দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাণিজ্য সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করে যাচ্ছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। বিষয়টি নিয়ে দ্বিপক্ষীয় সভাগুলোয়ও বেশ আলোচনা হচ্ছে। পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, জিএসপি নিয়ে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া প্রায় সব শর্তই পূরণ করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু দিন শেষে শ্রমিক অধিকার নিয়ে আরো অনেক কিছু করার আছে বলে জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘায়িত করা হয়েছে। নীতি সুবিধার প্রসঙ্গ এলেই মার্কিনরা শ্রম অধিকারের পাশাপাশি মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের মতো বিষয়গুলো টেনে নিয়ে আসছে। এতে এসব বিষয়ও এখন বাণিজ্য সুবিধা নিয়ে দরকষাকষির অংশ হয়ে উঠেছে।
সর্বশেষ মানবাধিকার ইস্যুটিও দেশের বাণিজ্য নীতি সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম। তিনি বলেন, বাণিজ্য নীতি সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হলেও নানামুখী বাধায় সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশের বাণিজ্যে সাম্প্রতিক ইস্যুটির সরাসরি কোনো প্রভাব নেই। তবে তা জিএসপি সুবিধার মতো বাণিজ্যনীতি সহায়তা আদায়ের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
অনেকটা একই বক্তব্য বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের। তিনি বলেন, মানবাধিকার ইস্যুটি কিছু প্রভাব ফেলবেই। তবে এক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কোনো হঠকারিতা দেখা যাবে না, যদি না কোনো আন্তর্জাতিক রাজনীতির চাপ থাকে। তবে যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার ইস্যুটিকে সামনে এনে আমাদের জন্য বিভিন্ন রকমের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ কখনই যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছামাফিক তাঁবেদারের ভূমিকা নেবে না। আমরা কখনই মনে করি না যে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের কোনো সহায়তা দেবে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা বিপর্যয়টি ছিল মূলত পোশাক খাতের। মার্কিন বাজারে পোশাক খাতের তখন জিএসপি সুবিধা ছিল না। কিন্তু অন্যান্য খাতের জন্য জিএসপি প্রত্যাহার হলো কেন? আমি বলতে চাচ্ছি, বাংলাদেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ মানসিকতা নিয়ে থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের যা দরকার সবই দেবে। সেক্ষেত্রে মানবাধিকার বা অন্য কোনো ইস্যুই ইস্যু না।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন সরকারি প্রতিনিধিরাও। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, সর্বশেষ মানবাধিকার ইস্যুটি ভবিষ্যৎ বাণিজ্য নীতি সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতেই পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাণিজ্যে সরাসরি প্রভাব ফেলার কোনো ক্ষেত্র দৃশ্যমান হয়নি। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে এখন কোনো ধরনের অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা দিচ্ছে না। ফলে এ মুহূর্তে বাজার প্রবেশাধিকার বন্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। তবে ইইউ বেঁকে বসতে পারে। মানবাধিকার নিয়ে অভিযোগ ওঠার কারণে ইউরোপীয় রাষ্ট্রজোটটি অগ্রাধিকার বাণিজ্য সুবিধা নিয়ে গড়িমসিও করতে পারে। বাংলাদেশ এখন জিএসপি প্লাস সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে। বর্তমান নিষেধাজ্ঞার কারণে বিষয়টি নিয়ে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমস্যা হতে পারে। যদিও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক হাফিজুর রহমান মনে করছেন, আপাতত এর কোনো প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, সরাসরি প্রভাব পড়ার কোনো সুযোগ নেই। বাণিজ্য নীতিসংক্রান্ত বিষয়েও সরাসরি প্রভাবের সুযোগ নেই। তার পরও আমরা বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে দেখছি।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এলডিসিভুক্ত দেশ হিসেবে এতদিন অনেক ধরনের রেয়াত পেয়ে এসেছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে মূলত একপক্ষীয় সুবিধাই পাওয়া গিয়েছে বেশি। কিন্তু যখনই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাবে, তখন দুই ডজনের বেশি কনভেনশন সই করতে হবে ও মানতে হবে। তখন বাংলাদেশ আর কোনো ছাড় পাবে না। এরই মধ্যে ইইউ মানবাধিকার ইস্যুটি নিয়ে নানা বক্তব্য দেয়া শুরু করেছে। অঞ্চলটির সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির শুরুতেই মানবাধিকারের বিষয়টি বলা হয়েছে। সামনের দিনগুলোয় ইউরোপীয় রাষ্ট্রজোটটির সঙ্গে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ পদক্ষেপটি নতুন অনুষঙ্গ হিসেবে যুক্ত হতে পারে।
এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, বাইডেন প্রশাসন এরই মধ্যে মানবাধিকার ইস্যুটি সামনে এনে চাপ দিতে শুরু করেছে। এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নও আস্তে আস্তে সেই দিকে যাবে। তারা একটি অভিন্ন কাঠামো উন্নয়ন করছে। অর্থাৎ যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সমস্যা, তা ইউরোপের জন্যও সমস্যা হতে পারে। এতে আমাদের জন্য জটিলতা সৃষ্টি হবে। বিষয়টি বাংলাদেশের মতো ব্যবসা-বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতির জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ফলে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। এখনই পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ আছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে সে পদক্ষেপগুলো নিতে হবে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে গত ১০ ডিসেম্বর দেশের এক প্রতিষ্ঠান ও সাত ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে এখন পর্যন্ত এর সরাসরি কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। তবে সামনের দিনগুলোয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের বাণিজ্য সুবিধা আদায় করে নেয়ার ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষ করে দেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে এখন এ নিয়ে দুশ্চিন্তা বেশি। তারা বলছেন, এ পর্যন্ত দেশের পোশাক রফতানি খাত সম্প্রসারিত হয়েছে মূলত ক্রেতা দেশ ও অঞ্চলগুলোর বাণিজ্য সহায়তাকে কাজে লাগিয়ে। যদিও মার্কিন বাজারের অগ্রাধিকার বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) এক্ষেত্রে বড় কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। দেশটিতে পোশাক রফতানির বাজার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে প্রধান প্রভাবক ছিল অনুন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জন্য দেয়া কোটা সুবিধা। জিএসপি সুবিধা কাজে লাগিয়ে বাজার বড় হয়েছে প্রথমে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ)। এরপর অন্যান্য ক্রেতাদেশও জিএসপি দিয়েছে। মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের জন্য ক্রেতাদেশগুলো থেকে বাণিজ্য সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। তবে বর্তমান নিষেধাজ্ঞার কারণে সামনের দিনগুলোয় ইইউসহ আরো কয়েকটি দেশ থেকে এ ধরনের সুবিধা আদায় কঠিন হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অর্থমূল্য বিবেচনায় বাংলাদেশের মোট রফতানির ৬৩ শতাংশই যায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউতে। সামনের দিনগুলোয় রফতানির এ বাজার ধরে রাখতে হলে মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের দেয়া সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে অনেক বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োজন বলে মনে করছেন অর্থনীতির পর্যবেক্ষকরা। তাদের ভাষ্যমতে, মানবাধিকার ইস্যুকে সামনে নিয়ে এলেও যুক্তরাষ্ট্রের আসল উদ্দেশ্য কী, সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি ও কূটনীতিতে অনেক কিছুই পরোক্ষভাবে বলা হয়। এক ধরনের পদক্ষেপের সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয়ের সংযোগও দেখা যায়। এক্ষেত্রে মানবাধিকার এমন এক ইস্যু, যার সঙ্গে সহজেই যেকোনো নীতি ইস্যু টেনে নিয়ে আসা সম্ভব। বিষয়গুলো নিয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সতর্কতা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক পরিম-লে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়ন। অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র ও মহাদেশীয় রাষ্ট্রজোটটির দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় এক। এ কারণে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইইউকে নিয়েও কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে।