বাংলাদেশ ভূখ-জুড়ে কিছু ক্ষুদ্র জাতিসত্তাবাদে আমরা কেবলমাত্র একটি ভাষাতেই সবাই কথা বলে থাকি। দ্বিতীয় বা বিকল্প কোনো ভাষার প্রয়োজন হয় না। এটি যে আমাদের কত বড় প্রাপ্তি সেটা উপলব্ধি করেছি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ভ্রমণে গিয়ে। হাতেগোনা দুচারটি প্রদেশ ছাড়া ভারতের সব প্রদেশ ঘুরে দেখার ও জানার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। নানা কারণে অসংখ্যবার ভারতে গিয়েছি। ভারতের মানচিত্রকে ভাগ করে অনেক দফায় সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল বিশাল ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। ভাষা-সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ ভারত নিঃসন্দেহে মহাদেশতুল্য।
পশ্চিমবঙ্গের অনেকে আমাদের দেশজুড়ে মাত্র একটি ভাষা প্রচলনের জন্য আমাদের ভাগ্যবান মনে করে। তাদের দেশে তো পরের কথা- নিজেদের প্রদেশেই প্রাদেশিক ভাষা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। প্রদেশজুড়ে বাংলা ভাষায় কথা বলার উপায় পর্যন্ত নেই। বিকল্প হিন্দির আশ্রয় নিতেই হয়। বাঙালিদের প্রদেশ পশ্চিমবাংলার রাজধানী কলকাতা নগরীতে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা আনুপাতিক হারে কমে সংখ্যালঘুতে দাঁড়িয়েছে। কলকাতা নগরীও এখন সম্পূর্ণরূপে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতিনির্ভর নয়। হিন্দির আগ্রাসনে এবং অন্য ভাষাভাষীদের প্রভাবে কলকাতায় বাংলা ভাষার প্রচলন মারাত্মক হ্রাস পেয়েছে। ট্রেনে, বাসে, রিকশায়, ট্যাক্সিতে, হাটেবাজারে, রাস্তায়-ফুটপাতে, শপিংমলে, হোটেলে যেখানেই কথা বলার প্রয়োজন হবে, কথা বলতে হয় ইংরেজি বা হিন্দিতে, বাংলায় নয়। কলকাতার বাঙালিরা পর্যন্ত অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পুরাতন কলকাতার বাসিন্দাদের সিংহভাগ বাঙালি হওয়ায় সেখানে বাংলা ভাষার একচেটিয়া প্রচলন ছিল একসময়। এছাড়া সেন্ট্রাল কলকাতাসহ পুরো কলকাতায় বাংলায় কথা বলার সুযোগ ক্রমাগত কমে আসছে।
লাখ লাখ মানুষ ডেইলি প্যাসেঞ্জার হয়ে দূরদূরান্ত থেকে কলকাতায় আসা-যাওয়া করে। বনগাঁ, রানাঘাট, চুঁচড়া, বর্ধমান, হাওড়া, উত্তর-দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব-পশ্চিম মেদিনীপুর এমনকি খড়গপুর থেকেও ট্রেনে-বাসে চেপে পেশাজীবী মানুষ কর্মস্থল কলকাতায় আসে এবং কাজ শেষে ফিরে যায় যে যার গন্তব্যে। ছুটির দিন ব্যতীত নিত্যই এ দৃশ্য দেখা যায়। শিয়ালদহ-হাওড়া-ধর্মতলার রেল ও বাস স্টেশনগুলোতে সকালে-বিকালের এ দৃশ্য নিত্যদিনের। কলকাতার স্থায়ী অনেক বাসিন্দা মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের কাছে উচ্চমূল্য পেয়ে বসতভিটা বিক্রি করে নতুন আবাস গড়েছে শহরতলি ও মফস্বলে। কলকাতা শহরে বাঙালি সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়ার এটাও অন্যতম কারণ। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কলকাতাকে এখন বাংলা ভাষা সংস্কৃতির একমাত্র শহর বলার উপায় নেই। বহু ভাষাভাষী, বর্ণ, স¤প্রদায় ও জাতির শহর কলকাতা। ভারতের বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের আবাস হওয়ায় সেখানে গড়ে উঠেছে মাড়োয়ারি, পাঞ্জাবি, গুজরাটি ভাষাভাষীদের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। সেখানে নিজ নিজ ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় তারা শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। অথচ বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো বন্ধ হওয়ার পথে।
বিশাল ভারতে স্বীকৃত ভাষা প্রায় সাতাশটি। এছাড়া রয়েছে অস্বীকৃত প্রচুর আঞ্চলিক ভাষাও। সরকারি ভাষা হিন্দি হলেও সরকারি ভাষার অবাধ প্রচলন কিন্তু সব প্রদেশে নেই। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে তো নয়ই। দক্ষিণ ভারতের চার রাজ্যের মধ্যে একমাত্র অন্ধ্র প্রদেশের রাজধানী সিকান্দ্রাবাদ-হায়দ্ররাবাদে হিন্দি-উর্দু ভাষার প্রচলন সামান্য দেখলেও অপর তিন রাজ্যের কোথাও হিন্দি ভাষার প্রচলন দেখিনি। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ উপনিবেশের গোড়া পত্তনে দেশীয় বিশ্বাসঘাতকদের অবদানের প্রচুর নজির রয়েছে। তেমন এক বিশ্বাসঘাতক হায়দ্ররাবাদের নিজাম। যার বিশ্বাসঘাতকতায় এবং সহযোগিতায় ইংরেজদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল বীর টিপু সুলতানকে পরাজিত এবং হত্যা করাও। প্রতিদানে ইংরেজ শাসকরা নিজামকে পুরস্কৃত করেছিল হায়দ্ররাবাদের শাসনকর্তা রূপে। ভারতের এ ধরনের অসংখ্য করদরাজ্য ছিল। ব্রিটিশ অধীন করদরাজ্যগুলোর শাসন ক্ষমতা ছিল দেশীয় শাসকদের হাতে। ইংরেজ তাঁবেদার মুসলিম শাসক নিজামদের কারণেই হায়দ্ররাবাদে তেলেগু ভাষার পাশাপাশি উর্দু ভাষার প্রচলন ছিল। সেই সুবাদে দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের রাজধানী হায়দ্ররাবাদে-সিকান্দ্রাবাদে হিন্দি-উর্দু ভাষার প্রচলন দেখেছি। তবে রাজধানীর বাইরে গোটা প্রদেশজুড়ে তেলেগু ভাষাই প্রচলিত। কেরালা, কর্ণাটক, অন্ধ্র ও তামিলনাড়ু দক্ষিণের এ চার রাজ্যে স্ব স্ব ভাষা ও সংস্কৃতি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দির প্রবেশের সুযোগ-উপায় কোনোটি নেই। ওই চার রাজ্যের মালায়ালম, কানাড়া, তেলেগু এবং তামিল ভাষার একমাত্র বিকল্প ভাষাটি হচ্ছে ইংরেজি, রাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দি নয়। নিজ ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি দক্ষিণের চার রাজ্যের সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধাবোধ-ভালোবাসা অভূতপূর্ব এবং শিক্ষণীয়ও বটে।
নিজেদের মাতৃভাষার দাবিতে রক্ত দিয়েও আমরা নিজ ভাষার প্রতি কি অতটা শ্রদ্ধাশীল হতে পেরেছি? আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু আমরা কি রাষ্ট্রভাষাকে সর্বস্তরে প্রচলন ও প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি? পারিনি। সে ব্যর্থতার দায় দুঃখজনক হলেও আমাদের বহন করতে হচ্ছে। দক্ষিণ ভারতের ওই চার রাজ্যের মানুষ রাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দিকে কেবল অগ্রহণ করেনি, সচেতনভাবেই প্রত্যাখ্যান করেছে। হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতি রুখতে দ্বিতীয় বা বিকল্প ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষাকে সানন্দে গ্রহণ করেছে। দক্ষিণ ভারতের চার রাজ্যের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত অন্য ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে বিকল্প ভাষা ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলে থাকে। চার রাজ্যের চার পৃথক ভাষা। কোনোটির সঙ্গে কোনোটির মিল নেই। মালায়ালম, কানাড়া, তেলেগু, তামিল এ চার ভাষাভাষীর মানুষ একে অপরের সঙ্গে যার যার মাতৃভাষায় নয়, কথা বলে বিকল্প ভাষা ইংরেজিতে। ভাষার প্রশ্নে কেউ কাউকে ছাড় দেয় না। নিজ ভাষা সংস্কৃতির প্রতি আনুগত্য-শ্রদ্ধাবোধ দেখে হতবাক হয়েছিলাম।
তামিলনাড়– প্রদেশের প-িচেরী গিয়ে ফরাসি ভাষার প্রচলন দেখে অবাক হয়েছিলাম। ব্রিটিশদের থেকে ফরাসিরা প-িচেরী অঞ্চলটি লিজ নিয়েছিল, তাই প-িচেরীতে ফরাসিদের দীর্ঘমেয়াদের এক উপনিবেশ ছিল। সেখানকার তামিল ভাষীরা অনেকে ফরাসি ভাষা-সংস্কৃতিতে পর্যন্ত পারদর্শী। শুনেছি ফরাসি সরকার নাকি প-িচেরীর মানুষের সুবিধা-অসুবিধা, দেখভালের জন্য এখনও সেখানে ফরাসি কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে রেখেছেন। বর্তমান ভারতের একটি প্রদেশ গোয়া, যা পর্তুগিজদের ব্রিটিশরা লিজ দিয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতার বহুপর ১৯৬১ সালে ভারতীয় বাহিনীকে পর্তুগিজদের সঙ্গে যুদ্ধ করে গোয়াকে পর্তুগিজমুক্ত করে ভারতের একটি প্রদেশে পরিণত করতে হয়েছিল।
