ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আরেক দফা বাড়লো ভোজ্যতেলের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়ায় ফের দেশের বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৭ টাকা এবং বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া পাঁচ লিটারে ৩৫ টাকা এবং পাম অয়েলে ১৫ টাকা বাড়ছে। গতকাল সোমবার থেকেই এ দাম কার্যকর হয়েছে। গত সোমবার বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ এ তথ্য জানিয়েছেন।
পিপিআরসি ও ব্র্যাক-বিআইজিডি জরিপের তথ্য বলছে, করোনা মহামারির এই সময়ের মধ্যে তিন কোটি ২৪ লাখ লোক দরিদ্র হয়েছে। নিত্যপণ্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে তেলের দাম বাড়ানো ভোক্তাসাধারণের ওপর অমানবিক চাপ সৃষ্টি করবে। কারণ তেলের সঙ্গে সবকিছুর একটা সংযোগ আছে। মুষ্টিমেয় অসাধু ব্যবসায়ী ও মজুদদার নানা অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে জনজীবনে দুর্বিষহ অবস্থা তৈরি করছে। এমতাবস্থায় পরিবহন খরচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও বাজার নিয়ন্ত্রণ না করে সাধারণ জনগণের ওপর বাড়তি মূল্য চাপিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত।
সর্বশেষ ২০২১ সালের ১৯ অক্টোবর সরকার নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬০ টাকা এবং খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৩৬ টাকা নির্ধারিত হয়। বোতলজাত সয়াবিনের ৫ লিটারের দাম ৭৬০ ও পাম অয়েলের দাম ছিল প্রতি লিটার ১১৮ টাকা। নতুন দাম অনুযায়ী, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ৮ টাকা বেড়ে ১৬৮ টাকা এবং খোলা সয়াবিন তেলের দাম ৭ টাকা বেড়ে ১৪৩ টাকা, বোতলজাত সয়াবিনের ৫ লিটারের দাম ৩৫ টাকা বেড়ে ৭৯৫ ও পাম অয়েলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বেড়ে ১৩৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব বলেন, গত ১৯ জানুয়ারি তেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলাম। তখন দেখা গেল আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার ফলে এটা সমন্বয় করা দরকার। ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল, অ্যাডজাস্ট না করলে তারা এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারবে না। বেশি দামের ভোজ্যতেল বিক্রিতে আমদানিকারকদের লোকসান হচ্ছে। আমদানিকারকদের হিসাবে শুধু ১৯ জানুয়ারিই ২০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। জানুয়ারির আমদানীকৃত ভোজ্যতেলের এলসি মূল্যের সঙ্গে হিসাব করে নতুন এ দাম ঠিক করা হয়েছে। তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি নিশ্চিত করে টিকে গ্রুপের পরিচালক (অর্থ ও পরিচালন) মো. শফিউল আক্তার তসলিম সাংবাদিকদের বলেন, বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বসার পর আমরা এতদিন ধরে লিটারপ্রতি সয়াবিন ১৬৫ টাকায় বিক্রি করেছি। এ হিসাবে নতুন করে সয়াবিনের দাম বেড়েছে মাত্র ৩ টাকা। আনুষ্ঠানিকভাবে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে ৮ টাকা, পাঁচ লিটারে ৩৫ টাকা। ঘোষণার পর থেকেই নতুন এ দাম কার্যকর হবে। তবে বাজারে এর প্রভাব পড়বে দু-তিনদিন পর, আগামী শুক্র-শনিবারের আগে বাজারে দাম বাড়ানোর প্রভাব পড়বে না।
তিনি আরো বলেন, এখন আমরা যে দাম নির্ধারণ করেছি সেটি আমদানি মূল্যের চেয়েও ১০০-১৫০ ডলার কম। গত দুই দিনে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও বেশি দামে কেনা ভোজ্যতেল প্রবেশ করায় এখনো ব্যবসায়ীদের লোকসান হচ্ছে। আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যে ফের দাম সমন্বয়ের বিষয়ে বৈঠকে না বসলে আমদানি ও ভোজ্যতেল পরিশোধন ব্যবসা করা কঠিন হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এর আগে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ার কথা উল্লেখ করে নতুন দাম কার্যকরের দাবি জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর গতকাল পর্যন্ত দাম না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এর মধ্যেই দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা।
