মহানবী (সা.) প্রতিভাবানদের বিশেষভাবে মূল্যায়ন করতেন। তিনি তাদের মেধা-প্রতিভা বিকাশে উৎসাহিত করতেন। সিরাত গবেষকরা বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রত্যেক ব্যক্তিকে সেই কাজের সুযোগ করে দিতেন, যে কাজের প্রতিভা ও যোগ্যতা তার আছে। যেন সে তার মেধা ও প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পায় এবং জাতিকে সর্বোত্তম সেবা দান করতে পারে।
বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অন্যদের ওপর অগ্রাধিকার দিতেন। ১. হাসসান বিন সাবিত (রা.) : নবীজি (সা.)-এর সভাকবি ছিলেন হাসসান বিন সাবিত (রা.)। নবী (সা.) তাঁকে ইসলামের পক্ষে কবিতাচর্চায় উৎসাহিত করেন। আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) হাসসান (রা.)-এর উদ্দেশে বলেন, ‘নিশ্চয়ই রুহুল কুদুস (জিবরাইল) তোমাকে সাহায্য করতে থাকবে, যতক্ষণ তুমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষে প্রতিরোধ করবে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘হাসসান তাদের নিন্দা করেছে। ফলে মুসলিমরা খুশি হয়েছে এবং অমুসলিমরা অসন্তুষ্ট হয়েছে। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৪৯০) রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর জন্য দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ! জিবরাইলের মাধ্যমে তাকে সাহায্য করুন। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩২১২)
২. জায়িদ বিন সাবিত (রা.) : রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবি জায়িদ বিন সাবিত (রা.)-এর মধ্যে ভাষাগত দক্ষতা দেখতে পান। ফলে তিনি তাঁর প্রতিভা বিকাশে উৎসাহ দিয়ে বলেন, ‘হে জায়িদ! আমার জন্য ইহুদিদের কিতাব শিক্ষা কোরো। কেননা আল্লাহর শপথ! আমি আমার কিতাবের ব্যাপারে ইহুদিদের নিরাপদ বোধ করি না। ’ (তুহফাতুল আহওয়াজি : ৭/৪১৩)
জায়িদ বিন সাবিত (রা.) ছিলেন একজন সম্মানিত ওহি লেখক। নবীজি (সা.) তাঁর প্রতিভা বিকাশে এই কাজে নিযুক্ত করেন। হাদিসে এসেছে, সুরা নিসার ৯৫ নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হলে মহানবী (সা.) বলেন, ‘জায়িদকে আমার কাছে ডেকে আনো এবং তাকে বোলো সে যেন কাঠের টুকরা, দোয়াত এবং কাঁধের হাড় নিয়ে আসে। এরপর তিনি বললেন, লেখো। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৯৯০)
৩. মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) : বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে পারদর্শী হওয়ায় রাসুলুল্লাহ (সা.) মুয়াজ বিন জাবাল (রা.)-কে ইয়েমেনের বিচারক নিযুক্ত করেন। এ ব্যাপারে প্রসিদ্ধ একটি হাদিসে তাঁর বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। ইয়েমেনে পাঠানোর আগে নবীজি (সা.) তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘যখন তোমার কাছে বিচার চাওয়া হবে, তখন তুমি কিভাবে ফায়সালা করবে?’ তিনি বলেন, আল্লাহর কিতাব দ্বারা। নবীজি (সা.) বলেন, ‘যদি কিতাবে তা না পাও?’ তিনি বললেন, আল্লাহর রাসুলের সুন্নত দ্বারা। নবীজি (সা.) বললেন, ‘যদি তুমি আল্লাহর রাসুলের সুন্নতে না পাও?’ তিনি বললেন, আমি তাঁর বিচার-বিবেচনা দিয়ে ফায়সালা করব। মহানবী (সা.) তাঁর বুকে মৃদু আঘাত করে বললেন, ‘সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য। যিনি তাঁর রাসুলের প্রতিনিধিকে এমন তাওফিক দিয়েছেন, যা দ্বারা আল্লাহর রাসুল সন্তুষ্ট হয়েছে। ’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩৫৯২)
