মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীতে পার্থিব ও অপার্থিব জীবনের কল্যাণ নিশ্চিত করতে আগমন করেছেন। তিনি শুধু মানুষকে আসমানি রাজত্বের সুসংবাদ দেননি; বরং তিনি আসমানি রাজত্বের সঙ্গে সঙ্গে পার্থিব জীবনে রাজত্বের সুসংবাদও দিয়েছেন। যেন তারা পৃথিবীতে আল্লাহর দাসত্বের ব্যাপারে নির্ভয় হয় এবং পৃথিবীতে আল্লাহর রাজ কায়েম করতে পারে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে আল্লাহ তাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে তিনি অবশ্যই তাদের পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদের এবং তিনি অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের দ্বিনকে, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন। আর তাদের ভয়ভীতির পরিবর্তে তাদের অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে, আমার কোনো শরিক করবে না, অতঃপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারা তো সত্যত্যাগী।’ (সুরা নুর, আয়াত : ৫৫)
মানুষের উভয় জগতের কল্যাণ নিশ্চিত করতে আল্লাহর শত্রু তথা অসত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাকবে যতক্ষণ ফেতনা (বিশৃঙ্খলা) দূরীভূত হয় এবং আল্লাহর দ্বিন সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৩৯) কোরআনে আল্লাহ তার কিছু নেক বান্দার দোয়ার বিবরণ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের দুনিয়াতে কল্যাণ দাও এবং আখিরাতে কল্যাণ দাও। আর আমাদের জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা কোরো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২০১) পরকালীন জীবনের কল্যাণের কথা সবাই জানে। পার্থিব জীবনের কল্যাণের ব্যাপারে কোরআনের ব্যাখ্যাকাররা বলেন, পার্থিব জীবনের কল্যাণ হলো ইলম (ধর্মীয় জ্ঞান) ও ইবাদত, সুস্থতা, উত্তম জীবিকা, সহায়-সম্পদ, বিজয় ও আল্লাহর সাহায্য, সুসন্তান। তবে এখানে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা আছে। চূড়ান্ত কল্যাণ সেটাকেই বলা হবে, যা ইসলামী শরিয়তে বৈধ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং যারা আল্লাহভীরু ছিল তাদের বলা হবে, তোমাদের প্রতিপালক কী অবতীর্ণ করেছিলেন? তারা বলবে, মহাকল্যাণ। যারা সৎকর্ম করে তাদের জন্য আছে এই পৃথিবীর মঙ্গল এবং আখিরাতের আবাস আরো উৎকৃষ্ট। মুত্তাকিদের আবাসস্থল কত উত্তম!’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৩০) উদ্দেশ্য হলো নেককার মানুষই পার্থিব ও অপার্থিব জীবনের কল্যাণ ও সম্মান লাভ করবে। তবে পরকালীন জীবনের কল্যাণই বেশি উত্তম, বেশি সৌন্দর্যমণ্ডিত। যারা আল্লাহর পথে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে তাদের জন্য আল্লাহর সুসংবাদ হলোÍ‘অতঃপর আল্লাহ তাদের পার্থিব পুরস্কার ও উত্তম পারলৌকিক পুরস্কার দান করেন। আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৪৮) নেক কাজের পার্থিব পুরস্কার হলো আল্লাহর সাহায্য, বিজয়, সাফল্য, সুনাম, সম্মান, সহায়-সম্পদ, ক্ষমতা ও রাজত্ব। যারা আল্লাহর রাস্তায় নিজের ঘর-বাড়ি ত্যাগ করে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে সব কষ্ট সহ্য করে আল্লাহ তাদের উভয় জগতের কল্যাণ দান করেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা অত্যাচারিত হওয়ার পর আল্লাহর পথে হিজরত করেছে, আমি অবশ্যই তাদের পৃথিবীতে উত্তম আবাস দেব এবং আখিরাতের পুরস্কারই তো শ্রেষ্ঠ। হায়, তারা যদি তা জানত!’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৪১)
এসব আয়াতে একটি বিষয় মনোযোগের দাবি রাখে। তা হলো মুমিন ও আল্লাহর নেক বান্দাদের ভেতর উভয় জগতের কল্যাণ লাভের আগ্রহ দান করা হয়েছে। তবে সবখানেই বলা হয়েছে, পার্থিব জীবনের কল্যাণের চেয়ে পরকালীন জীবনের মর্যাদাপূর্ণ, উত্তম ও সম্মানজনক। সুতরাং পার্থিব জীবনের কল্যাণ আমাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য নয়; বরং দ্বিতীয় লক্ষ্য। পরকালীন জীবনকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। আমরা যদি পার্থিব স্বার্থকে জীবনের লক্ষ্য বানাই, তবে হয়তো পার্থিব জীবনের কল্যাণ পেয়ে যাব, তবে পরকালে আমরা বঞ্চিত হয়ে যাব। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে পার্থিব জীবন ও তার শোভা কামনা করে, পৃথিবীতে আমি তাদের কর্মের পূর্ণ ফল দান করি এবং সেখানে তাদের কম দেওয়া হবে না। তাদের জন্য পরকালে আগুন ছাড়া অন্য কিছু নেই এবং তারা যা করে আখিরাতে তা নিষ্ফল হবে, তারা যা করে থাকে তা নিরর্থক।’ (সুরা হুদ, আয়াত : ১৫-১৬) বিপরীতে যারা পরকালীন জীবনের কল্যাণ কামনা করে তাদের ব্যাপারে আল্লাহর অঙ্গীকার হলো, ‘যে আখিরাতের ফসল কামনা করে তার জন্য আমি তার ফসল বর্ধিত করে দিই এবং যে দুনিয়ার ফসল কামনা করে আমি তাকে তারই কিছু দিই, আখিরাতে তার জন্য কিছুই থাকবে না।’ (সুরা আশ-শুরা, আয়াত : ২০) সুতরাং তারা কতই না বোকা, যারা শুধু পার্থিব জীবনের প্রতিদান প্রত্যাশা করে। অথচ আল্লাহর হাতে উভয় জগতের ভা-ার বিদ্যমান। কেননা যে পার্থিব জীবন প্রত্যাশা করে সে পরকালীন জীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে এবং যে পরকালীন জীবনের কল্যাণ চায় আল্লাহ তাকে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিশ্চিত করবেন। পৃথিবীতে আল্লাহর একটি বড় দান ও অনুগ্রহ ক্ষমতা ও রাজত্ব। এমনকি পবিত্র কোরআনে আল্লাহর কিতাব ও নবুয়তের ‘সম্পদে’র পর তাকে স্থান দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি ইবরাহিমের বংশধরকেও কিতাব ও হিকমত প্রদান করেছিলাম এবং তাদের বিশাল রাজ্য দান করেছিলাম।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৪৫)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ কোরো, যখন মুসা তাঁর স¤প্রদায়কে বলেছিল, হে আমার স¤প্রদায়, তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কোরো, যখন তিনি তোমাদের মধ্য থেকে নবী করেছিলেন এবং তোমাদের রাজ্যাধিপতি করেছিলেন।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ২০) আল্লাহ যখন পৃথিবীর সবচেয়ে প্রার্থিত ও পার্থিব বিচারে বড় পুরস্কার ক্ষমতা ও রাজত্ব মুমিনের হাতে তুলে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন, তখন পৃথিবীর অন্যান্য পুরস্কারের ব্যাপারে মুমিনের কোনো ভয় থাকতে পারে না।( তামিরে হায়াত থেকে মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর)