মাপে কম দেয়া এখন আমাদের সমাজে একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অথচ এটিকে মানুষের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ অনেক বড় অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। আল্লাহ এই নামে একটি সূরা নজিল করেছেন যার নাম হলো মুত্বাফফিফিন অর্থাৎ মাপে বা ওজনে কম দানকারী। এখানে মাপে কমদানকারীর পরিণতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
মক্কায় অবতীর্ণ এই সূরাটিতে আল্লাহ বলেছেন, ‘দুর্ভোগ মাপে কম দানকারীদের জন্য। যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণ মাত্রায় নেয় এবং যখন লোকদের মেপে দেয়, বা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।’ (মুত্বাফফিফিন : ১-৩)
কিয়ামতের দিন দুর্ভোগের একমাত্র পরিণাম হলো জাহান্নাম। মাপ ও ওজনে ইচ্ছাকৃতভাবে কমবেশি করে যারা, এটাই হবে তাদের পরকালীন পুরস্কার। মূলত এই পাপেই বিগত যুগে হজরত শোয়াইব আ:-এর কওম আল্লাহর গজবে ধ্বংস হয়ে গেছে। (সূরা হুদ-১১/৮৪-৯৪) ওই ধ্বংসের পুনরাবৃত্তি হওয়া এ যুগে মোটেই অসম্ভব নয়।
আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা মাপ ও ওজন পূর্ণ করে দাও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে। আমরা কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কষ্ট দেই না।’ (সূরা আনআম-৬/১৫২) তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা মেপে দেয়ার সময় মাপ পূর্ণ করে দাও এবং সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওজন করো। এটাই উত্তম ও পরিণামের দিক দিয়ে শুভ।’ (সূরা বনু ইসরাইল-১৭/৩৫) অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যথার্থ ওজন প্রতিষ্ঠা করো এবং ওজনে কম দিয়ো না।’ (সূরা রহমান-৫৫/৯)
মাপে ও ওজনে কম করা। এটি দু’ভাবে হতে পারে- ১, নেয়ার সময় বেশি নেয়া এবং ২. দেয়ার সময় কম দেয়া। মাপ ও ওজনে কমবেশির দ্বারা চুরির মাধ্যমে সামান্য কিছু অর্জিত হয় বলে এখানে হীনকর অর্থে শব্দটি আনা হয়েছে। এই কমবেশি করাটা কেবল মাপ ও ওজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি ইবাদত ও মুআমালাতের সব ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত। ইমাম মালেক রহ. বলেন, ‘বলা হয়ে থাকে যে, প্রত্যেক বস্তুর পূর্ণমাত্রা ও হ্রাসমাত্রা রয়েছে।’ অন্যরা বলেন, এমনকি অজু ও সালাতের মধ্যেও এটি রয়েছে। এরপর তিনি হজরত ওমর রা:-এর বক্তব্য থেকে দলিল পেশ করেন যে, একদা ওমর রা: জনৈক ব্যক্তিকে আছরের জামাতে হাজির হতে না দেখে বলেন, ‘তুমি কম পেয়েছ’। অর্থাৎ তুমি নেকি কম পেয়েছ। এমনিভাবে যে ব্যক্তি আল্লাহ ও বান্দার প্রাপ্য হক আদায়ে কমবেশি করে, সেও এই আয়াতে বর্ণিত ধমকির অন্তর্ভুক্ত হবে এবং তাকে ‘কমকারী’ বলা হবে।
মাপে ও ওজনে হেরফের করার জন্য পরকালে কঠিন শাস্তির দুঃসংবাদ শুনানোর কারণ হতে পারে দু’টি- ১. ওই ব্যক্তি গোপনে অন্যের মাল চুরি করে ও তার প্রাপ্য হক নষ্ট করে; ২. ওই ব্যক্তি আল্লাহর দেয়া অমূল্য জ্ঞান-সম্পদকে লোভরূপী শয়তানের গোলাম বানায়। জ্ঞান ও বিবেক হলো মানুষের প্রতি আল্লাহর দেয়া সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। আর এ জন্যই মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা। মানুষ যখন তার এই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান-সম্পদকে নিকৃষ্ট কাজে ব্যবহার করে, তখন তার জন্য কঠিনতম শাস্তি প্রাপ্য হয়ে যায়। আর সেই শাস্তির কথাই প্রথম আয়াতে শুনানো হয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘পাঁচটি বস্তু পাঁচটি বস্তুর কারণে হয়ে থাকে। এক. কোনো কওম চুক্তিভঙ্গ করলে আল্লাহ তাদের ওপরে তাদের শত্রুকে বিজয়ী করে দেন। দুই. কেউ আল্লাহর নাজিলকৃত