করোনা পরিস্থিতির উন্নতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কোনো ঋণকেই মন্দমানের খেলাপি না করার দাবি জানিয়েছিল ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। সংগঠনটির পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ ও পুনঃতফসিল-সংক্রান্ত তিন দফা প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল। তবে ব্যবসায়ীসহ ব্যাংকারদের একাংশের এ দাবি নাকচ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ দাবি নাকচ হয়ে যাওয়ায় ঋণগ্রহীতাদের চলতি মাসের শেষ কর্মদিবসের মধ্যে প্রদেয় কিস্তির ন্যূনতম ২৫ শতাংশ অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। অন্যথায় চলতি বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিক থেকেই তাদের নাম অপরিশোধিত ঋণখেলাপির তালিকায় উঠবে। দেশের সব ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
তবে সভা থেকে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (সিএসএমই) জন্য বাড়তি ছাড় দেয়ার ঘোষণা এসেছে। ডিসেম্বরের মধ্যে এ শ্রেণীর গ্রাহকরা প্রদেয় কিস্তির ১৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করলেই খেলাপি হওয়া থেকে নিষ্কৃতি পাবেন। একই সঙ্গে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত সিএসএমই ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত দেড় শতাংশ সঞ্চিতি সংরক্ষণের সুবিধাও দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে সিএসএমই খাতের বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ঋণের বিপরীতে ২ শতাংশ সঞ্চিতি সংরক্ষণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা অংশ নেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট মহাব্যবস্থাপকরা সভায় উপস্থিত ছিলেন। ব্যাংকার্স সভায় নেয়া সিদ্ধান্তগুলোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ২০২০ সালজুড়ে ব্যাংকঋণ পরিশোধে ঋণগ্রহীতারা ছাড় পেয়েছেন। চলতি বছরেও করোনা পরিস্থিতির বিচারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশকিছু ছাড় দেয়া হয়েছিল। ঋণগ্রহীতারা কোন পন্থায় ব্যাংকঋণ পরিশোধ করবেন, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দফায় দফায় প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তার পরও ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করা হচ্ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, কোনো ছাড়ই অনন্তকাল চলতে পারে না। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতিসহ সামগ্রিক অর্থনীতি করোনা-পূর্ব অবস্থায় ফিরেছে। ব্যবসায়ীদের দাবির যৌক্তিকতা না থাকায় ঋণ পরিশোধে শিথিলতার মেয়াদ বাড়ানোর আর সুযোগ নেই। তবে পরিস্থিতির বিচারে সিএসএমই খাতের জন্য কিছু ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্ত এসেছে।
দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দিতে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। নজিরবিহীন ছাড়ের কারণে গত বছরের পুরো সময়জুড়ে ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপি হওয়া থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন ঋণগ্রহীতারা। চলতি বছরেও প্রদেয় কিস্তির ২৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করলেই গ্রাহকদের খেলাপি হওয়া থেকে ছাড় দেয়া হয়েছিল। তবে চলতি বছরের শেষ কর্মদিবসের মধ্যে কোনো ঋণের কিস্তির ২৫ শতাংশ অর্থ আদায় না হলে সে ঋণ এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে বলে স¤প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
জারীকৃত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে কোনো গ্রাহক প্রদেয় কিস্তির ২৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করলে সে ঋণ নিয়মিত থাকবে। এ সুবিধাপ্রাপ্ত ঋণের বিপরীতে আরোপিত সুদ আয় খাতে হস্তান্তর করা যাবে। তবে চলতি বছরের শেষ কর্মদিবসের মধ্যে প্রদেয় কিস্তির ২৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে সেটি ডিসেম্বর-২০২১ ভিত্তিক শ্রেণীকরণ করতে হবে।
