বরিশাল সদর উপজেলার লাহারহাট-ভোলা ফেরিঘাট সংলগ্ন বুখাইনগর খাল ও বিঘাই নদীর মোহনায় বছরের পর বছর ধরে ‘মানতা’ সম্প্রদায় গোষ্টির বসবাস করে আসছে। এ সম্প্রদায়ের প্রতিটি সদস্য নদীতে নৌকায় ভেসে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিচ্ছে পুরোটা জীবন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ছোট্ট একটা নৌকাকে ঘিরেই তাদের ঘর-বাড়ি-সংসার নৌকায় জন্ম নৌকাতেই মৃত্যু। সূর্য যখন পশ্চিমে হেলে পড়ছে তখন লাহারহাটের মানতা পল্লির নাছিমা বেগম ডিঙ্গি নৌকার ভেতরেই রাতের ও সেহরির খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। স্বামী আবুল কালাম ইফতার কিনতে পার্শ্ববর্তী বাজারের উদ্দেশে পারাপারের নৌকায় চেপে বসেছেন। রান্নার কাটাকুটির মাঝেই এক প্রর্যায়ে নাছিমা বেগম বলেন, ‘এফতারের সময় ঘনাইয়া আইছে। আলো থাকতে থাকতে রান্নাডা হাইর্যা রাখতে চাই। নিষেধাজ্ঞার লাইগ্যা মাছ ধরা বন্ধ কিন্তু এডা দিয়াই মোরা আয়-রোজগার হরি। হ্যারপরও রাইতে আর সেহেরিতে খাওয়ার লাইগ্যা কয়ডা মাছ লইছি, হ্যার লগে ডাইল আর ভাত রান্দুম। ‘মোগো নৌকার জীবনে অনেক হিসাব কইর্যা চলতে হয়। রোজার সময় এফতারি হগোলডি কিইন্যা আনে দোহান দিয়া, নৌকায় খালি রাইতের আর সেহেরির খাবার রান্দি। তয় এফতারি কিইন্যা লইয়্যা আইলে ঘরের সবাই একলগে নৌকায় বইস্যা আজান দেলে হেডা খাই। নৌকা অইলো মোগো ঘর নৌকায় মোগো ঘুমান-রান্দোন-বাড়োন-খাওন-দাওন সব। এই নৌকা লইয়্যাই নদীতে মাছ ধইর্যা বেচি, কামাই হরি। পল্লির আরেক বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ কোহিনুর বেগম জানান, এ পল্লিতে মোটামুটি সবাই রোজা রাখেন। সেহরির সময় লাহারহাট বাজারের মসজিদের মাইকে ডাকা হয় ঠিকই, তবে তার আগেই এখানকার নারীদের ঘুম ভেঙে যায়। একজনের ঘুম ভাঙলে পাশের নৌকায় থাকা অন্য পরিবারের সদস্যদেরও ডেকে তুলে দেন তিনি। সেহরি শেষ করে নারীরা নৌকাতেই নামাজ পড়ে, পুরুষরা যায় বাজারের মসজিদে। তিনি আরও জানান, বর্তমানে নদীতে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় এবং কোস্টগার্ড ও পুলিশের টহল থাকায় পল্লির কেউ মাছ ধরতে যাচ্ছে না। প্রতিটি পরিবার নিজেদের খাওয়ার জন্য খাল থেকে কিছু মাছ ধরে। তবে তাও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি নয়। আর রান্নার কাজটি দিনের আলো থাকতে থাকতেই সেরে ফেলেন সবাই। পল্লিতে ইফতারের খাবার তৈরির কোনো আয়োজন হয় না জানিয়ে কোহিনুর বলেন, ‘এফতারের মালামাল কিইন্যা নৌকায় আইন্যা রাইন্দা খাওয়ার সোমায় নাই। তাই এফতার কিইন্যা আইন্যা নৌকায় বইয়্যা পরিবারের সবাই মিইল্যা খাই। কফালে থাকলে যেদিন ভালো এফতার জোডে, হেদিন হউর-হাউরি, পোলাপান, নাতি-নাতকুর লইয়্যা এফতার হরি। ’ মানতা পল্লির হাফেজ বলেন, ‘পল্লির ব্যাডাগুলার হগোলডি রোজা থাহে না। আর যারা থাহে হ্যাগো মধ্যে বুড়া ও বয়স্করা এফতার করে লাহারহাট বাজারের দুইডা মসজিদে। হ্যাহানে বড়লোকরা ইফতার করায় মোগো। আর পল্লির মাতারি ও বাচ্চাডিসহ মধ্যমবয়সীরা এফতার কিইন্যা লইয়া নৌকায় ফেরত যায়।
হ্যাহানে হ্যারা সবাই মিইল্যা এফতার করে। তবে মাছ শিকার বন্ধ থাকায় বর্তমান সময়টাতে অনেকেই খারাপ দিন পার করছে বলে জানিয়েছেন পল্লির সর্দার জসিম। তিনি জানান, দেড়শর ওপরে পরিবার আছে এই পল্লিতে। এর মানে দেড়শ নৌকা। যাদের সবাই মুসলমান, জীবিকা নির্বাহের প্রধান পেশা মাছ শিকার। পল্লির সবাই ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, ঈদ উৎসব পালন করেন। তবে সবকিছুর ভালোমন্দ নির্ভর করে পরিবারের উপার্জনের ওপর। মাছ শিকার বন্ধ থাকায় এখন সবার আয় বন্ধ। মানতা পল্লির সর্দার আরও জানান, রোজার মাসে ইফতার-সেহরির জন্য প্রতিটি পরিবারের বাড়তি খরচ আছে। রমজানের শেষ পর্যন্ত সবাই ঠিকভাবে সেই খরচ সামাল দিতে পারে না। তখন সর্দারসহ যাদের অবস্থা ভালো তারা অন্যদের ধারকর্য দিয়ে সহায়তা করেন। পল্লির বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দা ছাত্তার বলেন, ‘করোনার সোমায় কিছু চাইল-ডাইল পাইছেলাম, গত বছর রোজায় কিছু ছোলাবুটও পাইল্লাইম। হ্যাগুলা নৌকায় রাইন্দা এফতার করছেলাম। এইবার কিছুই পাই নাই। সরকার বোলে কীসের টাহা দেছে, কোমদামে ত্যাল-প্যাঁজ দিছে, এর কিছুই পাই নাই! আর এহন তো নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও কিছু পাইলাম না। হুনছি নদীর অন্য জাইল্যারা নাহি চাইলের কার্ড পাইছে। মোরা তো ভাসমান তাই মোগো দিক আসলেই কেউ ফিইর্যা চায় না। তয় মোরা মোগো ধর্ম-কর্ম ঠিকমতো করতাছি, না পারলে না খাইয়্যা নৌকাডার মধ্যে হুইয়া তো থাকতে পারমু।