পাপিকে একদিন তার পাপের শাস্তি ভোগ করতে হবে। এ শাস্তি কেউ ভোগ করবে ইহকালে, কেউ ভোগ করবে পরকালে। আল্লাহ তায়ালা কাউকে স্বীয় দয়ায় ক্ষমাও করে দিতে পারেন। পার্থিব জগতে কোন পাপের কি শাস্তি হয় এ প্রসঙ্গে মুফাসসির সম্রাট হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেছেন, ১. কোনো জাতির মধ্যে আত্মসাৎ বৃদ্ধি পেলে সে জাতির লোকদের অন্তরে ভয়ের সঞ্চার করা হয়। ২. কোনো জাতির মধ্যে ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়লে সেখানে মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়। ৩. কোনো সম্প্রদায়ের লোকেরা পরিমাপ ও ওজনে কম দিলে তাদের রিজিক সঙ্কুচিত করা হয়। ৪. কোনো জাতির লোকেরা অন্যায়ভাবে বিচার-ফায়সালা করলে তাদের মধ্যে রক্তপাত বিস্তৃতি লাভ করে। ৫. কোনো জাতি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে আল্লাহ শত্রুদেরকে তাদের উপর চাপিয়ে দেন। (মুয়াত্তা মালেক, হাদিস-১৩২৩) আজ পৃথিবীতে অশান্তি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দাবানল, করোনাভাইরাস ইত্যাদি সবই অপকর্মের ফসল। আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতেই কিঞ্চিত নমুনা দেখাচ্ছেন।
অন্যের মাল আত্মসাৎ করা : আত্মসাৎ করা মারাত্মক গুনাহ ও জঘন্য অপরাধ। মালিক ক্ষমা না করলে এ গুনাহ আদৌ ক্ষমা হবে না। তাকে অবশ্যই জাহান্নামের অনলে জ্বলতে হবে। হজরত জায়েদ ইবনে খালিদ জুহানি রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, খায়বার যুদ্ধে জনৈক ব্যক্তি কোনো দ্রব্য আত্মসাৎ করে। পরে সে মারা গেলে মহানবী সা: তার জানাজা পড়াননি। সাহাবিদের বললেন, তোমাদের এ সঙ্গী আল্লাহর পথের সম্পদ আত্মসাৎ করেছে। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা তার জিনিসপত্র তল্লাশি করে তাতে একটি রেশমী বস্ত্র পেলাম যার মূল্য হবে দুই দিরহাম। (জামে তিরমিজি, মিশকাত, পৃ-২৪২)
ব্যভিচার করা : ব্যভিচারের শাস্তি ভয়ানক। হাদিস শরিফে রয়েছেÑ ব্যভিচারের মন্দ পরিণাম ছয়টি। তিনটি দুনিয়ায়, আর তিনটি আখিরাতে। দুনিয়ার তিনটি হলোÑ ১. সৌন্দর্য নষ্ট হওয়া; ২. দরিদ্র্যতা; ৩. অকাল মৃত্যু। আর আখিরাতের তিনটি হলোÑ ১. আল্লাহর অসন্তুষ্টি; ২. হিসাব-নিকাশের কঠোরতা এবং ৩. জাহান্নামের কঠিন শাস্তি। (ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ, ইফা, পৃ-১০৯)
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তীও হয়ো না। কারণ, তা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ। (সূরা বনি ইসরাইল-৩২) রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘কোনো বান্দা যখন ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তখন তার ভেতর থেকে ঈমান বেরিয়ে যায় এবং এটি তার মাথার উপর মেঘখ-ের মতো ভাসতে থাকে। অতঃপর সে যখন তাওবা করে, তখন ঈমান পুনরায় তার কাছে ফিরে আসে।’ (সুনানে আবু দাউদ, কিতাবুস সুন্নাহ, হাদিস নং-৪৬৯০)
ওজনে কম দেয়া : পরিমাপে ও ওজনে কম দেয়া নিষেধ। এটি জঘন্যতম খিয়ানত ও গুনাহে কবিরা। এর ফলে আল্লাহ তায়ালা ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দেন এবং দুর্ভিক্ষ ঘটান। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়, যারা লোকের কাছ থেকে ওজন করে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে আর যখন মানুষকে মেপে কিংবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।’ (সূরা মুতাফফিফিন : ১-৩)। মহানবী সা: যখন হিজরত করে মদিনায় যান, তখন সেখানে আবু জুহায়লা নামক এক ব্যবসায়ী ছিল। তার দোকানে ছিল দু’টি পাল্লা। একটি দিয়ে সে অন্যের জিনিস মেপে রাখত, আরেকটি দিয়ে মানুষকে মাল মেপে দিত। তারই প্রসঙ্গে উল্লিখিত আয়াতটি নাজিল হয়। রাসূলুল্লাহ সা: একদা পরিমাপকারী ও দাঁড়িপাল্লা দ্বারা ওজনকারী ব্যবসায়ীদেরকে বললেন, তোমাদের ওপর এমন দু’টি জিনিসের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, যে জিনিসদ্বয়ের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করার কারণে তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতরা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।’ (সুনানে তিরমিজি)
