ঢাকাই সিনেমার বরেণ্য অভিনেত্রী কবরী। তাকে দর্শক ভালোবেসে মিষ্টি মেয়ে বলে ডাকেন। তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে গেল বছর পৃথিবী ত্যাগ করেন এ অভিনেত্রী। তার মরদেহের গোসল ও দাফন নিয়ে স¤প্রতি শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় এসেছেন। তিনি করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত শিল্পীদের লাশ গোসল ও দাফন করেছেন দাবি করে অভিনেত্রী কবরীরও নাম নেন। এদিকে তার এই বক্তব্য নিয়ে দেশের জনপ্রিয় বিনোদন সাংবাদিক মনজুর কাদের জিয়া এক দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, জায়েদ মিথ্যা বলছেন।
জিয়া লেখেন, ‘কবরী আপাকে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানের গোসল করানো এবং একজন সংবাদকর্মীর বয়ান …… চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনী প্রচারে বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান করোনায় মৃত অন্য অভিনয়শিল্পীর প্রসঙ্গে টেনে আনতে গিয়ে বলেছেন, করোনায় মৃত দেশ বরেণ্য চিত্রনায়িকা কবরীকে নাকি তিনি গোসল করিয়েছেন! যা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার ও বানোয়াট। অবাক ও বিস্মিত হয়েছি এই ভেবে, ভুলক্রমেও যদি তিনি এই ধরনের বক্তব্য দিয়ে থাকেন, এত দিন পার হওয়ার পরও তিনি সেই বক্তব্য প্রত্যাহারের প্রয়োজন মনে করেননি!
মধ্যরাতে করোনায় মারা যাওয়াতে কবরী আপাকে সকাল পর্যন্ত হাসপাতালের মরচুয়ারি রাখার সিদ্ধান্ত হয়। পরদিন সকালেই মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে আল মারকাজুল গোসল করানো হবে। সকালেই কথা হয় শাকেরের সঙ্গে, বলল গোসল করাতে গাড়ি রওনা করেছে। বাসার কাছে বলেই আমিও গেলাম সেখানে। কবরীর আপাকে গোসল করানোর সময়টায় শাকেরের পাঠানো সেই প্রতিনিধি ও আমি ছাড়া কেউ নেই। গোসলের পুরো কাজটি আল মারকাজুল স্বেচ্ছাসেবকেরা করেছেন। তাছাড়া কোনো নারীর গোসল তো পুরুষ মানুষ করাতে পারে বলে জানা নেই! সেখানে শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান কীভাবে বলেন, তিনি কবরীকে গোসল করিয়েছেন! নির্বাচনী প্রচারণায় এতটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলায় হঠাৎ আমিও কনফিউজড!
জায়েদ খানের এমন কথার প্রেক্ষিতে গতকাল বুধবার সকালে শাকেরকে জিজ্ঞেস করলাম, কাহিনি কি বলো তো? শাকের বলল, কে তিনি? সিনেমার জায়েদ খান সাহেব? তিনি তো এখানে কোনো বিষয়ই না। এমন কথা তিনি বললেন কীভাবে!
গোসল শেষে কবরী আপাকে শেষবারের মতো নেওয়া হয় তাঁর গুলশানের বাড়িতে। সেখানে বিভিন্ন টেলিভিশনের সাংবাদিকেরা ছিলেন, আর শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন সোহানা সাবা এবং তাঁর নতুন চলচ্চিত্র ‘এই তুমি সেই তুমি’এর কয়েকজন শিল্পী ও কলাকুশলী। ছিলেন কবরী আপার আত্মীয়স্বজন আর শাকেরের বন্ধুরাও ছিল। আনুষ্ঠানিকতা শেষে গুলশানের লেক রোডের বাসা থেকে কবরী আপাকে নিয়ে যাওয়া হয় বনানী কবরস্থানে। মরদেহের গাড়ি চলছে, আর আমি মোটরসাইকেলে ছুটলাম। আমার পেছনে বসা নির্মাতা তোহা মোরশেদ…..