সরকারি ভাষা হিন্দিকে পরিত্যাগ-প্রত্যাখ্যান করা তাদের উচিত হয়েছে কি? স্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারি ভাষা তবে হিন্দি হয়েছিল কেন? এমন প্রশ্ন দক্ষিণের মানুষের কাছে করেছিলাম। তাদের উত্তর ছিল; স্বাধীন ভারতের ক্ষমতাসীন শাসকরা হিন্দি ভাষী হওয়ায় পাশাপাশি ভারতীয় বণিক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষায় হিন্দি ভাষাকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল সব জাতির ওপর। ভারতের সব অঞ্চলের মুসলিম স¤প্রদায় উর্দু ভাষায় কথা না বললেও শিক্ষাক্রমে তাদের ভাষাটি উর্দু, হিন্দি নয়। সম্রাট আকবরের শাসনামলে সেনাবাহিনীর ফার্সি ও ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে কথোপকথনের প্রয়োজনে ফার্সি বর্ণমালা এবং হিন্দুস্থানী ভাষার মিশ্রণে উর্দিধারীদের জন্য যে ভাষার উৎপত্তি হয়েছিল তা-ই উর্দু ভাষা। এই উর্দু ভাষানির্ভর শিক্ষাক্রমে যুক্ত প্রায় প্রদেশের ভারতীয় মুসলিম স¤প্রদায়।
স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যটি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। ভারত একদিন স্বাধীন হবে। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা কী হবে? শান্তিনিকেতনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ অনেকের উপস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষের প্রদেশগুলোতে প্রাদেশিক ভাষার প্রচলন যেমন আছে ঠিক তেমনি থাকবে। তবে রাষ্ট্রভাষা হতে হবে ইংরেজি।’ তিনি যে কত দূরদর্শী এবং অগ্রবর্তী চেতনাসমৃদ্ধ ছিলেন তার এই মন্তব্যটি বর্তমান বাস্তবতায় এক অনন্য নজির। ভারতের প্রদেশগুলোতে প্রাদেশিক ভাষা রক্ষা-প্রচলন এবং ব্যবহারের সব দায়দায়িত্ব প্রদেশগুলোর হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হচ্ছে না; যেমন পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় বাংলাভাষীরা ইতিমধ্যে সংখ্যালঘুতে পরিণত। এছাড়া রয়েছে সর্বভারতীয় প্রচার-প্রতিষ্ঠার হাতছানি। খ্যাতিবান বাঙালি গায়ক, সুরকার, কাহিনীকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক হতে অনেক গুণী শিল্পী-কুশলীরা সর্বভারতীয় প্রচার- প্রতিষ্ঠার মোহে কলকাতা ছেড়ে মুম্বাই পাড়ি দিয়ে বাংলা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যহানিতে অবদান রেখে এসেছেন। বাংলা সংস্কৃতির ক্ষতিসাধন সেখান থেকেই শুরু। অথচ কলকাতার বাংলা চলচ্চিত্র, বাংলা গান একসময় উপমহাদেশজুড়ে প্রভাব বিস্তার করেছিল। আজকে বাংলা চলচ্চিত্রের যৎসামান্য সৃজনশীল চলচ্চিত্র ছাড়া সিংহভাগ বাংলা ছবিই হিন্দি এবং দক্ষিণ ভারতীয় ছবির রিমেক। অথচ বাংলা চলচ্চিত্রের রিমেক এবং বাংলা কথাসাহিত্য অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণের হিড়িক পড়েছিল ভারতজুড়ে। নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিসর্জন দিয়ে পরজীবী হওয়ার এ প্রবণতার কারণে ঐতিহ্যপূর্ণ বাংলা চলচ্চিত্র, বাংলা গান মোটেও মর্যাদার আসনে নেই। বাঙালি দর্শক-শ্রোতা পর্যন্ত অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে অপসংস্কৃতির দাঙ্গাবাজি-অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ হিন্দি ছবির নাচে-গানে। এতে করে মুনাফাবাজ চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে মওকার সুবর্ণ সুযোগ। বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির এ অপরিসীম ক্ষতির বিষয় বিবেচনা না করার খেসারত তাদেরই দিতে হচ্ছে চড়া মূল্যে। কলকাতার বাংলা টিভি চ্যানেলগুলো পর্যন্ত হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত নয়, হিন্দির ব্যবহার বাংলা চ্যানেলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে হিন্দি অনুষ্ঠানের রিমেক। অথচ সমৃদ্ধ বাংলা সংস্কৃতিকে দিয়ে নয়, হিন্দির অনুকরণে হিন্দি চ্যানেলের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা সংস্কৃতির সর্বনাশ নিজেরাই ডেকে এনেছে। মান্না দে শুরুতে সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠার মোহে মুম্বাই গিয়েছিলেন হিন্দি গানের জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে। এতে অধিক অর্থ উপার্জন এবং সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠার আকর্ষণ নিশ্চয়ই ছিল। অথচ তাকেও আক্ষেপে-শ্লেষে বলতে হয়েছে, ‘একমাত্র বাঙালি হওয়ার কারণে তার হিন্দি উচ্চারণ মুকেশ-মোহাম্মদ রফির মতো হতে পারেনি।’ শেষে এটাও বলেছেন, ‘হিন্দি গানের ভুবনে আই ওয়াজ অ্যান আউটসাইডার।’ ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে বলেছিলেন, একমাত্র বাঙালি হওয়ার কারণে এবং হিন্দি ভাষায় অধিক পারদর্শী নয় বলেই সব যোগ্যতার পরও দলে এবং সরকারে শীর্ষ পদপ্রাপ্তি তার হয়নি।
দক্ষিণ ভারতের চার রাজ্যে হিন্দি চলচ্চিত্র-হিন্দি গানের প্রবেশ তারা রুখেছে নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতির অধিকতর চর্চার মধ্য দিয়ে। নিজ ভাষার চলচ্চিত্র তাদের কাছে অধিক সমাদৃত বলেই হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্র সেখানে প্রবেশের সুযোগ পায়নি। দক্ষিণ ভারতীয়দের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হিন্দি জানে না, বুঝে না, তাই বলেও না। দক্ষিণের গায়ক-অভিনেতা-অভিনেত্রী অনেকে হিন্দি ছবিতে গান এবং অভিনয় করলেও মুম্বাইয়ে স্থায়ী হয়ে নিজেদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে ত্যাগ করেননি। তামিল গায়ক বালা সুব্রামনিয়াম দক্ষিণে এত জনপ্রিয় ও সমাদৃত যে তাকে বিমানে রিটার্ন টিকিট দিয়ে মুম্বাই বা অন্য কোথাও গান গাইতে নিতে হয়। প্রচুর হিন্দি গান গেয়ে সর্বভারতীয় জনপ্রিয়তা পেলেও, তিনি মোহে পড়ে চেন্নাই ছেড়ে মুম্বাইয়ে স্থায়ী হননি। অথচ বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির ঐতিহ্যপূর্ণ কলকাতার এমন দুর্দশা দেখে হতাশ হতে হয়। এক সময়ে কলকাতায় নির্মিত বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রের দাপুটে অবাঙালি অভিনেতা-গায়ক কেএল সায়গলের বাংলা উচ্চারণ নিয়ে সমালোচনা এবং কটাক্ষ করেছিলেন চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। অবাঙালি সায়গলের অশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণে বাংলা ভাষার ক্ষতির কথাও বলেছিলেন। হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্র নির্মাণের সব অনুরোধ-আবেদন সযতেœ প্রত্যাখ্যান করে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, যে ভাষা ভালোভাবে বলতে ও বুঝতে সক্ষম নন, সে ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করা তার পক্ষে অসম্ভব। অথচ এই সত্যজিৎ রায়কে পর্যন্ত এক পর্যায়ে ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ নামক হিন্দি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হয়েছিল। যার পেছনে হয়তো ইচ্ছের চেয়েও অধিক আর্থিক লোভনীয় কারণ নিশ্চয়ই ছিল। এই বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় যথার্থই বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষার সাহিত্য-সংস্কৃতির লালন-পালন পশ্চিমবাংলাকেন্দ্রিক থাকবে না। তা বাংলাদেশকেন্দ্রিকই হবে।’ তার সেই মন্তব্যের বাস্তবতা এখন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য হিন্দির প্রভাব প্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের ঘরে ঘরে ঢুকে পড়েছে।
ভারতের সর্ববৃহৎ চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি মহারাষ্ট্রের রাজধানী মুম্বাইয়ে। মুম্বাই চলচ্চিত্র শিল্পের বিশালতার তুলনায় মাদ্রাজ-কলকাতাসহ অন্যান্য প্রাদেশিক চলচ্চিত্র শিল্প অনেক অনেক পেছনে। মুম্বাইতে নির্মিত হিন্দি বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র যেমন সর্বভারতীয় চাহিদা পূরণ করছে, পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক প্রসারও লাভ করেছে। হিন্দি চলচ্চিত্র নির্মাণের একমাত্র এবং সর্ববৃহৎ ইন্ডাস্ট্রি মুম্বাই হলেও মুম্বাই হিন্দি বলয়ের কোনো প্রদেশ নয়। মহারাষ্ট্র রাজ্যের রাজধানী মুম্বাই। প্রদেশের প্রাদেশিক ভাষা মারাঠি। তবে হিন্দির আগ্রাসনে মারাঠি ভাষা আজ কোণঠাসা অবস্থায়। মারাঠি ভাষার চলচ্চিত্র, নাটক, গান নিয়ে মারাঠি ভাষার সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারাটি সচল থাকলেও হিন্দির আগ্রাসনে অনেকটা ম্রিয়মাণ। মারাঠিদের রাজধানী বন্দরনগরী মুম্বাইয়ে মারাঠিরা সংখ্যালঘু। ভারতের প্রায় সব প্রদেশের অসংখ্য মানুষকেই মুম্বাইয়ে দেখা যায়। সংখ্যায় যারা মারাঠিদের তুলনায় বর্তমানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। মুম্বাইয়ে হিন্দি ভাষার প্রচলন থাকলেও মহারাষ্ট্র রাজ্যজুড়ে মারাঠি ভাষার প্রচলন কিন্তু রয়েছে। মারাঠিরা হিন্দি ভাষায় কথা বলার ক্ষেত্রে দক্ষিণ ভারতীয়দের মতো একগুঁয়ে মনোভাব পোষণ করে না। অপর ভাষাভাষীদের সঙ্গে বিকল্প ভাষা হিসেবে রাষ্ট্রভাষা হিন্দিতেই কথা বলে থাকে। মুম্বাই নগরীও কলকাতার মতো সর্বভারতীয় মানুষের আবাসস্থল। নানা জাতি-স¤প্রদায়ের শ্রেণী-পেশার মানুষে ঠাসা। সেখানে মারাঠিদের আলাদাভাবে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবু মারাঠি ভাষার চলচ্চিত্র, নাটক, সাহিত্য-সংস্কৃতি মারাঠিরা পরিত্যাগ করে পুরো মাত্রায় হিন্দিমুখী হয়নি বলেই মারাঠি ভাষার সাংস্কৃতিক পরিম-ল স্বকীয়তায় নানা টানাপোড়েনে আজো টিকে আছে। তবে প্রতিনিয়ত তাদের হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে হচ্ছে।
১৯৮৮ সালে কলকাতার নাট্যদল ‘নান্দীকারে’র আমন্ত্রণে নাট্যোৎসবে অংশ নিতে ঢাকা থিয়েটারের সবাই কলকাতা গিয়েছিলাম। নাট্যোৎসবটি হয়েছিল রবীন্দ্রসদনে। বাংলা ভাষা ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন ভাষার নাটকও উৎসবে অংশ নিয়েছিল। সে উৎসবেই উৎপল দত্তের অভিনীত, লিখিত ও নির্দেশিত নাটক টিনের তলোয়ার দেখার সুযোগ হয়েছিল। নাটক শেষে অতিউৎসাহী আমি দৌড়ে গ্রিনরুমে গিয়ে বাস্তবের উৎপল দত্তকে দেখে অবাক হয়ে যাই। কিছুতেই মেলানো সম্ভব হচ্ছিল না। মাত্র একটু আগে যে মানুষটি বলিষ্ঠ যুবকের মতো মঞ্চ কাঁপিয়ে এলেন তিনি বয়সের ভারে নত। এই বয়সে এমন অভিনয় তার পক্ষেই সম্ভবপর হয়েছিল। ঢাকা থিয়েটারের কেরামত মঙ্গল নাটকটির প্রদর্শনীর দিন রবীন্দ্রসদন দর্শকে পরিপূর্ণ ছিল। অথচ নাটক শেষে দর্শকদের মাঝে তীব্র হতাশা ও ক্ষোভ লক্ষ করে কারণ জানতে চাইলে তারা যা বলেন তা শুনে রীতিমতো আঁতকে উঠি। কেরামত মঙ্গল নাটকের পূর্ববঙ্গীয় গ্রামীণ সংলাপ নাকি তাদের মোটেও বোধগম্য হয়নি। এজন্যই তাদের ক্ষোভ ও হতাশা। ‘নান্দীকার’-প্রধান রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত আক্ষেপে-শ্লেষে আমাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন-‘হিন্দি ভাষার দৌরাত্ম্যে কলকাতার বাঙালিদের এই দশা। হিন্দি শুনতে শুনতে তাদের কান নষ্ট হয়ে গেছে। হিন্দি বলতে বলতে বাংলা ভাষা পর্যন্ত ভুলতে বসেছে। সেখানে পূর্ববঙ্গীয় গ্রামীণ বাংলা ভাষার কেরামত মঙ্গল নাটকের সংলাপ তাদের বোধগম্য হওয়ার উপায় কোথায়?’
ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা। কলকাতাকে শাসক ইংরেজ সাজিয়েছিল লন্ডনের সাজে। কলকাতা হয়ে উঠেছিল প্রাচ্যের লন্ডন। কলকাতাকে কেন্দ্র করেই উপমহাদেশজুড়ে গড়ে তুলেছিল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য। ‘ভাগ কর এবং শোষণ কর’ নীতিতে বঙ্গভঙ্গের কূটচাল চেলেছিল চতুর ইংরেজ। সেই স্বপ্নের মোহভঙ্গে ক্ষুব্ধ ইংরেজ ১৯১২ সালে কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লি সরিয়ে নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা। ভারতবর্ষের অপরাপর জাতিসত্তার চেয়ে বাঙালিরা চিন্তা, কর্মে, মননে, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চাসহ রাজনীতিতেও ছিল অগ্রবর্তী। সেই বাঙালি সংস্কৃতির কলকাতা এখন অতীতের গৌরবময় ঐতিহ্য হারিয়ে বিপন্নপ্রায়। কলকাতার বাংলা ভাষার সাহিত্য এখনও মাথা উঁচু করে আছে বাংলাদেশের পাঠকের কারণে। বাংলা ভাষা ছেড়ে বাংলা সাহিত্যিকরা মুম্বাই ছুটেনি বা সাহিত্যিক ভাষার কারণে ছুটে যাওয়ার উপায় নেই বলে এখনও বাংলাসাহিত্য সৃষ্টিতে কলকাতার সাহিত্যিকরা অবদান রেখে যাচ্ছেন। তবে বাংলা ভাষার পাঠক কিন্তু ক্রমাগত কমে এসেছে। বাংলাদেশে যেমন পশ্চিমবঙ্গেও তেমনি। আমাদের দেশে প্রকাশনা শিল্পে উৎকর্ষ সাধনসহ প্রচুর বই প্রকাশিত হচ্ছে, তবে মোটা দাগের চটুল ও হালকা সেন্টিমেন্টের মাত্র ক’জন লেখকের বই-ই বাজারমাত করছে। সৃজনশীল গবেষণা, ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পন্ন লেখকের বই কিন্তু সে তুলনায় পাঠকপ্রিয়তা লাভে ব্যর্থ হচ্ছে। আমাদের তরুণদের মাঝে বিশেষ বিশেষ লেখকের চটুল বই কেনা এবং পড়া ফ্যাশনে দাঁড়িয়েছে। আমাদের জনসংখ্যার তুলনায় বই পড়ার পাঠক বাড়েনি বরং আনুপাতিক হারে কমেছে। নতুন প্রজন্মের খুব কম সংখ্যকই বই পড়ে। বেশিরভাগই কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেসবুক আর আকাশ সংস্কৃতির জ্বরে আক্রান্ত। পাঠকপ্রিয়তা লাভেই বইয়ের গুণাবলি বিবেচিত হয় না। বইয়ের দার্শনিকতা ও ইতিহাসনির্ভরতাই ভালো বইয়ের চূড়ান্ত মাপকাঠি। সেসব গুণাবলি সমৃদ্ধ বই পাঠকপ্রিয়তা না পাওয়ার মূলে রয়েছে আমাদের বিকলাঙ্গ চিন্তা-চেতনা সর্বোপরি রুগ্ন মানসিকতার তৎপরতা।
পশ্চিমবঙ্গের জেলা ও মফস্বলে বসবাসরত সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি বাংলা ভাষা-সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে সত্য; তবে সেখানেও হিন্দির আগ্রাসন ঢুকে পড়েছে। হিন্দি ছবি-সিরিয়াল, হিন্দি গানের ভক্তের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে বাংলা ভাষার ছবি, গান, সাহিত্য প্রীতি ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। প্রায় আটাশ বছর আগে পশ্চিমবাংলার চব্বিশ পরগণা, হাওড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর, নদীয়া, চুঁচড়া ইত্যাদি জেলায় শারদীয় পূজায় ঘুরতে গিয়েছিলাম। বারোয়ারি পূজা ম-পের মাইকগুলোতে হেমন্ত, সতীনাথ, শ্যামল, শচীন, মানবেন্দ্র, মান্না দে, তালাত মাহমুদ, সলিল চৌধুরী, সুচিত্রা মিত্র, সন্ধ্যা, ভূপেন, সাগর সেন, দেবব্রত প্রমুখ বাংলা গানের কিংবদন্তি গায়ক-গায়িকাদের জনপ্রিয় গান দিন-রাত বাজতে শুনেছি-দেখেছি। অন্য ভাষার গান বাজতে শুনিনি, দেখিনি। অথচ মাত্র ক’বছর আগে শারদীয় পূজায় ওই সব স্থানে গিয়ে দেখি সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। দেখি বারোয়ারি পূজাম-পে দিন-রাত মাইকে গান বাজছে, তবে বাংলা গান নয়, হিন্দি ছবির জনপ্রিয় গানগুলো, যেগুলোর বাদ্য-বাজনার আধিক্যে গানের কথা বোঝার উপায় থাকে না।
