আমরা প্রতিনিয়তই মহান আল্লাহ তায়ালার অবাধ্যতায় লিপ্ত হচ্ছি। গোনাহের পর গোনাহ করছি। দিন কেটে যাচ্ছে। হায়াতের সময়গুলো বরফের মতো গলে নিঃশেষ হয়ে আসছে, জীবনের সূর্যটা ডোবার অপেক্ষায় হলদে হয়ে আছেÑ তাও গোনাহ করেই চলেছি। বোধ হয়, কোনো কিছু পাওয়ার আশায় মরীচিকার দিকে দৌড়াচ্ছি। নিজেদের শুভ্র সফেদ নিষ্পাপ আত্মাগুলোকে তিলে তিলে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছি। প্রতিযোগিতায় মেতেছি নিজেদের ওপর অত্যাচারের, জুলুমের। মেতেছি আত্মনাশের প্রতিদ্বন্দ্বিতায়; কে নিজের ওপর কত অত্যাচার করতে পারে, সে প্রতিযোগিতায়, অন্যায়ের প্রতিযোগিতায়। কিন্তু দয়াময় আল্লাহর দরবারে দুই রাকাত সালাত পড়ে ক্ষমা চাওয়ার খানিক সময়ও আমাদের মেলে না! যেদিন মানুষের মুখে আল্লাহ তায়ালা মোহর মেরে দেবেন। যেদিন হাতগুলে কথা বলবে, পাগুলো সাক্ষ্য দেবে আমাদের কৃতকর্মের; সে দিনের অবস্থা কী হবে?
এভাবে আর হয় না! আমাদেরকে ফিরতেই হবে। যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, তাঁর কাছে। পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিতে পুরো জীবনের কৃতকর্মের। সে দিন সবার সামনে নিজের আমলনামা খুলে দেয়া হবে। আল্লাহ বলবেন, ‘তোমার আমলনামা তুমি পড়ো, তোমার হিসাব গ্রহণকারী হিসেবে আজ তুমিই যথেষ্ট।’ যাদের আমলনামায় পুণ্যের নিক্তি ভারী হবে, তারাই হবেন সফলকাম। আর যাদের আমলনামায় অমঙ্গলের নিক্তি ভারী হবে, তারা হবে চির ব্যর্থ ও অকৃতকার্য।
মানুষ ভুল করবেই এক. আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া সৃষ্টির পর সর্বপ্রথম হজরত আদম এবং হাওয়া আ: দু’জনকে সৃষ্টি করে জান্নাতে বাসস্থান দান করেন। জান্নাতে তাদেরকে যা ইচ্ছেÑ তাই খাবার স্বাধীনতা দেয়া হয়। তবে শুধু একটি গাছের ফল ভক্ষণ হতে বারণ করা হয়। অবশেষে শয়তান কল্যাণ-কামনার শপথ করে দু’জনকে প্রতারণায় ফেলে। এরপর হজরত হাওয়া আ: ও আদম আ: তার ফল খান। ফলে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে জান্নাত থেকে বের করে দেন। অতঃপর দু’জন আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করে বলেন, ‘হে আমাদের রব! অবশ্যই আমরা নিজেদের ওপর অত্যাচার করেছি, আপনি আমাদের ক্ষমা না করলে এবং আমাদের প্রতি দয়ার্দ্র না হলে নিঃসন্দেহে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ব’ (সূরাহ আল-আরাফ-২৩)। অবশেষে তারা এর প্রায়শ্চিত্ত ভোগের পর আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করে তাদেরকে ক্ষমা করে দেন।
এ থেকে বোঝা যায়, মানুষ মাত্রই ভুল করবে। যেখানে খোদ পৃথিবীর সর্বপ্রথম সৃষ্টি আদম আ: শয়তানের ধোঁকায় প্রতারিত হলেন, সেখানে আমাদের মতো লোকদের কথা বলা তো বাহুল্য ও নিরর্থক বৈ কিছু নয়। এ ঘটনায় আল্লাহর বিশেষ হিকমাহ ছিল। আদম আ: শয়তানের প্রতারণায় প্রতারিত হবেন তিনি তা অবশ্যই জানতেন। পৃথিবীতে অনাগত সব মানুষকে আল্লাহ তায়ালার শেখানোর অভিপ্রায় ছিল যে, সব মানুষই পাপ করবে, তবে ক্ষমা প্রার্থনা করার পর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন।
