আমরা অপ্রয়োজনে অভ্যাসের বশবর্তী হয়ে শয়তানের প্ররচণায় অপরের দোষচর্চা করে একটি মারাত্মক কবিরা গুনাহে লিপ্ত হই। এ যেন মাদক সেবনের মতো আমাদের সবার পরিত্যাগ অযোগ্য একটি অভ্যাস। সমাজের শান্তি শৃঙ্খলা ধ্বংস করতে এই অভ্যাসটিই যথেষ্ট। অন্যের দোষচর্চাকে বলে গিবত। আমাদের এখন প্রশ্ন জাগতে পারে গিবত কি? কোনো ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার এমন দোষত্রুটি বর্ণনা করা যা শুনলে সে (যার দোষ বর্ণনা করা হলো) অসন্তুষ্ট হয়, তাকে শরিয়তের পরিভাষায় গিবত বলে। অর্থাৎ এমন যেকোনো দোষ যা ওই ব্যক্তি প্রকাশ করতে চায় না তাহলে তা হচ্ছে গিবত। গিবতের পাশাপাশি আরো একটি জঘন্য কাজ প্রচলিত আছে। অনেকটা গিবতের সমপর্যায়ভুক্ত এমনকি গিবতের থেকেও মারাত্মক! তা হচ্ছে ‘অবপাদ’। অপবাদ হচ্ছে এমন সব দোষচর্চা যা ওই ব্যক্তির মধ্যে নেই। তাহলে মোট কথায় বোঝা গেল, উপস্থিত দোষ অগোচরে বলা গিবত এবং অনুপস্থিত দোষ অগোচরে বলা অপবাদ। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা:-এর কিছু হাদিস ও সাহাবায়ে কেরামের কিছু বাণী উল্লেখ করা হলোÑ
কোনো প্রয়োজনে একজন বেঁটে মহিলা রাসূলুল্লাহ সা:এর গৃহে এলেন। সে চলে যাওয়ার পর হজরত আয়শা রা: তার (আগত মহিলার) দৈহিক কাঠামো বেঁটে হওয়ার ত্রুটি বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘হে আয়শা তুমি ওই মহিলাটির গিবত করলে’। তিনি বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা: আমি বাস্তব ঘটনার বেশি কিছু বলিনি, অবশ্য আমি তার বেঁটে হওয়ার কথা বলেছি এবং এই ত্রুটি তার মধ্যে রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘হে আয়শা! যদিও তুমি সত্য কথা বলেছ কিন্তু তুমি তার ত্রুটি বর্ণনা করার তা গিবত হয়ে গেল’ (ফকিহ আবুল লাইস; বাবুল গিবত)।
হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিতÑ একদা রাসূলুল্লাহ সা: সাহাবাদের জিজ্ঞেস করলেন, গিবত কাকে বলে তা কি তোমরা জানো? সাহাবিরা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালো জানেন। আমরা জানি না ইয়া রাসূলুল্লাহ। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘তোমার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার সমালোচনা করা হলো গিবত, যা শুনলে সে অপছন্দ করবে।’ সাহাবা রা: আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা:, যদি সেই দোষ তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে তাহলেও কি গিবত হবে? তিনি বললেন, তুমি যদি কারো সত্যিকারের দোষ বর্ণনা করো তাহলে তা তো গিবত হয়ে গেল। আর যদি ওই দোষ তার না থেকে থাকে তাহলে তুমি তার ওপর মিথ্যা দোষারোপ করলে (যাকে বলে অপবাদ)। (ইমাম বাগাবির মাআলিমুত তানজিল) সহিহ মুসলিম : ৬২৬৫।
গিবত করার কারণ: মানুষ সবসময় নিজেকে বড় করে দেখে, এই আমিত্বের আরেক নাম আত্মপূজা। এটা শুরু হয়ে গেলে আত্মপ্রীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তখন তার আত্মত্যাগের মতো মহৎ বৈশিষ্ট্য দূরীভূত হতে থাকে। ফলে এ স্থানে দানা বাঁধে হিংসা-বিদ্বেষ। আবার হিংসা-বিদ্বেষ থেকেই অপরের প্রতি কুধারণার সৃষ্টি হবে, যা মানুষকে গিবত করতে বাধ্য করে। সুতরাং আত্মপূজা, আত্মপ্রীতি, হিংসা-বিদ্বেষ, কুধারণাই মানুষকে গিবত করতে বাধ্য করে। গিবতের ধরন দু’টি: এক হলো গিবত করা। আরেক হলো গিবত শোনা। উভয়ই গোনাহের কাজ। এরকম গোনাহের কাজ থেকে বিরত থাকার সহজ উপায় হলোÑ গিবত করতে মনে চাইলেই কুরআনের আয়াত ও রাসূল সা:-এর হাদিস মনে করা। যেমনÑ ‘মুমিনগণ, তোমরা বেশি বেশি ধারণা করা থেকে বেঁচে থাকো। নিশ্চয় কতক ধারণা গোনাহ এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারো পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণাই করো। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু’ (সূরা হুজুরাত-১২)। ‘প্রত্যেক পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর দুর্ভোগ’ (সূরা হুমাজা-১)।