বিধানের বাইরের বিধান দিয়ে দেশ শাসন করলে তাদের মধ্যে দারিদ্র্য ছড়িয়ে পড়ে। তিন. কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে অশ্লীল কাজ বিস্তৃত হলে তাদের মধ্যে মৃত্যু অর্থাৎ মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। চার. কেউ মাপে বা ওজনে কম দিলে তাদের জন্য খাদ্যশস্যের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয় এবং দুর্ভিক্ষ তাদের গ্রাস করে। পাঁচ. কেউ জাকাত দেয়া বন্ধ করলে তাদের থেকে বৃষ্টি বন্ধ করে দেয়া হয়’। (দায়লামি, হা-২৯৭৮; তাবারানি কাবির, হা-১০৯৯২, সনদ হাসান; সহিহ আত-তারগিব ওয়াত তারহিব হা-৭৬৫;সহিহুল জামে, হা-৩২৪০)
ইবনে আব্বাস রা: বর্ণিত অনুরূপ আরেকটি হাদিসে এসেছে- ১. যে জাতির মধ্যে খেয়ানত অর্থাৎ আত্মসাতের ব্যাধি আধিক্য লাভ করে, সে জাতির অন্তরে আল্লাহ শত্রুর ভয় নিক্ষেপ করেন। ২. যে জাতির মধ্যে যেনা-ব্যভিচার বিস্তার লাভ করে, সে জাতির মধ্যে মৃত্যুহার বেড়ে যায়। ৩. যে জাতি মাপে ও ওজনে কম দেয়, তাদের রিজিক উঠিয়ে নেয়া হয়। ৪. যে জাতি অন্যায় বিচার করে, তাদের মধ্যে খুন-খারাবি ব্যাপক হয়। ৫. যে জাতি অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তাদের ওপর শত্রুকে চাপিয়ে দেয়া হয়।’ (মুওয়াত্তা মালেক, মিশকাত হা-৫৩৭০ রিক্বাক্ব অধ্যায়-৭ অনুচ্ছেদ; সহিহ হা : ১০৬-১০৭) মাপে কম দেয়ার বিষয়টি এতটাই খারাপ যে আল্লাহ সূরা মুত্বাফফিফিনে বলছেন, ‘তারা কি কিয়ামতে বিশ্বাস করে না। কেননা, তারা যদি কিয়ামতে সত্যিকারের দৃঢ় বিশ্বাসী হতো, তাহলে কখনোই মাপ ও ওজনে কম দেয়ার মতো নিকৃষ্টতম পাপ তারা করতে পারত না।’
উমাইয়া বংশের দোর্দ- প্রতাপশালী খলিফা আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান (৬৫-৮৬/৬৮৫-৭০৫ খৃ.) বলেন, তার সম্মুখে একদিন জনৈক বেদুইন দাঁড়িয়ে বলল, আপনি কি সূরা মুত্বাফফিফিন পড়েছেন? সেখানে আল্লাহ কি কঠিন ধমকি দিয়েছেন? আপনি যে মুসলমানদের মাল-সম্পদ বিনা মাপে ও বিনা ওজনে নিয়ে থাকেন এ বিষয়ে আপনার নিজের ব্যাপারে কী ধারণা?’ (কুরতুবি) বেদুইনের এই বক্তব্যে যেমন খলিফার বিরুদ্ধে ইনকার ও বিস্ময় ফুঠে উঠেছে, এ আয়াতেও তেমনি মাপ ও ওজনে কম দানকারীদের বিরুদ্ধে আল্লাহর পক্ষ থেকে ইনকার ও বিস্ময় ফুঠে উঠেছে।
কুরআনের আলোচ্য আয়াত ও বিভিন্ন হাদিসে মাপ ও ওজনে কম করাকে হারাম করা হয়েছে এবং সঠিকভাবে ওজন ও পরিমাপ করার জন্য কড়া তাগিদ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে- ‘ইনসাফ সহকারে পুরো ওজন ও পরিমাপ করো। আমি কাউকে তার সামর্থ্যরে চেয়ে বেশির জন্য দায়িত্বশীল করি না।’ (সূরা আল-আনআম-১৫২) আরো বলা হয়েছে- ‘মাপার সময় পুরো মাপবে এবং সঠিক পাল্লা দিয়ে ওজন করবে।’ (সূরা আল-ইসরা-৩৫) অন্যত্র তাকিদ করা হয়েছে- ‘ওজনে বাড়াবাড়ি করো না, ঠিক ঠিকভাবে ইনসাফের সাথে ওজন করো এবং পাল্লায় কম করে দিয়ো না।’ (সূরা আর-রহমান : ৮-৯) শোয়াইব আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের ওপর এ অপরাধের কারণে আজাব নাজিল হয় যে, তাদের মধ্যে ওজনে ও মাপে কম দেয়ার রোগ সাধারণভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং শোয়াইব আলাইহিস সালাম বারবার নসিহত করা সত্ত্বেও এ সম্প্রদায়টি এ অপরাধমূলক কাজটি থেকে বিরত থাকেনি।
ব্যবসায় একটি পবিত্র পেশা। পবিত্রতা ও সততার মাধ্যমে ব্যবসায় পরিচালিত হলে সেখানে অন্যায়-অনিয়ম ঠাঁই পেতে পারে না। ক্রেতা-বিক্রেতা কেউই ঠকবে না সৎভাবে ব্যবসা করলে। কিন্তু ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সেই সততা ও পবিত্রতার ঘাটতি বর্তমানে ব্যাপকহারে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ঠকবাজি ও জুয়াচুরির মাধ্যমে ওজনে কম দেয়া বা বেশি নেয়া মাত্রারিক্ত হারে বেড়ে চলছে।