দুই. পাপ করা যেরূপ অন্যায়, তার চেয়ে বড় অন্যায় তার ক্ষমা না চাওয়া। কারণ, ভুল করা মানুষের মানবিক গুণ। সৃষ্টির শুরু থেকে এভাবেই চলে এসেছে। আর ভুল করে ক্ষমা না চাওয়া অজ্ঞতা অহঙ্কারী। তাই ভুল করার পর আল্লøাহর কাছে যে ফেরে সে-ই শ্রেয়। কুরআন কারিম এবং হাদিস শরিফে এরকম অসংখ্য বয়ান বিবৃত হয়েছে। সূরাহ আয-জুমারে এসেছে, ‘বলে দাও! ওহে যারা নিজেদের ওপর অত্যাচার করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হবে না, নিশ্চয় তিনি তোমাদের সব গোনাহ মার্জনা করে দেবেন; অবশ্যই তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াময়’ (সূরাহ আয-জুমার-৫৩)। এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার বেশ কয়েকটি প্রেক্ষাপট তাফসিরের গ্রন্থগুলোতে এসেছে। কিছু তাফসিরকারক বলেন, একদল মুশরিকের ব্যাপারে এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে। যখন তাদেরকে ইসলামের পথে আহ্বান করা হলো, তখন প্রত্যুত্তরে তারা বলল, আমরা তো শিরক করেছি, ব্যভিচারে লিপ্ত থেকেছি এবং অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করেছি। অথচ আল্লাহ তায়ালা এমন লোকদের ব্যাপারে জাহান্নামের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাহলে আমাদের ঈমান গ্রহণের পূর্বেকার কাজগুলোর সাথে ঈমান আমাদের কী কাজে আসবে? তখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। সূরাহ আত-তাহরিমে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আল্লাহর কাছে বিশুদ্ধ তাওবা করো, এতে আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিতে পারেন এবং এমন জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারেন; যার পাদদেশে বিভিন্ন ঝরনা প্রবাহিত হবে। যে দিন আল্লাহ তায়ালা নবী এবং তার সাথীদেরকে অপদস্ত করবেন না। তাদের নূর তাদের সামনে এবং ডানে ছড়িয়ে রবে। আর তারা বলবে, ‘হে আমাদের রব, আপনি আমাদের ওপর আপনার নূর পূর্ণ করুন এবং আমাদের ক্ষমা করে দিন।’ নিশ্চয়ই আপনি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান’ (সূরা আত-তাহরিম-৮)।
আনাস বিন মালিক রা: থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসূল সা: বলেন, ‘প্রতিটি আদম সন্তানই অপরাধী; তবে যারা অপরাধ করার পর তাওবা করে তারাই শ্রেষ্ঠ। (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)।
আমাদেরকে এখন প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করতে হবে এই মর্মে, কোনো ভুল অথবা পাপ হয়ে গেলে সাথে সাথেই দুই রাকাত সালাত পড়ে আল্লাহর কাছে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব এবং এ পাপ সামনে আর কখনো হবে না এ প্রতিজ্ঞা করব। তাহলে আল্লাহ আমাদের তাওবা গ্রহণ করে ক্ষমা করে দেবেন। এ ছাড়া সবসময় ইস্তিগফার তথা ক্ষমাপ্রার্থনা এবং আল্লাহর স্মরণে মশগুল থাকব। নিজের অজান্তে কখন কী গোনাহ হয়ে যাচ্ছে, অনেক সময় তা আমরা নিজেরাও আঁচ করে উঠতে পারি না। তাহলে সবসময় গোনাহমুক্ত থাকা সহজ হবে এবং যথাসাধ্য ইবাদতে সময় ব্যয় করার প্রতি বেশি সচেষ্ট থাকব। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সময়মতো তাওবা করার তাওফিক দান করুন। আমীন।শিক্ষার্থী : জামেয়া দারুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া, চট্টগ্রাম