আজ বৃহস্পতিবার ১৭ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট হাউজে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় দফায় এক ঘণ্টা আলোচনা হয়। আলোচনাকালে আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দীন আহমদ, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীসহ ঘনিষ্ঠ ছয়জন শেখ মুজিবের সাথে ছিলেন। ইয়াহিয়ার সাথে ছিলেন তার সামরিক উপদেষ্টারা। আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট হাউজ থেকে বের হয়ে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, আলোচনা শেষ হয়নি, আরো হবে। প্রেসিডেন্ট আমাদের দাবিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখার জন্য সময় চেয়েছেন। আমি তাকে সময় দিয়েছি। তারা যত খুশি বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখুক। আমাদের আর একচুলও নড়ার ক্ষমতা নেই। আমাদের ছয় দফা দাবি তাদের মানতে হবে। ছয় দফা এখন আমি, আমার বা আওয়ামী লীগের নয়। এ দেশের জনগণেরই সম্পত্তি। এদিন বিকেলে শেখ মুজিব আবার তার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে আলোচনায় বসেন। জনৈক বিদেশী সাংবাদিক তাকে বলেন, আজ আপনার ৫১তম জন্মদিবস। সে উপলক্ষে কিছু বলুন। তিনি জবাব দিলেন, আমি আমার জন্মদিন পালন করি না। এ দেশে প্রতিদিনই মানুষ গুলী খেয়ে মরছে। এ দেশে জন্মদিনই কি আর মৃত্যুদিনই বা কি? আমার জীবনই বা কি? এদিনও অসংখ্য মিছিল শেখ মুজিবের বাস ভবনের সামনে যায় এবং এই মহান নেতাকে তার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়। তিনিও মিছিলকারীদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করে তার জবাব দেন। এদিন তার কণ্ঠে বার বার উচ্চারিত হতে থাকে- ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি / সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।’ এদিনের আলোচনা সম্পর্কে তখন সাংবাদিকদের শেখ মুজিব তেমন কিছু না বললেও তার আইন ও সংবিধান বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল হোসেন (বর্তমানে গণফোরাম সভাপতি) পরবর্তীকালে জানিয়েছেন, ১৭ মার্চের বৈঠকেও বঙ্গবন্ধু অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়েছেন। মুজিব-ইয়াহিয়া এবং দু’পক্ষের উপদেষ্টা ও নেতৃবৃন্দের বৈঠকের ফলে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার মধ্যে সঙ্গত কারণে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল। সে পরিস্থিতিতে সুস্পষ্ট বক্তব্য রেখেছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি এদিন বলেছিলেন, ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবের মধ্যে আপোষ বা সমঝোতার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। কোনো সমঝোতা হলে জনগণ তা মেনে নেবে না। আগামী ২৫ মার্চের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ইয়াহিয়া এখন যা করতে পারেন তা হলো অন্তর্র্বতীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা, যার কাজ হবে দু’অংশের সম্পদ ও দায় দেনা হিসাব করা এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে দু’ অংশের মধ্যে তা বণ্টন করা।
২০১৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তিসেনানী লে. কর্নেল (অবঃ) আবু ওসমান চৌধুরী তার ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১’ গ্রন্থে সংক্ষেপে একাত্তরের এদিনের ঘটনাপ্রবাহ সংক্ষেপে তুলে ধরে বলেন, “ইয়াহিয়া ও মুজিব দ্বিতীয় দফা বৈঠকে বসলেন। বৈঠক মাত্র এক ঘণ্টাকাল স্থায়ী হয়। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বহু প্রশ্নের উত্তরে শেখ সাহেব শুধু বললেন, আলোচনা চলবে। জনতা ‘জয়বাংলা’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুললো। এবার সকলের কাছে এটা পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পাকিস্তানে বসে বাঙালি নিধনের যে নীল-নকশা তৈরি করেছেন, তা কার্যকরী করার জন্যই তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। তার সামরিক প্রস্তুতিতে গোপনীয়তা রক্ষার শত চেষ্টা থাকলেও বাঙালি সামরিক ব্যক্তিগণ আকাশ ও নৌপথে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী চলাচলের সব গোপন খবরই নেতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছিলেন। দেশের বিভিন্ন স্থানের বাঙালি সৈনিকরা বিশেষ করে ইপিআর সদস্যরা আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের নির্দেশের অপেক্ষায় প্রতিদিন শুধু উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলো।”
আরেক মুক্তিসেনানী মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম পিএসসি তার ‘বিদ্রোহী মার্চ ১৯৭১’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “১৭ই মার্চ সামরিক আইন প্রশাসকের পক্ষ থেকে এ ঘোষণায় বলা হলো, ২ মার্চ থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করার জন্য কোন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী তলব করা হয়েছিলো তা তদন্ত করে দেখার জন্য একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে। সামরিক কর্তৃপক্ষের এই ঘোষণা জনতা মেনে নিলো না। তদন্ত কমিশনের নামে প্রহসন হবে বলে তারা মনে করলো। শেখ মুজিব দুঃখ করে বললেন। আমি দুঃখের সাথে বলছি যে, জনগণের পক্ষ থেকে আমি যে দাবি জানিয়েছি ঘোষিত তদন্ত কমিশন যে পূরণ করতে পারবে না, কমিশনের প্রকৃতি দেখেই তা বোঝা যায়। সামরিক আদেশ বলে এর গঠন এবং সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে এর রিপোর্ট পেশের ব্যবস্থা দুই-ই অত্যন্ত আপত্তিকর।