কলকাতার সুবিধালোভী মধ্যবিত্ত বাঙালি যেমন সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠার পেছনে ছুটতে গিয়ে বাংলা ভাষাকে পরিত্যাগ করে ইংরেজি-হিন্দিনির্ভর হয়ে উঠেছে, একইভাবে আমাদের দেশেও বিত্তবান এবং মধ্যবিত্তরা পার্থিব প্রতিষ্ঠার মোহে বাংলা ভাষার পাঠ্যক্রম পরিহার করে ইংরেজি মাধ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ভারতের প্রাদেশিক ভাষার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো প্রভাব বা চাপ যে নেই তা যেমন বলা যাবে না; তেমনিও বলা যাবে না রাজ্য সরকারগুলোর সীমাবদ্ধতার কথাও। আমাদের ক্ষেত্রে তো তেমন আশঙ্কা নেই। তবে আমরা কেন ওই একই পথে এগোচ্ছি? আমাদের অভিজাত শ্রেণী গণসমষ্টির বাইরে বিচ্ছিন্ন পৃথক এক জগৎ গড়ে তুলেছে। যার সঙ্গে গণসমষ্টির কোনো যোগসূত্রতা নেই। নেই কোনো মিলও। অভিজাতরা তাদের নিজস্ব সুযোগ-সুবিধার মসৃণ জগতটি গড়ে তুলেছে। অপরদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সুবিধাবঞ্চিত গণমানুষ এই সুবিধাভোগীদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। রাষ্ট্রের যত সুবিধা একচেটিয়া বিত্তবান-অভিজাতরাই ভোগ করে যাচ্ছে এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতাও তাদেরই হাতে। সমষ্টিগত মানুষ অধিকার এবং সুবিধাবঞ্চিত অতিসাধারণ এবং নিুমানের জীবনযাপন করলেও রাষ্ট্র এবং শাসকশ্রেণী তাদের পক্ষে কখনও ছিল না এবং আজও নেই। আজকে আমাদের রাষ্ট্রভাষাও অবহেলিত এবং বৈষম্যের শিকার। আমাদের সমাজে মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদী আকাঙ্ক্ষা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, বাংলাভাষা-সংস্কৃতির রক্ষায় নানা কর্মকা-ে যারা সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা অর্জন করেছেন, তাদের অনেকেই মধ্যবিত্তের আকাঙ্ক্ষা মুক্ত নন। তাদের সন্তানরা ইংরেজি মাধ্যমে এবং বিদেশে পড়াশোনা করছে। স্ববিরোধিতার রোগে আক্রান্ত এসব বরেণ্যব্যক্তি নিজেরা প্রচার মাধ্যমে যা বলেন নিজেদের পরিবারে সেটা পালন করেন না। বিকারগ্রস্ত মধ্যবিত্তের আকাঙ্ক্ষায় এসব ব্যক্তিবর্গ কার্যত অদ্ভুত প্রতারণায় নিজেদের যুক্ত করে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করে যাচ্ছেন। বিশ্বায়নের বিরূপ প্রভাবে ভাষা ও সংস্কৃতির স্বকীয়তা-বৈচিত্র এখন হুমকির কবলে। এর থেকে রক্ষা পেতে প্রত্যেক জাতিকে তার ভাষা-সংস্কৃতির রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে। ভাষা বৈচিত্র্যের পৃথিবীতে বৈচিত্র থাকাটা আবশ্যক এবং জরুরিও। সব জাতিসত্তার ভাষা-সংস্কৃতি টিকে না থাকলে পৃথিবী বৈচিত্র্যহীন হয়ে পড়বে। যেটা মোটেই কাক্সিক্ষত হতে পারে না।
ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দি। তাই হিন্দির প্রভাব ভারতজুড়ে থাকবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। প্রশ্নটা হল বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও কি পশ্চিমবঙ্গের মতো হিন্দির আগ্রাসন ঘটেনি? বেপরোয়া আকাশ সংস্কৃতির কারণে আমাদের দেশেও ঘরে ঘরে হিন্দি ছবি-সিরিয়াল থেকে হিন্দি অনুষ্ঠান দেখার আধিক্য মারাত্মক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের সংস্কৃতিতেও হিন্দির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। বেসরকারি টিভিগুলোতে-এর প্রভাব লক্ষ করা যায়। হিন্দি স্টেজ অনুষ্ঠানের আদলে এবং হিন্দি গানের প্রতিযোগিতার অনুকরণে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোতে চলছে একই ধারা। তবে ভাষা এখনও বাংলা, এই যা ভরসা। তবু এগুলো অবশ্যই হিন্দির রিমেক ব্যতীত অন্য কিছু নয়। পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যবরণ আমরা হয়তো করব না। তবে হিন্দির এই আগ্রাসনে আমাদের সংস্কৃতিতে-রুচিতে যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে তা উদ্বেগজনক। আমাদের সমাজে হিন্দি সংস্কৃতির উগ্র প্রভাব বৃদ্ধির নমুনা আমরা নিয়মিতই দেখছি। পাকিস্তানি শাসকরা দুই যুগব্যাপী আমাদেরকে উর্দুভাষীতে পরিণত করার প্রবল চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল। অথচ আজকে বাংলাদেশের শিশু-কিশোর থেকে সব বয়সী মানুষের মধ্যে হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতির প্রভাব প্রচলন নানাভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