বরেণ্য এই অভিনয়শিল্পীকে আমি আপা বলেই সম্বোধন করতাম। তিনি আমার বড় বোনের মতোই ছিলেন। আমাকেও তিনি ভাইয়ের স্নেহে দেখেছেন এবং বন্ধুও মনে করতেন। তাঁর জীবনের অগণিত ঘটনা তাই আমার সঙ্গে শেয়ার করেছেনও।
করোনা আক্রান্ত কবরীর আপার হাসপাতালে ভর্তি থেকে শেষ বিদায়ের ঘটনার কিছুটা এখানে তুলে ধরলাম। সেদিন শুক্রবার, ১৬ এপ্রিল ২০২১। এখনো পরিষ্কার মনে আছে, অফিস শেষে গুলশান গিয়েছিলাম, সেখান থেকে বাসায় ফিরে ফ্রেশ হচ্ছিলাম। তখনই ফোন বাজছিল। বের হয়ে দেখি, কবরী আপার ছেলে শাকেরের ফোন। বারবার ফোন করছে, নিশ্চয় জরুরি। ফ্রেশ হয়ে ফোন দিতেই শাকের চিশতী উদ্বেগ নিয়ে বলল, ‘আম্মার অবস্থা ভালো না। হাসপাতাল থেকে বলেছে,আমাকে যেতে। আপনি আসেন প্লিজ। আমি বুঝতে পারছি না …। দ্রুত আসেন…’ মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটলাম হাসপাতালে। পৌঁছে দেখলাম, শাকের বসে আছে। আমাকে দেখে দৌড়ে কাছে এলো। জানতে চাইলাম, ডাক্তার কি বলেছেন। বলল, তারা বলেছে অবস্থা মোটেও ভালো না। ডাক্তারের সঙ্গে আমিও কথা বললাম, একই কথা বললেন। একবার আমি, আরেকবার শাকের-এদিক এদিক হাঁটাহাঁটি করছি। একটা সময় ডাক্তার ডেকে জানালেন, কবরীর লাইফ সাপোর্ট খুলে দেওয়া হয়েছে! ঘটির কাটায় তখন ১৭ এপ্রিল ২০২১ রাত ১২ টা ২০ মিনিট।
মৃত্যুর আগে কয়েক দিন ভীষণ সংকট সময় পার করেন কবরী। আইসিইউ কেবিন সংকটের কারণে হাসপাতাল বদল করে তাঁকে ভর্তি করানো হয় মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভারে, সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মারা যাওয়ার ৫০ মিনিট আগে আমি হাসপাতাল পৌঁছাই।
কবরীর মৃত্যুর পর ছেলে শাকেরের সবচেয়ে বড় চিন্তা ছিল, কীভাবে তাঁকে সমাহিত করা হবে। শাকের কিছুই বুঝতে পারছিল না। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। আমাকে বলল, কী করা যায় দেখেন না প্লিজ। আমি বললাম, তোমাদের পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলো, কারণ এটা তোমাদের পারবারিক সিদ্ধান্ত। সবার সঙ্গে আলাপ করে শাকের জানাল, যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাঁকেই নিতে হবে। এরপর শাকের ও আমি কথা বললাম হাসপাতাল পরিচালক অধ্যাপক ফারুক আহমেদের সঙ্গে। ততক্ষণে শাকের, আমি ছাড়াও হাসপাতালে এসে পৌঁছান পরিচালক তোহা মোরশেদ। এর মধ্যে আমার মোবাইলে অনেকগুলো ফোন আসে। সংবাদকর্মী যেহেতু আমাকে প্রথম আলোয় খবরও পাঠাতে হবে। মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আসতে থাকা অনেকগুলো ফোনকলের মধ্যে কথা বলার সুযোগ হয় ফেরদৌস, শাকিব খান, মিশা সওদাগরের সঙ্গে। সবাই কবরী আপার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। এর মধ্যে মিশা ভাই জানতে চাইলেন, আসবেন কী না।
ঘণ্টাখানেক পর তিনি এলেন, সঙ্গে ছিলেন চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানও। এদিকে কবরীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তে না পড়তেই গভীর রাতে হাসপাতালে গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড় লেগে যায়। তাঁরা বারবার কবরীর মৃত্যু নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিবার এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল। শাকের আমাকে বলছিল, আপনি সবার সঙ্গে কথা বলেন। আমি বললাম না, এখানে তোমাকেই কথা বলতে হবে। তোমারই বলা উচিত। এরপর জানতে চাইল, কি বলবে?
