সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, ইট কাঠের কংক্রিট নগরী ঢাকাতে এখনো ২০৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণী টিকে আছে, যাদের অনেকগুলোই এখন বিরল কিংবা বিপন্ন প্রায়। গত কয়েক দশকে ঢাকায় পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাওয়া আকাশচুম্বী ভবন, আর শহরের অলিগলি কিংবা পাশ ঘেঁষে থাকা গাছপালা, ঝোপঝাড়, নদী-নালা, খাল এবং উন্মুক্ত জমি কমে যাওয়ার পরও শহরে হঠাৎই ডেকে উঠতে পারে অচেনা ভীমরাজ পাখি। বুড়িগঙ্গা বা তুরাগ নদীতে এখনো হঠাৎই ভেসে উঠতে পারে দেশি শুশুক। অথবা শহরের ভেতরকারই কোন জলাশয় থেকে লাফিয়ে ডাঙায় উঠতে পারে ঝিঁঝিঁ ব্যাঙয়ের মত অচিন প্রাণী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোঃ ফিরোজ জামানের নেতৃত্বে চালানো এক গবেষণায় পাওয়া গেছে এসব তথ্য। অধ্যাপক জামান বিবিসিকে বলেছেন, যেসব প্রাণী এখনও টিকে আছে, তাদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই হারিয়ে যাবে তারাও—এমন আশংকাও রয়েছে।
যেসব বন্যপ্রাণী পাওয়া গেল গবেষণায়: অধ্যাপক মোঃ ফিরোজ জামান জানিয়েছেন, ২০১৫ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যপ্রাণী রিসার্চ ল্যাবরেটরির অধীনে শুরু হয়েছে গবেষণার কাজ। এটি চলবে ২০৩০ সাল পর্যন্ত। বর্তমান গবেষণাটি সম্প্রতি ইতালির বায়োডাইভার্সিটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত তিন বছরে শহরের বন্যপ্রাণী চিহ্নিত করা এবং জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে জানা যাচ্ছে ঢাকায় মোট ২০৯ জাতের বন্যপ্রাণীর বাস। ঢাকার রমনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, দিয়াবাড়ী, উত্তরা, খিলক্ষেত, রামপুরার আফতাবনগর, বুড়িগঙ্গা এবং তুরাগ নদীসহ মোট ২২টি এলাকা এবং এর আশপাশের জলাশয়, বনভূমিতে এ গবেষণাটি চালানো হয়েছে।
এতে দেখা যাচ্ছে, ২০৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর মধ্যে বসন্ত বাউরি, ফিঙে ও ছোট ভীমরাজ পাখিসহ মোট ১৬২ প্রজাতির পাখি রয়েছে ঢাকা শহরে। সবুজ, গেছো ব্যাঙ, কটকটি ব্যাঙ, ঝিঁঝিঁ ব্যাঙ ও ঘড়িয়ালসহ উভচর প্রাণী আছে ১২ প্রজাতির। তক্ষক, গুইসাপ, খৈয়া গোখরা, পদ্মগোখরার মত সরীসৃপ আছে ১৯ প্রজাতির। এছাড়া বানর, শিয়াল, বনবিড়াল, শুশুক বা ডলফিনসহ ১৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী চিহ্নিত করেছে গবেষণা দল। সুন্ধি কাছিম, তরাকরি কাইট্টা প্রজাতির কচ্ছপসহ কয়েক প্রজাতির কচ্ছপ আছে।
কিন্তু প্রজননের পরিবেশের অভাবে বাড়ছে না বন্যপ্রাণীর সংখ্যা। গবেষণায় দেখা গেছে, লালবুক টিয়া, চন্দনা ও হীরামনসহ মোট টিয়া পাখি আছে চার প্রজাতির। কিন্তু টিয়া পাখির জন্য যে ধরণের উঁচু গাছের প্রয়োজন হয়, তা আছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং রমনা পার্কের মত ঢাকার পুরনো কয়েকটি পার্ক ও উদ্যানে। আবার বিরল প্রজাতির ভুবনচিল দেখা যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর ও এর আশেপাশের এলাকায় উঁচু শিরীষ গাছে।
যেভাবে নিরূপণ করা হয়: ঢাকা শহরের বন্যপ্রাণী গণনার ক্ষেত্রে মূলত একেকটি ট্রেইল ধরে সেটিকে বিভিন্ন অঞ্চল ভাগ করা হয়। এরপর ভাগ করা অংশে থাকা পশু এবং পাখি আলাদা করে গণনা করা হয়েছে। সবশেষে সেটিকে প্রতি বর্গকিলোমিটার হিসাব করে একেকটি প্রজাতির ঘনত্ব হিসাব করা হয়েছে। অধ্যাপক জামান বলেছেন, গবেষণায় দেখা গেছে পাখির মধ্যে এখনো বিপন্ন প্রজাতি তেমন নেই। কিন্তু স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে বিপন্ন প্রজাতি আছে কয়েকটি। এর মধ্যে তুরাগ ও বুড়িগঙ্গায় থাকা দেশি জাতের শুশুক বা ডলফিন এবং বানর আছে সবচেয়ে ঝুঁকিতে। অধ্যাপক জামান বলেছেন, “প্রতিকূল পরিবেশে ঢাকায় বাস করা এসব প্রাণীর বড় অংশটি এখন অস্তিত্বের সংকটে রয়েছে। কিন্তু ঢাকার পরিবেশ থেকে সবুজ যেভাবে কমছে তাতে সেদিন খুব দূরে নয় যখন এসব প্রাণী হারিয়ে যাবে।”