গিবতের ভয়াবহতা: রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘মিরাজকালে আমি এমন কিছু লোকের কাছ দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের নখগুলো পিতলের তৈরি, তারা তা দিয়ে তাদের মুখম-ল ও বক্ষগুলোকে ছিঁড়ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা হে জিবরাইল? তিনি বললেন, এরা তারাই যারা মানুষের মাংস খেত (গিবত করত) এবং তাদের ইজ্জত-আব্রু বিনষ্ট করত’ (আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ)। গিবত কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। গিবতের পাপ সুদ অপেক্ষা বড়; বরং হাদিসে গিবতকে বড় সুদ বলা হয়েছে (সহিহ আৎত তারগিব)।
গিবতের পরিণাম: ১, গিবত ইসলামী শরিয়তে হারাম ও কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। কেউ গিবত শুনলে তার অনুপস্থিত ভাইয়ের পক্ষ থেকে তা প্রতিরোধ করবে সাধ্যমতো। আর যদি প্রতিরোধের শক্তি না থাকে তবে তা শ্রবণ থেকে বিরত থাকবে। কেননা, ইচ্ছাকৃতভাবে গিবত শোনা ও এর অনুমোদন দেয়া নিজে গিবত করার মতোই অপরাধ (ইমাম আন-নাওয়াবি : হিফজুল লিসান)।
রাসূল সা: একবার লোকদের ডেকে বলেন, ‘হে মানুষেরা, যারা মুখে মুখে ঈমান এনেছ এবং ঈমান যাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি, অপর মুসলিমের গিবত করো না, অন্যের দোষত্রুটি অন্বেষণ করো না, কারণ যে অন্যের দোষত্রুটি অন্বেষণ করে বেড়ায়, আল্লাহ তার দোষ অন্বেষণ করেন, আর আল্লাহ যার দোষ অন্বেষণে লেগে যান তিনি তাকে তার ঘরের মধ্যেই অপমান করে ছাড়েন’ (সুনানে আবু দাউদ-৪৮৬২, তিরমিজি-১৬৫৫)।
গিবত থেকে বেঁচে থাকার উপায়: গিবত থেকে বেঁচে থাকা অত্যন্ত জরুরি। এ থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছেÑ ১. আমাদের উচ্চারিত প্রতিটি কথা ফেরেশতারা লিপিবদ্ধ করছে এই বিশ্বাস এবং সচেতনতা জাগ্রত রাখা। এমন একটি শব্দ কেউ উচ্চারণ করে না যা একজন (ফেরেশতা) দেখছে না এবং লিখে নিচ্ছে না (সূরা কাফ-১৮)।
২. অপর মুসলিম ভাইয়ের কল্যাণ কামনা করা এবং তার জন্য আত্মত্যাগ করা। অর্থাৎ যেকোনো প্রয়োজনে অপর ভাইকে অগ্রাধিকার দেয়া। যেমনÑ আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘তারা নিজের ওপর অন্যদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তারা অনটনের মধ্যে থাকে’ (সূরা হাশর-৯)। ৩. অপরের অপরাধকে ক্ষমা করে দেয়া। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিতÑ রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন রাখবে আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন’ (সহিহ মুসলিম-২৬৯৯)। ৪. আমাদের সবসময় আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে তিনি যেন অনুগ্রহ করে গিবতের মতো জঘন্য সামাজিক ব্যাধিতে আমাদের নিমজ্জিত হতে না দেন। এ ক্ষেত্রে জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সর্বাগ্রে। কেননা, রাসূল সা: বলেছেন, ‘বান্দা যখন ভোরে নিদ্রা থেকে জাগ্রত হয় তখন শরীরের সব অঙ্গ জিহ্বার কাছে আরজ করে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহর নাফরমানি কাজে পরিচালিত করো না। কেননা, তুমি যদি ঠিক থাকো, তবে আমরা সঠিক পথে থাকব। কিন্তু যদি তুমি বাঁকা পথে চলো, তবে আমরাও বাঁকা হয়ে যাবো’ (তিরমিজি-২৫১৮, আহমাদ-৩/৯৫-৯৬)। একটি দীর্ঘ হাদিসে মুয়াজ ইবনে জাবাল রাসূল সা:-এর কাছে এমন একটি কাজের কথা জানতে চান যা তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে। এই হাদিসের অংশবিশেষে রাসূল সা: বলেন, ‘হে মুয়াজ, জিহ্বার কুফলের চেয়ে খারাপ এমন আর কোনো জিনিস আছে যা মানুষকে মুখ উপরে ছেঁচড়ে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার কারণ হবে?’ (তিরমিজি-২৬১৬, ইবনে মাজাহ-২৯৭৩, আহমাদ-৫/২৩১০) রাসূল সা: অন্যত্র বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার জন্য তার জিহ্বা ও লজ্জাস্থানের জিম্মাদার হবে, আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হবো’ (বুখারি-১১/৩০৮)। লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা