জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষক স¤প্রতি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা পর্যালোচনা করে ‘প্রেজেন্ট সিচুয়েশন অব সুইসাইড ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিস, আদালত, গণমাধ্যম, পুলিশ ও বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এটি তৈরি করা হয়েছে। এতে উঠে এসেছে, বিশ্বব্যাপী প্রাণহানির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ আত্মহত্যা। যদিও বিষয়টি গোটা বিশ্বেই অবহেলিত। গবেষণা, স্বাস্থ্যনীতি নির্ধারণ থেকে শুরু করে কোনো ক্ষেত্রেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ২০১৯ সালে দিনে গড়ে ৩২ জন আত্মহত্যার চিন্তা করেছেন, যা আগের বছরগুলোর চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা প্রায় ৪০। দেশের নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। এখনো এ ধরনের মৃত্যু প্রতিরোধে নজরদারির বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। এমনকি এ নিয়ে সমন্বিত কোনো কৌশলও নেই। বাংলাদেশে বিষয়টি জনস্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলেও তা নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে একেবারেই বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী পছন্দের শীর্ষে রয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আসন নিশ্চিত করতে ভর্তিযুদ্ধে নামতে হয় শিক্ষার্থীদের। যদিও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ শিক্ষার্থীদের মধ্যেই এখন আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বেশি। সা¤প্রতিক কিছু জরিপভিত্তিক গবেষণার তথ্যেও বিষয়টি উঠে এসেছে। বিশেষ করে করোনাকালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা গিয়েছে সবচেয়ে বেশি। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, মূলত সম্পর্কের টানাপড়েন, পারিবারিক কলহ, পড়ালেখার চাপ ও আর্থিক অনটনের কারণেই আত্মবিধ্বংসী পদক্ষেপ নিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। করোনাকালীন অনিশ্চয়তা ও নিষ্ক্রিয়তা এসব টানাপড়েনকে আরো প্রকট করে তুলেছে, যারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পরিসংখ্যানে।
আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির নয়জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। এর মধ্যে গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মাসুদ আল মাহদী অপু আত্মহত্যা করেন। রাজধানীর চানখাঁরপুলের একটি মেস থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বেশ নাড়া দিয়েছিল।
গত বছরের মে মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে ডাব বিক্রেতার ভ্যান থেকে দা নিয়ে নিজের গলা কেটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের আত্মহত্যার ঘটনা বহুল আলোচিত। তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগারবিজ্ঞান ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হাফিজুর রহমান একজন মূকাভিনেতাও ছিলেন। এ ঘটনা তদন্ত করে পুলিশ জানতে পারে, মাদক গ্রহণের পর তিনি ওই ঘটনা ঘটান।
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, আত্মহত্যা কমাতে পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার পথ তৈরি করতে হবে। কারণ আত্মহত্যার পর আমরা যখন জানতে পারি, তখন আর কিছু করার থাকে না। এজন্য ওই শিক্ষার্থীর আশপাশের মানুষের সহযোগিতা প্রয়োজন। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক, পরিবারের সদস্যদের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি দরকার। তাদের উচিত মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শিক্ষার্থীকে সহযোগিতা করা অথবা আমাদের জানানো।
বর্তমানে আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে আর্থিক সমস্যাকে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাবি প্রক্টর বলেন, আর্থিক সমস্যা বাংলাদেশের মতো দেশে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সমস্যা। এটি সমাধানে আমাদের আন্তরিক হতে হবে। যারা এ ধরনের সমস্যায় রয়েছেন, তাদের যোগাযোগ করার আহ্বান জানাই। শিক্ষার্থীদের জন্য আমাদের হাত সবসময় প্রসারিত। যেকোনোভাবে সহযোগিতা করতে আমরা প্রস্তুত। আমাদের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা বৃত্তি দেন। হল পর্যায়ে বৃত্তির ব্যবস্থা আছে। বিভাগ ও অনুষদ পর্যায়সহ আরো অসংখ্য বৃত্তির ব্যবস্থা আছে, যা শিক্ষার্থীর আর্থিক সমস্যা সমাধানে কিছুটা হলেও কার্যকর। এছাড়া যদি কেউ একাডেমিক কারণে হতাশায় ভোগেন, তারা বিভাগীয় পর্যায়ে ছাত্র পরামর্শদাতা এবং হলে হাউজ টিউটরদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। প্রয়োজনে প্রক্টর অফিসেও যোগাযোগ করতে পারেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গত বছর শিক্ষার্থী আত্মহত্যার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বলে আঁচল ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। এ সময় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ছয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এ তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি)। গত বছর প্রতিষ্ঠানটির পাঁচ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। চতুর্থ অবস্থানে থাকা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন চারজন। এর বাইরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনজন করে এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন করে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এ ১০টির বাইরেও অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো অন্তত ১১ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান এ আত্মহত্যার প্রবণতার পেছনে আর্থিক অবস্থা বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তানসেন রোজ। তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসেন। সুতরাং তাদের আর্থিক চাপ থাকে। তাদের প্রবণতা হলো দ্রুত একটা চাকরির ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে সরকারি চাকরি। কিন্তু ওপর মহলে যোগাযোগ না থাকার কারণে চাকরি পেতে সময় লাগে। ওদিকে পরিবার থেকে আর্থিক চাপ আসে। ফলে তাদের মধ্যে হতাশা বাসা বাঁধে, যা আত্মহত্যার অন্যতম কারণ। তাছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবেগপ্রবণতা অনেক বেশি। করোনাকালে আত্মহত্যাপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ হলো এ সময়ে চাকরির নিয়োগ কম হয়েছে, যা হতাশা বাড়িয়েছে। এছাড়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি সামাজিক চাপও বেশি থাকে। ফলে সমাজের প্রত্যাশা পূরণে তাদের হতাশায় পড়তে হয়। সব মিলিয়ে একজন মেধাবী শিক্ষার্থীকে সমাধান খুঁজতে হয় আত্মহত্যার পথে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসান এ শাফী বলেন, যেকোনো মানুষকে জীবনের কোনো সময়ে কিছু পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এটা মানিয়ে নিতে না পারলে সে আত্মবিধ্বংসী পদক্ষেপ নেয়। যখন সামাজিক বন্ধন হালকা হয়ে যায়, মানুষ তখন আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্তগুলো নেয়। বৈশ্বিক পরিবর্তিত পরিস্থিতি এর জন্য দায়ী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরিবারের বাইরে এসে জীবন পার করছেন। এ সময় যেসব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তারা যান, তার জন্য মোটেও তারা প্রস্তুত থাকেন না। সবাই কেমন যেন একা। কিন্তু আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তিনি যদি নিজের দায়িত্বশীলতার কথা চিন্তা করেন, তবে তিনি ফিরে আসতে বাধ্য হন। সংস্কৃতি ও শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিকে দায়িত্বশীল করে তুলতে পারছে না।
আঁচল ফাউন্ডেশন নামের এক বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়কৃত তথ্য অনুযায়ী, শুধু গত বছরেই দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্তত ৫০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ‘করোনাকালে তরুণদের আত্মহত্যাপ্রবণতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ পরিসংখ্যান উঠে আসে। গত বছরের পুরো সময়ে অর্ধশতাধিক জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক এবং অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। আরেক গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৮ সালে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিলেন। আর ২০১২ সালে এ ধরনের ঘটনা ঘটে মোটে একটি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাপদ্ধতি ও পরিবেশ এমনিতেই শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অনুকূল নয়। করোনাকালীন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রকট হয়ে ওঠা পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যাগুলো তাদের মধ্যে এক ধরনের আত্মবিধ্বংসী প্রবণতার জন্ম দিয়েছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং পারিবারিক ও সামাজিক সহযোগিতার অভাবকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান পড়াশোনার পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীবান্ধব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেও প্রয়োজনীয় অনেক কিছু এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। আমরা শিক্ষার্থীদের বুনিয়াদি শিক্ষা দিতে পারছি না। একই সঙ্গে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের নামে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনও করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশও অনেক ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক। সেখানে একজন শিক্ষার্থী বিমর্ষ হয়ে পড়ে।
আত্মহত্যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের একটি হুমকি হলেও বিষয়টিকে সমাজ এখনো সেভাবে দেখছে না উল্লেখ করে এ মানসিক বিশেষজ্ঞ বলেন, শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিকÍএ চার মিলে যে স্বাস্থ্য, তা এখনো আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। ফলে আত্মহত্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অবহেলিতই থেকে যাচ্ছে। আমরা অন্যান্য রোগের প্রতিকারে কাজ করলেও আত্মহত্যার প্রতিকারে গবেষণা ও প্রতিরোধে কাজ করতে পারিনি। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আত্মহত্যাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না।