৪. মুসআব ইবনে উমায়ের (রা.) : মহানবী (সা.) মুসআব ইবনে উমায়ের (রা.)-কে মদিনায় শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করে তাঁর মেধা-প্রতিভা ও নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশের সুযোগ করে দেন। তিনি ছিলেন নবীজি (সা.)-এর পক্ষ থেকে মক্কার প্রেরিত প্রথম প্রতিনিধি। মদিনায় তিনি মানুষকে কোরআন ও দ্বিনের প্রাথমিক বিষয়গুলো শিক্ষা দিতেন এবং সুপথে চলতে উৎসাহিত করতেন। মদিনাবাসী তাঁকে ‘মুকরি’ (কোরআন পাঠকারী) বলে সম্বোধন করত। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/৪৩৪)
৫. আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) : হিজরতের রাতে মহানবী (সা.) তাঁর বিছানায় আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-কে শুইয়ে রেখে আসেন। নিজের বিছানায় অবস্থানের জন্য তিনি তাঁকে বেছে নিয়েছিলেন প্রধানত আল্লাহর ইংগিতে। এ ছাড়া আরবে আলী (রা.)-এর বীরত্ব, সাহসিকতা ও উপস্থিত বুদ্ধির খ্যাতি ছিল। যদি তিনি সত্যি কোনো বিপদের মুখোমুখি হতেন, হয়তো তিনি সাহস হারিয়ে ফেলতেন না। একই কারণে মহানবী (সা.) খায়বারের যুদ্ধে তাঁর হাতে মুসলিম বাহিনীর পতাকা তুলে দেন।
৬. হুজায়ফা ইবনে ইয়ামান (রা.) : খন্দকের যুদ্ধের সময় যখন কোনোভাবে শত্রু শিবিরের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) হুজায়ফা ইবনে ইয়ামান (রা.)-কে সম্মিলিত বাহিনীর সংবাদ সংগ্রহের জন্য পাঠান। কেননা তিনি হুজায়ফা (রা.)-এর মধ্যে সেই বিচক্ষণতা দেখতে পান। হুজায়ফা (রা.) সে রাতের বিবরণ দিয়ে বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ থেকে বের হলাম এবং এমনভাবে হেঁটে এলাম যেন আমি গোসলখানায় (তথা ভেজা জায়গায় যেভাবে সাবধানে চলে) চলছি। ’ সে রাতে ফিরে আসার পর মহানবী (সা.) তাঁকে নিজের নামাজ পড়ার চাদরে আবৃত করে নেন। (মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ : ৩/১৯৮)
৭. আবু দুজানা (রা.) : উহুদের যুদ্ধে যেদিন মুসলিম বাহিনী সাময়িক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল, সেদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি তরবারি হাতে তুলে নিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা আমার কাছ থেকে কে নেবে?’ বহুজন হাত বাড়ালেও তিনি আবু দুজানা সাম্মাক বিন খারাশাতা (রা.)-এর হাতে তা তুলে দেন। তিনি তা হাতে নিয়ে শত্রু বাহিনীর কাতার ভেদ করে সামনে এগিয়ে যান। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৪৭০)
প্রশংসা প্রতিভা বিকাশে উৎসাহ দেয়: রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের গুণের প্রশংসা করতেন, যেন তাঁরা তা ধরে রাখতে উৎসাহিত হন এবং অন্যরা তাঁদের অনুসরণে আগ্রহ বোধ করে। যেমন তিনি বলেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে দয়ালু আবু বকর, তাদের মধ্যে দ্বিনের ব্যাপারে সবচেয়ে কঠোর ওমর, সবচেয়ে লজ্জাশীল উসমান, সবচেয়ে ন্যায়পরায়ণ আলী, সর্বোত্তম কোরআন পাঠকারী উবাই বিন কাব, হালাল-হারাম সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জ্ঞাত মুয়াজ বিন জাবাল প্রমুখ। ’