ঈমানের পূর্বশর্ত হলো কিয়ামতের দিনের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা, যাকে আমরা মহাবিচারের দিন হিসেবেও চিনি। যেদিন মহান আল্লাহর রহমত ছাড়া কারো কোনো উপায় নেই। যেদিন মহান আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। সেদিন যারা মহান আল্লাহর ক্রোধের সম্মুখীন হবে, তাদের বড় দুর্ভাগা আর কেউ নেই। আজ আমরা আলোচনা করব এমন কিছু কাজ নিয়ে, যেগুলোর কারণে মহান আল্লাহ রাগান্বিত হন। যারা এগুলোতে লিপ্ত হবে, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে থাকবেন। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন যে কিয়ামতের দিন আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হব। এক ব্যক্তি, যে আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করল। আরেক ব্যক্তি, যে কোনো আজাদ মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করল। আর এক ব্যক্তি, যে কোনো মজুর নিয়োগ করে তার থেকে পুরো কাজ আদায় করে এবং তার পারিশ্রমিক দেয় না। (বুখারি, হাদিস : ২২২৭)
উল্লিখিত হাদিসে রাসুল (সা.) তিন শ্রেণির মানুষের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তাই আমাদের আজকের আলোচনা এই তিন শ্রেণির মানুষকে নিয়েই হবে, ইনশাআল্লাহ।
ওয়াদা ভঙ্গকারী: কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ যাদের বিরুদ্ধে থাকবেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো ওয়াদা ভঙ্গকারীরা। ইসলামে ওয়াদা রক্ষার বিশেষ গুরুত্ব আছে। ওয়াদা রক্ষা করা প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য। আর ওয়াদা ভঙ্গ করা মোনাফেকের বৈশিষ্ট্য। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, চারটি স্বভাব যার মধ্যে বিদ্যমান সে হচ্ছে খাঁটি মোনাফেক। যার মধ্যে এর কোনো একটি স্বভাব থাকবে, তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মোনাফেকের একটি স্বভাব থেকে যায়। ১. আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে। ২. কথা বললে মিথ্যা বলে। ৩. অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে। ৪. বিবাদে লিপ্ত হলে অশ্লীলভাবে গালাগালি করে। শুবা আমাশ (রহ.) থেকে হাদিস বর্ণনায় সুফিয়ান (রহ.)-এর অনুসরণ করেছেন। (বুখারি, হাদিস : ৩৪)
ওয়াদা ভঙ্গ করা প্রতারণার শামিল। যারা দুনিয়ায় ওয়াদা ভঙ্গ করে, কিয়ামতের দিন তাকে বিশেষ পতাকা দিয়ে চিহ্নিত করা হবে। ইবনে উমার (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন আল্লাহ তাআলা কিয়ামত দিবসে পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সবাইকে একত্র করবেন, তখন প্রত্যেক প্রতারকের জন্য পৃথক পতাকা উড্ডীন করা হবে এবং বলা হবে যে এটি অমুকের ছেলে অমুকের প্রতারণার চিহ্ন। (মুসলিম, হাদিস : ৪৪২১)
যে স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে:যে কোনো স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করবে, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তার বিরুদ্ধে থাকবেন। পৃথিবী থেকে দাসপ্রথা অনেক আগেই উঠে গেছে, কিন্তু এখনো পৃথিবীর কোথাও কোথাও দাসদের মতো মানুষ বিক্রির জঘন্য এই প্রথা রয়ে গেছে। পৃথিবীতে এখনকার যুগেও নিলামে মানুষ বিক্রি হয়। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে পুরনো গাড়ি, জমি কিংবা আসবাব নয়, নিলামে ওঠা ‘পণ্য’ মানুষ! সর্বোচ্চ ৮০০ ডলারে বিক্রি হয় এক জোড়া আফ্রিকান মানুষ। আধুনিক যুগে এসেও দাসপ্রথার মতো মানুষ বেচাকেনা হচ্ছে লিবিয়ায়। ২০১৮ সালের দিকে এমনই তথ্য উঠে এসেছে সিএনএনের এক রিপোর্টে। শুধু লিবিয়া নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই অমানবিক এই কাজের চর্চা আছে। এই আমাদের দেশেও কয়েক মাস আগে কিছু টিকটক সেলিব্রিটির বিরুদ্ধে কিছু তরুণীকে বিদেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এভাবে স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে দেওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ। যারা এসব কাজে জড়াবে, কিয়ামতের কঠিন দিন মহান আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে থাকবেন। অর্থাৎ সেদিন তাদের অবস্থা ভয়াবহ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
পারিশ্রমিক আদায়ে প্রতারণা করা: মহান আল্লাহ পৃথিবীতে ধনী-গরিব, মালিক-কর্মচারী সৃষ্টি করেছেন তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা করার জন্য। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তিনি সে সত্তা, যিনি তোমাদের জমিনের খলিফা বানিয়েছেন এবং তোমাদের কতককে কতকের ওপর মর্যাদা দিয়েছেন, যাতে তিনি তোমাদের যা প্রদান করেছেন, তাতে তোমাদের পরীক্ষা করেন। নিশ্চয়ই তোমার রব দ্রুত শাস্তিদানকারী এবং নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১৬৫)
তাই মালিক-শ্রমিক, ধনী-গরিব সবারই উচিত প্রত্যেকে প্রত্যেকের হক যথাযথ আদায় করা। শ্রমিকরা তুলনামূলক দুর্বল হওয়ায় বেশির ভাগ তাদের হক নষ্ট করা হয়। এ কারণে রাসুল (সা.)-এর শ্রমিকদের হকের ব্যাপারে উম্মতকে বেশি বেশি সতর্ক করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, শ্রমিকের দেহের ঘাম শুকানোর আগে তোমরা তার মজুরি দিয়ে দাও। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৪৪৩) যারা শ্রমিকদের হক নষ্ট করে, চুক্তি অনুযায়ী তাদের থেকে পূর্ণ কাজ আদায় করে প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয় না, বরং তাদের ঠকায়, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে থাকবেন। তাই প্রত্যেকের উচিত কারো কাছ থেকে শ্রম নিলে তার সঙ্গে ওই শ্রমের বিনিময়ে যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দিয়ে দেওয়া।