বেইজিং সীমান্ত চুক্তি লঙ্ঘনের পর চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বর্তমানে ‘অত্যন্ত জটিল অবস্থার’ মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শনিবার এ মন্তব্য করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। এ খবর দিয়ে ভারতের সরকারি বার্তা সংস্থা পিটিআই বলেছে- জয়শঙ্কর জোর দিয়ে বলেছেন, সীমান্ত পরিস্থিতি নির্ধারণ করবে সম্পর্ক। এদিন জার্মানির মিউনিখে ‘মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্স (এমএসসি) ২০২২ প্যানেল ডিসকাশন’-এ বক্তব্য রাখেন জয়শঙ্কর। তিনি বলেন, চীনের সঙ্গে ভারত সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। ৪৫ বছর ধরে পরিস্থিতি শান্ত ছিল। এ সময়ে স্থিতিশীল সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ছিল। ১৯৭৫ সাল থেকে সীমান্তে কোনো সামরিক ক্ষয়ক্ষতি ছিল না। উপস্থাপকদের এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন এস জয়শঙ্কর।
তিনি বলেন, কিন্তু সেই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। কারণ, চীনের সঙ্গে আমাদের চুক্তি আছে যে, সেনাবাহিনীকে (সীমান্তে) আনা যাবে না। আমরা এটাকে সীমান্ত বলি, আসলে এটা হলো প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি)। এর মধ্য দিয়ে চীন এসব চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। স্বাভাবিক বিষয় হলো, সীমান্তের পরিস্থিতি নির্ধারণ করবে রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক। তাই স্পষ্টতই বর্তমানে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক অগ্রসর হচ্ছে অত্যন্ত জটিল এক অবস্থার মধ্য দিয়ে। তিনি আরও বলেন, ২০২০ সালের জুনের আগেও ‘ওয়েস্টের’ সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ছিল শালীন। পাঙ্গোন লেক এলাকায় সহিংস সংঘর্ষ এবং উভয় পক্ষ ভারি অস্ত্রশস্ত্রসহ হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করার পর ভারত ও চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছে। এতে লাদাখের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় অচলাবস্থা। ২০২০ সালের ১৫ই জুন গালাওয়ান উপত্যকায় ভয়াবহ এক সংঘর্ষের পর এই উত্তেজনা দেখা দেয়।
গত সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন সফরে ছিলেন এস জয়শঙ্কর। সেখানে তিনি বলেছেন, লিখিত চুক্তির প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে চীন। এসব চুক্তিতে সীমান্তে গণহারে সেনা সমাবেশ না করার কথা বলে হয়েছে। কিন্তু সেই নিয়ম লঙ্ঘন করায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে বেইজিংয়ের কর্মকা- পুরো আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের জন্য বৈধ উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।
জয়শঙ্কর বলেন, যখন একটি বৃহৎ দেশ লিখিত প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে, তখন আমি মনে করি এটা পুরো আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের জন্য বৈধ উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারিজ পাইনে’র সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। মিউনিখে এমএসসি’তে ইন্দো-প্যাসিফিক বিষয়ক প্যানেল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন এস জয়শঙ্কর । এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ইস্যুতে সৃষ্ট উত্তেজনা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করা। সেখানে ইন্দো-প্যাসিফিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্নের জবাবে এস জয়শঙ্কর বলেন, আমি মনে করি না যে ইন্দো-প্যাসিফিক এবং ট্রান্সআটলান্টিক পরিস্থিতি বাস্তবে সাদৃশ্যপূর্ণ। সুনির্দিষ্টভাবে আপনার প্রশ্নের মধ্যে এমন ইঙ্গিত আছে যে, যেকোনোভাবেই হোক ভারসাম্য বন্ধ হয়ে আছে। আর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তা করছে একটি দেশ। আমি মনে করি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এভাবে অগ্রসর হয় না।
জয়শঙ্কর আরও বলেন, আমাদের বেশ কিছু আলাদা চ্যালেঞ্জ আছে, যা এখানে ঘটছে ইন্দো-প্যাসিফিকে। প্রকৃতপক্ষে ওই যুক্তির সঙ্গে যদি একটি সম্পর্ক থাকে তাহলে আপনি অনেক ইউরোপিয়ান শক্তি পাবেন, যারা এরই মধ্যে ইন্দো-প্যাসিফিকে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। আমরা তেমনটা দেখছি না। ২০০৯ সাল থেকে তেমনটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। আগ্রাসী চীন এ অঞ্চলে তার পেশীশক্তি নমনীয় করেছে।
তাইওয়ান, ফিলিপাইন, ব্রুনেই, মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনাম তাদের অংশের দাবি করলেও দক্ষিণ চীন সাগরের প্রায় পুরোটাই নিজেদের বলে দাবি করে চীন। তারা দক্ষিণ চীন সাগরে তৈরি করেছে কৃত্রিম দ্বীপ ও সামরিক স্থাপনা। পূর্ব চীন সাগর নিয়ে জাপানের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে আছে বেইজিং। এই দুটি অঞ্চলই খনিজ, তেল এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ওই অঞ্চল।
কোয়াড ইস্যুতে এস জয়শঙ্কর বলেছেন, এই ধারণার শুরু হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে। এটা ২০২০ সাল পরবর্তী অগ্রগতি নয়। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া- কোয়াডের এই অংশীদারদের সঙ্গে গত ২০ বছর ধরে আমাদের সম্পর্কের ক্রমউন্নতি হয়েছে। কোয়াডের নিজস্ব মূল্য আছে। এই চারটি দেশ একসঙ্গে এখন স্বীকার করে নিয়েছে যে, যদি তাদের মধ্যে সহযোগিতা অব্যাহত থাকে তাহলে বিশ্ব হবে আরো উন্নততর। তাই যা ঘটছে, তা অত্যাবশ্যক।
২০১৭ সালের নভেম্বরে ভারত, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়া দীর্ঘদিন মূলতবি একটি প্রস্তাব নিয়ে অগ্রসর হয়। তারা নতুন কৌশল নিয়ে কোয়াড গঠনের উদ্যোগ নেয়। এ অঞ্চলে চীনের সামরিক উপস্থিতির মধ্যে এর উদ্দেশ্য, কোনো প্রভাবমুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক রুটকে রক্ষা করা।