একই প্রজ্ঞাপনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছিল, বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ঋণের বিপরীতে বিদ্যমান নীতিমালার আওতায় রক্ষিতব্য সাধারণ সঞ্চিতির অতিরিক্ত আরো ২ শতাংশ সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে। এ ধরনের সঞ্চিতিকে স্থানান্তর করতে হবে আগে সৃষ্ট স্পেশাল জেনারেল প্রভিশন কভিড-১৯ হিসেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত স্পেশাল জেনারেল প্রভিশন কভিড-১৯ হিসাবে রক্ষিত সঞ্চিতি অন্য কোনো খাতে স্থানান্তর করা যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের জারীকৃত এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনটি সংশোধনের দাবি জানায় এফবিসিসিআই। সংগঠনটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিকল্প তিনটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এর প্রথম প্রস্তাবটি হলো ক্ষুদ্র, মাঝারি ও অন্যান্য শিল্প এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের বকেয়া ঋণের পরিমাণ ১০ কোটি টাকা বা তার চেয়ে কম হলে তা পরিশোধের ক্ষেত্রে প্রদেয় কিস্তির কোনো প্রকার ডাউন পেমেন্ট না দিলেও মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে শ্রেণীকরণ না করে ঋণ হিসাবটি পুনঃতফসিলকৃত বলে গণ্য করা। ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ১০ কোটি থেকে ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত প্রকল্প ঋণ গ্রহণকারী শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রদেয় কিস্তির ন্যূনতম ২ শতাংশ পরিশোধ করা হলে সে ঋণ বিরূপ বা মন্দমানে খেলাপি না করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল এফবিসিসিআই থেকে। ৫০০ কোটি টাকার বেশি প্রকল্প ঋণ গ্রহণকারী শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠনের প্রদেয় কিস্তির ন্যূনতম ১ শতাংশ পরিশোধ করা হলে সে ঋণও খেলাপি হিসেবে বিবেচনা না করার প্রস্তাব দেয় সংগঠনটি।
তিনটি প্রস্তাবই আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত মেনে নেয়ার দাবি জানিয়েছিল এফবিসিসিআই। একই সঙ্গে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কোনো ঋণকে মন্দমানের খেলাপি না করার জন্যও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অনুরোধ জানানো হয়। এফবিসিসিআই থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেয়ার পর থেকেই ব্যবসায়ীদের মধ্যে ঋণ পরিশোধে আবারো ছাড় আসছে বলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। কিছু ব্যবসায়ী সামর্থ্য থাকার পরও ব্যাংকঋণ পরিশোধ বন্ধ করে দেন বলে গতকালের ব্যাংকার্স সভায় শীর্ষ নির্বাহীরা অভিযোগ তোলেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের ৯০ শতাংশ ঋণগ্রহীতা এরই মধ্যে প্রদেয় কিস্তির ২৫ শতাংশের বেশি অর্থ পরিশোধ করেছেন। মাত্র ১০ শতাংশ গ্রাহক আবারো বিশেষ সুবিধা পাওয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন। দেশের আমদানি-রফতানিসহ অর্থনীতির অন্যান্য সূচক করোনা-পূর্ব পরিস্থিতিতে ফিরেছে। দেশের করোনা পরিস্থিতির পাশাপাশি সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করে ব্যবসায়ীদের দাবিগুলো অযৌক্তিক মনে হয়েছে।
এদিকে ব্যাংকার্স সভায় সিএসএমই খাতের জন্য ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ শতভাগ বিতরণকারী ১৩টি ব্যাংক ও চারটি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রশংসাপত্র দেয়া হয়েছে। প্রশংসাপত্র পাওয়া ব্যাংকগুলো হলো ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), ব্র্যাক ব্যাংক, অগ্রণী, উত্তরা, দ্য প্রিমিয়ার, ব্যাংক এশিয়া, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ইস্টার্ন, প্রাইম, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, মধুমতি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন। প্রশংসাপত্র পাওয়া ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো হলো আইডিএলসি ফাইন্যান্স, আইপিডিসি ফাইন্যান্স, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স ও ইউনাইটেড ফাইন্যান্স। প্রণোদনা প্যাকেজের প্রথম ধাপের অর্থ শতভাগ বিতরণ করায় এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশংসাপত্র দেয়া হয়। তবে ২৩টি ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রার ৫০ শতাংশ অর্থও বিতরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় সভায় তিরস্কার করা হয়েছে।