শাকেরকে বুঝিয়ে দিলাম। এরপর সে হাসপাতালে গেটে দাঁড়িয়ে মায়ের মৃত্যু সংবাদ ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সাংবাদিকদের জানান।
কথা শেষে কবরী আপার গোসল এবং দাফন নিয়ে টেনশন শুরু। এমনকি রাতে মরদেহ কোথায় থাকবে, সেটাও। হাসপাতাল পরিচালক ফারুক সাহেবের সঙ্গে আমরা দুজন কথা বলে সব ঠিক করলাম, মরদেহ রাখার এবং গোসলের ব্যাপারটাও।
হাসপাতালের সামনে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা হলো শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানের সঙ্গে। তিনি আমাকে বললেন, ‘ভাই, মিডিয়া দাঁড়ায়ে আছে, কিছু বলা তো উচিত। চলেন।’ আমি বললাম, ‘অলরেডি বলেছে শাকের।’ এরপর তিনি কিছু বললেন না। আমরা কথা বলছি। এফডিসিতে মরদেহ নেওয়ার ব্যাপারেও কথা বললেন। কিন্তু পরিবারের আপত্তিতে তা আর হলো না। কিছু সময় পর আবার বললেন, ‘অনেকক্ষণ তো মিডিয়ারা দাঁড়ায়ে আছে।’ বললাম, ‘আপনি আর মিশা ভাই যান, কথা বলেন আপনারা।’ তখন তারা গেলেন, মিডিয়ার সঙ্গে কথা বললেন। অবশ্য আমাকেও ডেকেছিলেন, কিন্তু তখন শাকের ও আমাকে রাতে মরদেহ কোথায় রাখা হবে, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা তার মা পাবে কী না এবং দাফন কোথায় হবে এসবের জন্য নানা কিছু ভাবতে হচ্ছিল। মিশা সওদাগর ও জায়েদ খান মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলে, কিছুক্ষণ থেকে এরপর যে যার বাসায় চলে গেলেন।
কবরী আপা শেষ যাত্রার ঠিকানা কোথায় হবে তা নিয়ে কূল কিনারা না পেয়ে, কথা বলি খোকন ভাইয়ের সঙ্গে (তখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপপ্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন)। তিনি বললেন, জীবনের (এ.বি.এম সরওয়ার-ই-আলম সরকার, প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব-৩) সঙ্গে কথা বলতে। রাত ১টা ৫৫ মিনিটে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলি তাঁর সঙ্গে। কবরী আপার কবরস্থান এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদানের বিষয়টি নিয়ে কীভাবে কী করা যায় পরামর্শ চাইলাম। জানতে পারলাম, প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব কবরীর ইস্যু নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। এসব করতে করতে সাহরির সময় হয়ে যায়।
আমি ফিরলাম মোহাম্মদপুরের বাসায়, শাকেরকে তুলে দিলাম তাঁর গাড়িতে গুলশান বাসায় যাওয়ার জন্য। আমি যখন বাসায় ফিরি তখনো দাফনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। আজ এই পোস্ট লেখার আগে যখন হোয়াটসঅ্যাপ সেই দিনের কথোপকথন দেখছি, ভোর ৪ টা ৩৯ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী অফিস থেকে আমাকে জানানো হলো, সবকিছু সুন্দরভাবে ব্যবস্থা হচ্ছে। চিন্তা নেই। শাকেরকেও জানালাম … … আপাতত এইটুকুই। সবাইকে ধন্যবাদ।’