বর্তমানে সন্তান গ্রহণের একটি নতুন প্রযুক্তির নাম ‘সারোগেসি’। সারোগেসিকে অনেকে গর্ভ ভাড়া দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করে। যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের (এনএইচএস) সংজ্ঞা অনুযায়ী সারোগেসি হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে একজন নারী কোনো এক যুগলের জন্য গর্ভধারণ করে। যারা চিকিৎসা বা শারীরিক কারণে গর্ভধারণ করতে অক্ষম। সারোগেসির মাধ্যমে শিশুর আইনি মা-বাবা হয় ওই যুগল। (বিবিসি)
বর্তমানে এই পদ্ধতিতে সন্তান গ্রহণ করার প্রবণতা পৃথিবীর এক শ্রেণির মানুষের মাঝে বাড়ছে। মানুষকে এই পদ্ধতিতে সন্তান গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করতে, বহু বড় সেলিব্রেটিরা নিজেদের দেহাবয়ব ঠিক রাখতে এ পদ্ধতি গ্রহণ করছে বলে প্রচার করা হচ্ছে। নাউজুবিল্লাহ অনেক সমকামিরাও পরিবার শুরু করার জন্য এই পদ্ধতিতে সন্তান নিচ্ছে, যা সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এভাবে সন্তান গ্রহণ মানুষের বংশধারার পবিত্রতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। শুধু তা-ই নয়, এই পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম দিলে তার প্রকৃত মা-বাবা কারা হবে, মাহরাম (যাদের সঙ্গে বিয়ে বৈধ নয়) কারা হবে, তা নিয়েও জটিলতা সৃষ্টি হবে।
মহান আল্লাহ জৈবিক চাহিদা পূরণ ও সন্তান গ্রহণের জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তার থেকে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, যাতে সে তার কাছে শান্তি পায়। তারপর যখন সে তার সঙ্গে সংগত হয় তখন সে এক হালকা গর্ভধারণ করে এবং এটা নিয়ে সে অনায়াসে চলাফেরা করে। অতঃপর গর্ভ যখন ভারী হয়ে আসে তখন তারা উভয়ে তাদের রব আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, যদি আপনি আমাদের এক পূর্ণাঙ্গ সন্তান দান করেন তাহলে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। ’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ১৮৯)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে রাখে সংরক্ষিত, নিজেদের স্ত্রী বা অধিকারভুক্ত দাসীগণ ছাড়া, এতে তারা হবে না নিন্দিত, অতঃপর কেউ এদের ছাড়া অন্যকে কামনা করলে, তারাই হবে সীমালঙ্ঘনকারী। ’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ৫-৭) উল্লিখিত আয়াতগুলোতে মহান আল্লাহ, জৈবিক চাহিদা পূরণ ও বংশ বিস্তারের মাধ্যম হিসেবে বিশেষভাবে স্ত্রীকে চিহ্নিত করেছেন। এবং অধিকারভুক্ত দাসীর মাধ্যমে এই চাহিদা পূরণের বৈধতা দিলেও বর্তমানে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় এখন আর রাস্তাটি খোলা নেই। অতএব বর্তমান যুগে জৈবিক চাহিদা পূরণ ও সন্তান গ্রহণের একমাত্র মাধ্যম নিজের বিবাহিত স্ত্রী। এর বাইরে কারো মাধ্যমে এসব চাহিদা পূরণ নিষিদ্ধ। যদি কেউ এর বাইরে গিয়ে এসব চাহিদা পূরণ করে, তবে সে কোরআনের ভাষ্যমতে সীমালঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
অনেকে দাবি করতে পারে, সারোগেস পদ্ধতিতে নারী-পুরুষের মাঝে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপিত হচ্ছে না। তাহলে একে বিবাহবহির্ভূত ব্যভিচার বলে আখ্যা দেওয়া যায় না। এবং পাপের কাজ বলারও কোনো সুযোগ থাকে না। নি¤েœর আয়াত ও হাদিস দ্বারা তাদের এ ধারণাটি বদলে যাবে। প্রথমত পবিত্র কোরআনে নারীদের ফসলক্ষেত্র বলা হয়েছে, ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের স্ত্রী তোমাদের ফসলক্ষেত্র। সুতরাং তোমরা তোমাদের ফসলক্ষেত্রে গমন করো, যেভাবে চাও। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২২৩)
আর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, তার জন্য বৈধ নয় অন্যের ফসলে নিজের পানি সেচন করেন। ’ রুয়াইফি ইবনে সাবিত আল-আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, হানাশ (রহ.) বলেন, একদা রুয়াইফি আমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে ভাষণ প্রদানের সময় বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে যা কিছু শুনেছি তোমাদের শুধু তা-ই বলব। তিনি হুনাইনের দিন বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, তার জন্য বৈধ নয় অন্যের ফসলে নিজের পানি সেচন করেন। অর্থাৎ গর্ভবতী মহিলার সঙ্গে সঙ্গম করা। যে ব্যক্তি আল্লহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে তার জন্য বৈধ নয় কোনো বন্দি নারীর সঙ্গে সঙ্গম করা যতক্ষণ না সে সন্তান প্রসব করে পবিত্র হয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, তার জন্যও বৈধ নয় বণ্টনের পূর্বেই গনিমত বিক্রয় করা। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২১৫৮)
হাদিস শরিফে বর্ণনাকারী রাসুল (সা.)-এর বাণীকে ‘গর্ভবতী মহিলার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করা’ দ্বারা ব্যাখ্যা করার কারণ হলো, ইসলাম মানুষের বংশধারার পবিত্রতা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। যে নারীর জরায়ুতে অন্যের শুক্রাণু আছে বা থাকার সম্ভাবনা আছে, সে অবস্থায় তাকে বিয়ে করা বংশধারার পবিত্রতা অস্বচ্ছ করে দেয়। এবং হুমকির মুখে ফেলে দেয়। আরেকটি বিষয় হলো, পুরুষের জন্য এমন নারীর শরীরে শুক্রাণু প্রবেশ করানো জায়েজ নয়, যে তার জন্য ইসলামের দৃষ্টিতে হালাল নয়। তা হোক শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে, হোক ভিন্ন কোনো পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে। তা ছাড়া ব্যভিচারের অনেক স্তর আছে। ব্যভিচার মানে শুধু বিশেষ পদ্ধতির শারীরিক সম্পর্ক নয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, চোখের ব্যভিচার হলো (বেগানা নারীকে) দেখা, জিহ্বার ব্যভিচার হলো (তার সঙ্গে) কথা বলা (যৌন উদ্দীপ্ত কথা বলা)। (বুখারি, হাদিস : ৬২৪৩)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, দুই চোখের ব্যভিচার (বেগানা নারীর দিকে) তাকানো, কানের ব্যভিচার যৌন উদ্দীপ্ত কথা শোনা, মুখের ব্যভিচার উদ্দীপ্ত কথা বলা, হাতের ব্যভিচার (বেগানা নারীকে খারাপ উদ্দেশ্যে) স্পর্শ করা আর পায়ের ব্যভিচার হলো ব্যভিচারের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হওয়া এবং মনের ব্যভিচার হলো চাওয়া ও প্রত্যাশা করা। ’ (মেশকাত, হাদিস : ৮৬) অতএব ব্যভিচার নয় বলে এ পদ্ধতিকে জায়েজ বলার সুযোগ নেই। তা ছাড়া সারোগেসির মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুর মা আসলে কে হবেন, তা আইনি জটিলতা রয়েছে।
পবিত্র কোরআনের বিধান অনুযায়ী জন্মদাতা নারীই হয় সন্তানের মা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে জিহার করে (অর্থাৎ স্ত্রীকে বলে যে তুমি আমার জন্য আমার মায়ের পিঠের মতো) তাদের স্ত্রীরা তাদের মা নয়। তাদের মা তো শুধু তারাই, যারা তাদের জন্ম দিয়েছে। তারা অবশ্যই ঘৃণ্য ও মিথ্যা কথা বলে, নিশ্চয়ই আল্লাহ পাপ মোচনকারী, বড়ই ক্ষমাশীল। ’ (সুরা : মুজাদালাহ, আয়াত : ২) ফলে সারোগেট মায়ের অনেক আত্মীয়-স্বজন এই সন্তানের নিকট-আত্মীয় বলে বিবেচিত হবে। যাদের ও যাদের সন্তানদের সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এই সন্তানের জন্য হারাম হবে। কিন্তু যেহেতু সারোগেট মা তার ভাড়া পাওয়ার পর সন্তানকে ভাড়াদাতাদের কাছে হস্তান্তরের পর তাদের মধ্যে আর কোনো যোগাযোগ না-ও থাকতে পারে, তখন এই শিশু বড় হয়ে কিভাবে শনাক্ত করবে যে যার সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে, সে ওই সারোগেট মায়ের সূত্রে তার কোনো হারাম আত্মীয় হয়ে যায় কি না? সারোগেট মায়েদের তো এমন আরো অনেক সন্তান থাকতে পারে, যারা পরস্পর ভাই-বোন হবে, তাদের মধ্যে বিয়ে বন্ধনও হারাম হবে; কিন্তু বড় হওয়ার পর এগুলো শনাক্ত করাও তো সম্ভব হবে না।
আবার আন্তর্জাতিক আইনের দিক থেকে সারোগেসি মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুর আইনি অভিভাবক বা মা হিসেবে চিহ্নিত হন সারোগেট মা। এমনকি একজন সারোগেট মা যেকোনো সময় তাঁর ইচ্ছা পরিবর্তন করতে পারেন। জন্মের পর তিনি যদি সন্তানকে হস্তান্তর করতে না চান তাহলে তাঁকে বাধ্য করার কোনো আইন নেই। এমনকি অনেক সময় সন্তানের কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকলে তাঁকে নেওয়ার অস্বীকৃতিও জানাতে পারে মা-বাবা। এখানেও আইনি জটিলতা রয়েছে। এই জটিলতাগুলো সৃষ্টি হওয়ার কারণ হলো, একদিকে যেমন মা-বাবার শুক্রাণু ও ডিম্বাণু ব্যবহারের কারণে তাঁদেরই মা-বাবা বলা যায়, অন্যদিকে গর্ভ ভাড়াদাতা (সারোগেট মা) গর্ভধারণের কারণে তাঁকেও মা বলতে হয়। এক কথায় বলতে গেলে এ ধরনের পদ্ধতি উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি ডেকে আনবে। মানব বংশধারার পবিত্রতাকে হুমকিতে ফেলবে। সন্তানের বৈধতা প্রশ্নের মুখে পড়বে। তাই প্রতিটি মুসলমানের উচিত, এসব বিষয়ে সতর্ক থাকা। মহান আল্লাহ সবাইকে শয়তানের সূক্ষ্ম প্রতারণা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।