীদের দেশ ছাড়তে ভূমিকা রাখছে। আইনের শাসন ও সুশাসনের দিক থেকে আমাদের পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে।
ভারতের উন্নতিও অনেকটা বাংলাদেশের মতো হয়েছে বলে মনে করেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ভারতেও মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও সীমাহীন বৈষম্য বিদ্যমান। এ কারণে উভয় দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হলেও সেটি টেকসই পরিবেশ তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমার পরিচিত অনেক সৎ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক দেশ ছেড়েছেন। অথচ আশির দশকে এদের অনেকেই উন্নত দেশগুলোয় পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরেছিলেন। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী পাসপোর্টের অধিকারী হয়েও জাপানের ধনীরা দেশে থাকছেন। থাইল্যান্ডে সেনাশাসন চলছে। অথচ দেশটি থেকে বিত্তশালীরা চলে যাচ্ছেন, এমন কোনো ঘটনার কথা আমরা শুনিনি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, বসবাসযোগ্যতা ব্যক্তিগত রুচির বিষয়। একটি শ্রেণী আছে যারা দেশ থেকে চলে যেতে চায়। নিজে না গেলেও সন্তানকে বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে উৎসাহিত করে। সেটা কাম্য নয়। দেশকে ভালোবাসলে দেশেই থাকা উচিত। দেশের মধ্যেই সম্পদ গড়ে তোলা উচিত। কিন্তু যদি ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগের জন্য এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে তবে তা উৎসাহজনক। কারণ ব্যক্তি খাতে পুঁজির সঞ্চায়ন যথেষ্ট হয়েছে। সামর্থ্যবান বেড়েছে। উন্নয়নের স্বাভাবিক গতিতে বিনিয়োগকারী বেড়েছে, উদ্যোক্তা বেড়েছে। সে কারণে দেশের গ-ি পেরিয়ে বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ করতে চাইতেই পারে। অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ প্রবণতাকে আমি স্বাগত জানাই। কারণ এর মাধ্যমে দেশই লাভবান হবে।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে ধনাঢ্য উদ্যোক্তাদের দেশবিমুখ হয়ে ওঠার প্রধান কারণ সামাজিক ও জীবনযাপনসংশ্লিষ্ট সূচকগুলোয় পিছিয়ে থাকা। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সূচকে এখনো অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। জীবনমানসংশ্লিষ্ট অন্যান্য সূচকেও অবস্থা তথৈবচ। বৈশ্বিক বাসযোগ্যতা সূচকেও দেশের বড় শহরগুলোর অবস্থান একেবারে তলানিতে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও নাগরিক সংস্কৃতির দিক থেকে বাংলাদেশের চিত্র বিশ্বের ধনী ও উন্নত দেশগুলোর একেবারে বিপরীত। এছাড়া সড়ক যোগাযোগ ও পরিবেশের কারণে দেশী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিদেশী ক্রেতাদের মধ্যেও বাংলাদেশে আসা নিয়ে এক ধরনের অনীহা দেখা যায়।