স¤প্রদায়গত অভিন্নতা সত্ত্বেও ইরাক এবং তুরস্কের সংখ্যালঘু কুর্দি ভাষীদের ‘কুর্দিস্থান’ পৃথক রাষ্ট্রের দাবির মূলে রয়েছে কুর্দি ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষার কুর্দি জাতীয়তাবাদী তাগিদ। দেশ দু’টির সংখ্যাগরিষ্ঠ আরবি এবং তুর্কি ভাষীদের নিষ্ঠুর দমন-পীড়নেও কুর্দি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রাম দমন করা সম্ভব হয়নি। বরং স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি স্বাধীন পৃথক ‘কুর্দিস্থান’ রাষ্ট্রের দাবিতে পরিণত হয়েছে, যা সশস্ত্র রূপ পর্যন্ত ধারণ করেছে। ফার্সি জাতিসত্তার ইরানের সঙ্গে আরবদের স¤প্রদায়গত মিলও জাতিগত অমিলের কারণে বৈরিতায় পরিণত হয়েছে। আরবদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও পারস্য নিজেদের অধিক সমৃদ্ধ ফার্সি ভাষা-সংস্কৃতি ত্যাগ করে আরবি গ্রহণ করেনি। আরব ও ফার্সিদের জাতিগত বিরোধ-বিদ্বেষ সুদূর অতীতের মতো আজও টিকে আছে। নানাভাবে এই বিরোধ-বিদ্বেষের প্রতিফলন দেখা যায়। মুসলিম আরব রাষ্ট্রগুলোর আরব লীগে নিকট প্রতিবেশী ইরানকে অন্তর্ভুক্ত না করার মূল কারণটি জাতিগত ভিন্নতা। স¤প্রদায়গত অভিন্নতার চেয়েও জাতিগত ভিন্নতা আরবি-ফার্সি বিভাজনের ক্ষেত্রে মৌলিক কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বিস্ময় এই যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পাকিস্তানি হানাদার পাঞ্জাবিদের বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদ্গারের বিরূপ প্রভাব পড়েছিল ভারতীয় পাঞ্জাবিদের ওপর। বিক্ষুব্ধ ভারতীয় শিখ-পাঞ্জাবিদের প্রতিবাদের মুখে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স¤প্রচার বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছিল। পাকিস্তানি এবং ভারতীয় পাঞ্জাবিদের স¤প্রদায়গত ভিন্নতা হার মেনেছিল তাদের জাতিসত্তার কাছে। মানুষ তার সবকিছু পাল্টাতে পারলেও জাতিসত্তাকে পাল্টাতে পারে না। যে কেউ হিন্দু থেকে খ্রিস্টান, বৌদ্ধ থেকে মুসলিম, ইহুদি থেকে শিখ ধর্মাবলম্বী তাৎক্ষণিকভাবে সক্ষম হলেও, তার জাতিসত্তা কিন্তু পাল্টাতে পারে না। একজন বাঙালি বিলেতে পঞ্চাশ বছর বসবাস করে ইংরেজের সব কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ অভ্যস্ত এবং পারদর্শী হলেও তার পক্ষে ইংরেজ হওয়া অসম্ভব। একইভাবে কোনো জাতিসত্তার কেউ অন্য জাতিসত্তায় পরিণত হতে পারবে না। আর জাতিসত্তার ভিত্তিমূলেই হচ্ছে ভাষা।
একমাত্র ভাষানির্ভর নির্ভেজাল এবং যথার্থ জাতীয়তাবাদী চেতনাই পারে গণতন্ত্রকে বিকশিত করে সব মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে। তেমন প্রত্যাশাপূরণ আমাদের ক্ষেত্রে হয়নি। বারবার তা ব্যাহত হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের যে সাংস্কৃতিক উন্মেষ ঘটেছিল তা-ও বারবার পথ হারিয়েছে। ভাষা আন্দোলনের চেতনার ধারাবাহিকতায় স্বাধিকার আন্দোলন এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। ভাষার দাবিটিই মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত করেছিল। স্বাধীনতার পর সেই বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হলেও রাষ্ট্রভাষার সার্বজনীন প্রচলন ঘটেনি। বরং বৈষম্যের শিকার বাংলা ভাষা সাধারণের ভাষায় পরিণত হয়েছে। অপরদিকে বিত্তবান ও মধ্যবিত্তদের ক্ষেত্রে শিক্ষা-দীক্ষা এবং ভাষা-সংস্কৃতিতে বাংলার পরিবর্তে স্থান পেয়েছে হাওলাতি বিদেশি ভাষা। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রজুড়ে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা চরম আকার ধারণ করেছে। সমষ্টিগত উন্নতির বিষয়টিকে কেউ বিবেচনায় নিচ্ছে না। এ আত্মকেন্দ্রিকতার অবসান এবং সমষ্টিগত মানুষের মুক্তির মধ্য দিয়েই সমষ্টিগত মানুষের ভাষা-সংস্কৃতি সার্বজনীন হতে পারবে। অন্য কোনো বিকল্প পথে সম্ভব হবে না। মূল ব্যাধিটি বিদ্যমান ব্যবস্থা; সেটির আমূল পরিবর্তন কেবল জরুরি নয়- অপরিহার্যও বটে।