দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে রাজধানীর সড়ক যোগাযোগে নদী পারের গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ও রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাট। কিন্তু এই নৌপথ দিয়ে নির্বিঘেœ পদ্মা পাড়ি দেওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারেন না চালক ও যাত্রীরা। নদী পারাপারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাট এখন দুর্ভোগের আরেক নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া ঘাট অফিস সূত্রে জানা গেছে, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথ সচল থাকলে এবং ১৯-২০টি ছোট-বড় ফেরি চলাচল স্বাভাবিক থাকলে প্রতিদিন গড়ে চার হাজার ২০০টি যানবাহন দৌলতদিয়া ঘাট পার হতে পারে। সেই হিসাবে পাটুরিয়া ঘাট থেকে চার হাজার ২০০টি বিভিন্ন প্রকার যানবাহন নদী পার হয়ে দৌলতদিয়া ঘাটে আসে।
নদী পারাপারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়: তবে দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য, উভয় ঘাটের অব্যবস্থাপনা, নদীতে নাব্যতা সংকট, ঘাটের স্থায়ী টার্মিনাল ব্যবহার না করা, ট্রাফিক পুলিশ, বিআইডব্লিউটিসি ও বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের সমন্বয় না থাকায় উভয় ঘাটে প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ পোহাতে হয় চালক ও যাত্রীদের।
সক্রিয় দালাল চক্র: একাধিক ট্রাকচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সন্ধ্যার আগ থেকে দালাল চক্রের আনাগোনা শুরু হয়। চলে শেষ রাত পর্যন্ত। দালাল চক্র বিভিন্ন প্রকার পণ্যবাহী ট্রাকচালকদের থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে অনৈতিক সুযোগ করে দেয়। পেছনের গাড়ি সামনে নেওয়ার ব্যবস্থা করে। পণ্যবাহী ট্রাকগুলোর মধ্যেও প্রকারভেদ রয়েছে। মাছের গাড়ি, দেশি-বিদেশি ফলের ট্রাক, কাঁচামালের ট্রাক ও অপচনশীল পণ্যবাহী ট্রাক দৌলতদিয়া ফেরি ঘাট ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত নদী পার হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব গাড়ি নিয়ম ভেঙে ফেরি পার করার জন্য ট্রাক মালিকদের রয়েছে নির্ধারিত দালাল গ্রুপ। টাকার বিনিময়ে তারা এসব গাড়ি সামনে নিয়ে যায়। এতে উভয় ঘাটে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এবং দিনের পর দিন অপেক্ষা করে নদী পার হতে হয় যানবাহনগুলোকে।
পদ্মায় নাব্য সংকট: পদ্মা নদীর পানি কমে যাওয়ায় উভয় ঘাটে নাব্য সংকট দেখা দিয়েছে। যে কারণে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে রয়েছে অসংখ্য ডুবোচর। ডুবোচর ও নাব্য সংকট থাকায় যানবাহন পারাপারে অতিরিক্ত সময় ব্যয় হচ্ছে। ফেরিগুলোকে ঘাটে ভিড়তে অনেক দূর থেকে ঘুরে পন্টুনের কাছে আসতে হচ্ছে। পন্টুনগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে নিচু হয়ে গেছে। এতে ফেরিতে ওঠানামা করতে অনেক যানবাহন বিকল হয়ে যায়।
নদী পারে প্রতিটি ফেরিতে দ্বিগুণ সময় ব্যয় হচ্ছে। তবে নদীর নাব্যতা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটে একাধিক ড্রেজিং করা হচ্ছে।
দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটে অব্যবস্থাপনা: ট্রাফিক পুলিশ, বিআইডব্লিউটিসি ও বিআইডব্লিউটিএ-তে কর্মরত কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া উভয় ফেরি ঘাটে উপস্থিত থাকেন। দৌলতদিয়া ঘাট থেকে মহাসড়কের পাঁচ-ছয় কিলোমিটার পর্যন্ত কর্মরত থাকেন ট্রাফিক পুলিশ। তাদের ‘অগোচরে’ দালাল চক্র অনিয়ম করে। এতে যানজট বেড়ে যায়।
বিআইডব্লিউটিসি’র কর্মরত অফিসারদের সহযোগিতায় পল্টুনে ফেরি রাখার অনেক আগে যানবাহনগুলো পল্টুন ও সংযোগ সড়কে রাখে। এতে প্রতিটি ফেরি থেকে যানবাহন আনলোড করতে অনেক সময় ব্যয় হয়। বিআইডব্লিউটিএ’র মালিকানাধীন দৌলতদিয়া ঘাটে দুটি টার্মিনাল রয়েছে। তবে টার্মিনালগুলোতে যানবাহন না রেখে মহাসড়কে দীর্ঘসারি দিয়ে রাখতে দেখা যায়। এদিকে টার্মিনালগুলোর জায়গা অনেকে দখল করে ব্যবসাবাণিজ্য করছে। এমনকি প্রতিটি ট্রাক থেকে ৭০ টাকা টোল আদায় করেও তারা টার্মিনালে ট্রাক প্রবেশ করান না।
লালমিয়া নামের এক কাঁচামাল ব্যবসায়ী জানান, ফেরি বুকিং কাউন্টারে ১৪০ টাকার বেশি এবং দালাল চক্রকে পাঁচশ’ টাকা না দিয়ে কোনোভাবেই টিকিট পাওয়া সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ফেরির টিকিট সংগ্রহ করতে হয়।
শুকুর আলী নামে একজন বলেন, অতিরিক্ত টাকা দিয়েও সবকিছু সহজ নিয়মে হয়। না দিলে অস্বাভাবিক ও অসহ্য ভোগান্তি পোহাতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে ফেরি পার হতে হয়। বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া ঘাট শাখার ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) শিহাব উদ্দিন জানান, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে ফেরি সংকট নেই। তবে এই পথে বর্তমানে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ রয়েছে। যে কারণে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ঘাটে কিছু যানবাহন ফেরি পারের অপেক্ষায় থাকে। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যানবাহনের চাপ একটু বেড়ে যায়। অধিকাংশ দিনে বিকালের মধ্যে যানবাহনের চাপ আবার কমে যায়। রাজবাড়ী ট্রাফিক পুলিশ ইন্সপেক্টর (টিআই) তারক পাল জানান, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে অতিরিক্ত যানবাহন আসছে প্রতিনিয়ত। যে কারণে যানবাহনের চাপ থাকে।- বাংলাট্রিবিউন