বিচারে ইনসাফ না করা : অন্যায়, দুর্নীতি ও অসততা সর্বদা হারাম ও মারাত্মক অপরাধ। বিচারক সেজে বিচারকার্যে দুর্নীতি করা আরো জঘন্য অপরাধ। বিচারককে ইনসাফ ও সততা অবলম্বন করা অপরিহার্য। মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে শাসক আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুসারে বিচার করে না, আল্লাহ তার নামাজ কবুল করেন না।’ (হাকিম) তিনি আরো বলেন, এক শ্রেণীর বিচারক জান্নাতে যাবে, আর দু’শ্রেণীর বিচারক জাহান্নামে যাবে। যে বিচারক জান্নাতে যাবে, সে হলোÑ এমন বিচারক যে সত্য ও ন্যায়কে যথার্থ উপলব্ধি করে এবং তদনুযায়ী বিচার করে। পক্ষান্তরে, যে বিচারক সত্যকে যথার্থ উপলব্ধি করেও ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যায় রায় প্রদান করে, সে জাহান্নামি। তদ্রƒপ যে বিচারক সত্যকে যথার্থ উপলব্ধি না করে স্বীয় ইচ্ছানুযায়ী রায় দেয়, সেও জাহান্নামি।’ (সুনানে আবু দাউদ)
প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা : প্রতিশ্রুতি করলে তা পূরণ করা আবশ্যক। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা নিষেধ ও গুনাহে কবিরা। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা অঙ্গীকার পূরণ করো। কেননা, প্রতিশ্রুতি পূরণের বিষয়ে তোমাদের কাছে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল-৩৪) মহানবী সা: বলেন, ‘যার মধ্যে আমানতদারি নেই, তার মধ্যে ঈমান নেই। অনুরূপ যে ব্যক্তি অঙ্গীকার রক্ষা করে না, তার মধ্যে দ্বীন নেই।’ (বায়হাকি, মিশকাত, পৃষ্ঠা-১৫)
হিংসা করা : হিংসা নেকসমূহকে ধ্বংস করে দেয়। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা, হিংসা পুণ্যকে এমনভাবে বিনষ্ট করে দেয়, যেমনিভাবে আগুন কাঠকে ভস্মীভূত করে দেয়।’ (আবু দাউদ) তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে (এক সময়) পূর্ববর্তীদের নৈতিক ব্যাধি বিস্তার লাভ করবে, আর তা হলো হিংসা ও বিদ্বেষ।’ (জামে তিরমিজি) হিংসা থেকে বেঁচে থাকা ফরজ। কারণ, তা এমন নীরব অনল যা ক্রমে ক্রমে জ্বলে উঠে এবং মানুষের নেকসমূহকে ধ্বংস করে দেয়। অথচ মানুষের কোনো খবরই থাকে না যে, তার নেকসমূহ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
সুদ ও ঘুষ খাওয়া : ‘সুদের ৭০ প্রকার গুনাহ রয়েছে। তন্মধ্যে নি¤œতম গুনাহ হলো স্বীয় মাকে বিয়ে করা।’ (বায়হাকি, মিশকাত, পৃষ্ঠা-২৪৬) আর সর্বোচ্চ গুনাহ হলো আল্লাহর সাথে জিহাদ করা। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যারা সুদ খায় (বিচার দিবসে) তারা সে ব্যক্তির ন্যায় দাঁড়াবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দিয়েছে।’ (সূরা বাকারা-২৭৫)। ঘুষ আদান-প্রদান করা লানতযোগ্য কাজ। মহানবী সা: ইরশাদ করেন, ‘ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়ের প্রতি আল্লাহ তায়ালার লানত।’ (আন-নিহায়া ফি গারিবিল হাদিস, আল্লামা ইবনুল আছির র., দ্বিতীয় খ-, পৃষ্ঠা-২২৬)
মদ পান ও জুয়া খেলা : মদ পান ও জুয়া খেলা উভয় শয়তানের কাজ। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তি পূজার বেদি ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্যবস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো, তাহলেই তোমরা সফলকাম হতে পারবে।’ (সূরা আল মায়িদা-৯০)
মজুতদারি ও কালোবাজারি : মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে খাদ্যদ্রব্য মজুদ রাখা এবং কালোবাজারি সম্পূর্ণরূপে হারাম। মহানবী সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমান হয়েও খাদ্যশস্য আটকিয়ে রাখে (মজুতদারি করে) আল্লাহ তায়ালা তার ওপর মহামারী ও দারিদ্র্যতা চাপিয়ে দেন।’ (ইবনে মাজাহ ও বায়হাকি, মিশকাত, পৃষ্ঠা-২৫১)
চুরি করা : চুরি করা জঘন্য অপরাধ। চুরি সমাজের শান্তি থেকে বিদূরিত করে। এর শাস্তি হলোÑ কবজি পর্যন্ত হাত কেটে দেয়া। যেমন আল্লাহর বাণী, ‘পুরুষ চোর ও মহিলা চোর অপরাধের শাস্তি স্বরূপ উভয়ের হাত কবজি পর্যন্ত কেটে দাও।’ (সূরা মায়িদা-৩৮) ডাকাতি, ছিনতাই, লুটপাট ইত্যাদি চুরি অপেক্ষা গুরুতর অপরাধ। কারণ, চুরি হয় গোপনে। আর ডাকাতি, ছিনতাই ও লুটপাট হয় প্রকাশ্যে। এদের শাস্তি হলোÑ হত্যা, শূলে চড়ানো, হাত-পা কেটে ফেলা ও দেশ থেকে বহিষ্কার করা। মহানবী সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে লুটপাট করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (আবু দাউদ, মিশকাত, পৃষ্ঠা-৩১৩)
লেখক: প্রধান ফকিহ, আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী