গত বছরের ২৭ অক্টোবর রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া থেকে ছেড়ে ফেরি আমানত শাহ মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটে এসে ডুবে যায়। এ ঘটনায় নৌ মন্ত্রণালয় ৭ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই কমিটি গত বছরের ১৬ নভেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন নৌ মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। সেখানে ফেরি দুর্ঘটনার অনেকগুলো কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ঘাটে র্যাম্প নামানোর সময় ফেরিটি পোর্ট সাইডে ঘাটের সাপেক্ষে ১১.৪৩ ডিগ্রি কাত হয়েছিল। র্যাম্প নামানোর ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে প্রথম ট্রাকটি নেমে যায়। ট্রাক নেমে যাওয়ার পর লিস্ট এঙ্গেল ১২ ডিগ্রি হয়। দ্বিতীয় ট্রাকটি নামে প্রথম ট্রাক নামার ২০ সেকেন্ড পর। পরে ৫ সেকেন্ডের মধ্যে তৃতীয় ট্রাকটি নেমে যেতে সক্ষম হয়। এরপর ফেরিটির লিস্ট এঙ্গেল ছিলো ১৬.৭২ ডিগ্রি। পরবর্তী ৯০ সেকেন্ডে ফেরিটি সম্পূর্ণ ৯০ ডিগ্রি কাত হয়ে যায়। অর্থাৎ ঘাটে ভিড়ানোর ১৫০ সেকেন্ডের মধ্যে ফেরিটি ১১.৪৩ ডিগ্রি হতে ৯০ ডিগ্রি এঙ্গেলে কাত হয়ে যায়।
জানা গেছে, ফেরিটি প্রায় ৪১ বছরের পুরাতন। সর্বশেষ ২০১২ সালে ডকিং মেরামত হয়েছিল আমানত শাহ নামের ওই ফেরিটির। এরপর থেকে কোনো ফুল ডকিং করা হয়নি। এছাড়া কোনো সার্ভে সার্টিফিকেট নেই। ফলে এটি চলাচলের অনুপযুক্ত ছিল।
ফেরিটি গত জুলাইয়ে স্বল্প পরিসরে মেরামত শেষে ডক থেকে ফিরে এলেও ফেরির হাল বা তলদেশের কোনো কাজ হয়নি। স্যান্ড ব্লাস্টও করা হয়নি। এছাড়া ওয়েল্ডিংয়ের কাজে দুর্বলতা, ডকিংয়ের গ্যাজিং কাজের (হাল ও তলদেশের পুরুত্ব যাচাই) ঘাটতি ছিল। যথাযথভাবে ডকিং হলে ফেরির পাশে বিদ্যমান ক্ষুদ্রাকৃতির একাধিক ছিদ্র মেরামত করা হতো। ফলে এসব দিয়ে দ্রুতগতিতে পানি ভেতরে প্রবেশ করতো না।
ব্লাকহেড বা পার্টিশান ওয়াল এয়ারটাইট কিনা তা ডকে যাচাই করা হয়নি। ফলে ফেরির তলদেশের ছিদ্র বা ক্র্যাক দিয়ে প্রবেশ করা পানি পার্টিশান ওয়ালের অন্যান্য ছিদ্রগুলো দিয়ে ফেরির পোর্ট সাইডে জমা হওয়ার কারণে কাত হয়ে যায়। ডকিং কর্তৃপক্ষ ফেরির ডকিং মেরামত কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর জাহাজের ইঞ্জিন কর্মকর্তা ও মাস্টার রিলিজ অর্ডার গ্রহণ করেন। এক্ষেত্র ডক ইয়ার্ড কর্তৃক প্রাপ্ত কার্যাদেশ/ চহিদার বাইরে স্যান্ড ব্লান্টিং, এয়ার টাইট কম্পার্টমেন্ট/ ব্লাকহেড যাচাই, ইঞ্জিনের ওভার হলিংসহ অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেখা হয়না। তাছাড়া যন্ত্রপাতিরও অভাব আছে।
ফেরির ব্যালাস্টিং- ডিব্যালাস্টিংয়ের কাজেও গাফিলতি ছিল। ফলে ফেরিটির একদিকে লিস্ট থাকলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফেরির ডেকে ম্যানহোলের নাট বোল্ট নেই, তাই কম্পার্টমেন্টগুলো এয়ার টাইট ছিল না। ফলে ফেরি ধোয়ার পানি এবং বৃষ্টির পানি সহজেই বালাস্ট ট্যাংক গুলোতে নিয়মিত প্রবেশ করতো। ফলে এর পরিমাণ সম্পর্কে ফেরিতে কর্মরত ব্যক্তিদের কোনো ধারণা ছিল না।
যেহেতু ফেরির ডানদিকে তেলের ট্যাংক এবং বাম দিকের সবগুলোই ব্যালাস্ট ট্যাংকে ফলে স্বভাবতই বামদিকে বেশি পানি ফেরির কর্মরত ব্যক্তিদের অগোচরে রয়ে যায়।
তদন্তে দেখা গেছে, ফেরিসমূহের ব্যালাস্ট ব্যবস্থাপনা ও ট্রাকের প্লেসমেন্ট যথাযথ না থাকায় প্রচলিত নিয়মে একটু কাত হলেও ফেরি মাস্টার বা সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি স্বাভাবিক মনে করে থাকেন। এ প্র্যাকটিস চালু থাকায় আমানত শাহ ফেরির মাস্টার বিষয়টি আমলে নেননি।
দৌলতদিয়া ঘাটের ওজন পরিমাপক যন্ত্র নষ্ট থাকায় ওজনের ব্যাপারটিও আমলে না নিয়ে শুধু জায়গার পারিমাপ দেখে ফেরিতে গাড়ি লোডিং করা হয়। পরে যানবাহনের চালকরা ফেরি ত্যাগের সময় ফেরির ট্যান্ডল ও লস্করের নির্দেশনা না মেনে ইচ্ছেমতো গাড়িগুলো ফেরি থেকে মানতে শুরু করে। যানবাহন ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো না হওয়ার ফেরি ঘাটে ভেড়ার পর র্যাম্পের সামনে থাকা ডান ও বামের দুইটি গাড়ি বের হবার পর পোর্ট সাইড থেকে তৃতীয় গাড়ি বের হয়। চতুর্থ গাড়ি বের হবার সময় ফেরি আরো বেশি কাত অবস্থায় থাকায় এবং র্যাম্প যথাস্থানে না থাকায় ট্রাকগুলো পোর্ট সাইডে কাত হয়ে পড়ে যায়। অত্যাধিক কাত হওয়ার কারণে ডান পাশের গাড়িগুলো বাম দিকে হেলে পড়ে। এ সময় ফেরি আরও বেশি কাত হয়ে গিয়ে পোর্ট সাইডে অর্ধনিমজ্জিত হয়। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা কার্যালয়ের ডিজিএম শাহ মো.খালেদ নেওয়াজ বলেন, এ দুর্ঘটনার পর প্রতিটি ফেরির ডকিং মেরামতের পর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া ফেরিগুলোতে মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনের প্রতিটি সুপারিশ বাস্তবায়নে বিআইডব্লিউটিসি ও বিআইডব্লিউটিএ বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।