গত রোববার দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমদানিকারকরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়ার পর থেকেই ভোজ্যতেলের পাইকারি বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। প্রায় দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি পর্যায়ে ভোজ্যতেলের দাম মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) বেড়েছে প্রায় ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা। ভোজ্যতেলের ট্রেডিং বাণিজ্যের কারণে সরকারিভাবে দাম বাড়ানো না হলেও পাইকারি ব্যবসায়ীরা ডিও লেনদেনের মাধ্যমে দাম আগে থেকেই বাড়িয়ে দিয়েছেন।
পাইকারি বাজারের ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানগুলোর সূত্রে জানা গেছে, দুই-তিন সপ্তাহ আগেও পাইকারিতে মণপ্রতি পাম অয়েলের দাম ছিল ৫ হাজার ১০০ থেকে ৫ হাজার ১৫০ টাকা। রোববার সন্ধ্যায় পাম অয়েলের দাম ছিল মণপ্রতি ৫ হাজার ৪০০ টাকা। অন্যদিকে সুপার পাম অয়েলের দাম মণপ্রতি ৩০০ টাকা বেড়ে লেনদেন হয়েছে ৫ হাজার ৬০০ টাকায়। এছাড়া সয়াবিনের দাম মণপ্রতি ২০০ টাকা বেড়ে লেনদেন হয়েছে ৫ হাজার ৮০০ টাকায়। পাইকারি বাজারে খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েলের সর্বশেষ দাম দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর আগে মণপ্রতি খোলা সয়াবিনের পাইকারি দাম ছিল ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা। ওই সময়ে পাইকারি পর্যায়ে পাম অয়েলের দাম ছিল মণপ্রতি প্রায় ২ হাজার টাকা। অথচ দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে দেশের বাজারে পণ্য দুটির দাম কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।
ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা দাবি করছেন, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি ছাড়াও শিপিং চার্জ বেড়ে যাওয়া এবং দেশে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ভোজ্যতেলের দেশীয় বাজারও অস্থির হয়ে উঠেছে। নিত্য ভোগ্যপণ্যের মধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি ক্রেতাদের মধ্যেও বাড়তি চাপ তৈরি করে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে ভোজ্যতেলের বাজার বাড়লেও অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দামেও প্রভাব পড়ে। তাছাড়া দেশে প্রায় ৯০ শতাংশ ভোজ্যতেলই আমদানিনির্ভর হওয়ায় বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি এবং দেশে চাহিদার তুলনায় আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ে সরাসরি খুচরা বাজারে। গত দুই বছরের ব্যবধানে দেশে ভোজ্যতেলের দাম অন্তত ২০ দফায় বেড়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ এক বছরে ভোজ্যতেলের বাজার ব্যবসায়ী ও সরকারি যৌথভাবে বেড়েছে ১০ বার। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বুকিং মূল্য বেড়ে গেলে দেশের বাজারেও দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় থাকে না বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
এদিকে ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, বৈশ্বিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের এ খাতে বিনিয়োগও বেশি করতে হচ্ছে। যার কারণে বিনিয়োগ বাড়লেও আয় কমে যাওয়া বা লোকসান হওয়ায় অনেক আমদানিকারক ভোজ্যতেল খাতে বিনিয়োগে সতর্ক। যার কারণে ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্ক হার না কমানো হলে দেশে ভোজ্যতেলের বাজার আরো অস্থির হয়ে নি¤œবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্তের ক্রয়সীমা অতিক্রম করার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারত সরকার ভোজ্যতেল আমদানি ও বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে এরই মধ্যে সাড়ে ৭ শতাংশ শুল্ক কমিয়েছে। আগে যেখানে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ ছিল, সেখানে মাত্র আড়াই শতাংশে ভোজ্যতেল আমদানির সুযোগ পাচ্ছে ওই দেশের ব্যবসায়ীরা। যার কারণে বৃহৎ চাহিদাসম্পন্ন দেশ ভারতের ভোজ্যতেলের বাজার বৈশ্বিক দাম বৃদ্ধি সত্ত্বেও মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশেও খুচরা বাজারে পণ্যটির দাম উপর্যুপরি বাড়লেও শুল্কহারে কোনো পরিবর্তন না আসায় বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।