আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, সেই বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ‘আল্টিমেটলি আমরা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো ভোট কোন পদ্ধতিতে ও কেমন হবে। সেটি আমাদের বিষয়। এই বিষয়ে আমরা স্বাধীন।’ গতকাল মঙ্গলবার (১০ মে) ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমকে সামনে রেখে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি এমন কথা বলেন।
‘এনআইডি পাওয়ার জন্য মানুষের উৎসাহ আছে, কিন্তু ভোটের মাঠে কেন মানুষ যায় না?’Í এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেবো না। আমাদের দায়িত্ব ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা। আমাদের কর্মীরা ভোটার তালিকা প্রণয়ন করতে মাঠে যাবে। যে প্রশ্নটা করেছেন, সেই প্রশ্নের কোনও মন্তব্যই আমি করবো না।’ ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে আলোচনা হচ্ছে, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কী করবে জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘সেটি নিয়ে পত্রিকায় আসছে এবং আমাদের বক্তব্যগুলো আপনাদের জানানো হয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠান করার দায়িত্ব আমাদের। হয়তো আপনারা বলতে পারেন যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি বক্তব্য দিয়েছেন এবং বিভিন্নজন থেকে বক্তব্য আসতে পারে। এই বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নাকি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বলেছেন- বিষয়টি এখনও স্পষ্ট না। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বলা, বিএনপির প্রধান বলা, জাসদের আব্দুর রব বলা; এগুলো ভিন্ন জিনিস।’
ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে নির্বাচন কমিশন কোনও চাপ অনুভব করছে না বলেও জানান সিইসি। তিনি আরও বলেন, ‘আর সব থেকে বড় কথা, যেটি স্পষ্ট করে বলতে চাচ্ছি, অনেকে ইচ্ছা পোষণ করতে পারেন, সদিচ্ছা ব্যক্ত করতে পারেন; আর ইভিএমে ভোট দেওয়ার বিষয়েও আমরা এখনও কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। ইতিমধ্যে আমরা নিজেরা অনেকগুলো সভা করেছি, আগামীতে আরও সভা হবে। তারপর সিদ্ধান্ত হবে আমাদের। ভোট স্বাধীনভাবে আমরা পরিচালনা করবো যতদূর সম্ভব। এটা আমাদের এখতিয়ারভুক্ত, পদ্ধতিও আমাদের এখতিয়ারভুক্ত।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সব আসনে ইভিএমে ভোট করার মতো এখন আমাদের সামর্থ নেই। ৩০০ আসনের বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত আমরা এখনও নেইনি। ভোট ব্যালটে হবে না ইভিএমে, কতটি আসনে ইভিএমে হবে এই বিষয়ে কমিশন এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। এটি পর্যালোচনাধীন রয়েছে।’ সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সিদ্ধান্ত আমাদের উপরেই থাকবে। মতামত আমরা বিবেচনায় নিতে পাারি। আপনিও মতামত দিতে পারেন, রাস্তায় কেউ মতামত দিতে পারেন, রাজনৈতিক দলগুলো মতামত দিতে পারবেন। আল্টিমেটলি আমরা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো ভোট কোন পদ্ধতিতে ও কেমন হবে। সেটি আমাদের বিষয়। এই বিষয়ে আমরা স্বাধীন।’ এরআগে প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ নেওয়া কর্মকর্তাদের শুদ্ধ ও সিদ্ধভাবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশনা দিয়ে সিইসি বলেন, ‘শুদ্ধ ও সঠিক ভোটার তালিকা ছাড়া প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠন সম্ভব নয়।’ নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. হুমায়ুন কবীরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রশিক্ষণ কর্মশালায় চার নির্বাচন কমিশনার, ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
‘ইভিএমে সংসদ নির্বাচন করতে যত বাধা’ জাগো নিউজ এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো: ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমেই আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে চায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলের সভানেত্রী তেমন ইঙ্গিত দিয়েছেন আগেই। তবে ইভিএমে শতভাগ ভোট বাস্তবায়ন করতে রয়েছে নানান বাধা। আওয়ামী লীগের শরিক দলগুলো কেউ এর পক্ষে নেই। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি বিরোধিতা করছে। আর ইসি বলছে, রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে পারলে একশ আসনে ইভিএম ব্যবহার করা সম্ভব। তিনশ আসনে ইভিএম ব্যবহার করার সক্ষমতা ইসির নেই। বিশিষ্টজনরাও ইভিএমের পক্ষে বেশি মত দিচ্ছেন না। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপের সময় অনেকেই দাবি করেন ইভিএম দিয়ে কারচুপি করা যাবে না এটি নিশ্চিত না করা পর্যন্ত ব্যবহার করা ঠিক হবে।
জানা যায়, সবশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশের মাত্র ছয়টি আসনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট হয়। এগুলো হলো- ঢাকা-৬, ঢাকা-১৩, চট্টগ্রাম- ৯, রংপুর-৩, খুলনা-২ ও সাতক্ষীরা-২। কমিশন সূত্র জানায়, দেশের তিনশ সংসদীয় আসনে নির্বাচন করতে হবে প্রায় চার লাখ ইভিএম লাগবে। কিন্তু এখন ইসির কাছে মাত্র এক লাখ ৫২ হাজার ৫৩৫টি ইভিএম রয়েছে। এসবের অনেকগুলোই নষ্ট। এই ইভিএম দিয়ে সর্বোচ্চ একশ আসনে ভোটগ্রহণ করা যাবে। সবগুলো আসনের জন্য আরও দুই লাখ নতুন ইভিএম কিনতে হবে। এসব মেশিন কেনার জন্য নিতে হবে নতুন প্রকল্প। বর্তমানে এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত জনবল প্রায় ১৩ হাজার। আরো বিপুলসংখ্যক জনবলকে প্রশিক্ষণও দিতে হবে। আগামী নির্বাচনের আগে এক লাখের বেশি জনবলকে ইভিএম বিষয়ে প্রশিক্ষণ শেষ করতে হবে। যা ইসির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, কমিশনের হাতে বিদ্যমান ইভিএম দিয়ে মাত্র একশ সংসদীয় আসনে ভোট করা সম্ভব। তিনশ আসনের জন্য সাড়ে চার লাখের মতো ইভিএম লাগবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর সোমবার (৯ মে) বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক দেড় বছর বাকি। এ নির্বাচনে ইভিএমে ভোটগ্রহণের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্তমূলক আলোচনা হয়নি। তবে আমাদের হাতে কত সংখ্যক ইভিএম আছে, কত লাগতে পারে সেগুলো পর্যালোচনা করছি। তিনশ আসনে ইভিএম ব্যবহারের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি আরও বলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে পারলে একশ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা সম্ভব। তবে তিনশ আসনে ইভিএম ব্যবহার করার সক্ষমতা ইসির নেই। নির্বাচন কমিশনের পরিকল্পনা শাখা সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ইসির চারটি প্রকল্প চলমান। বিগত নির্বাচন কমিশন যে দেড় লাখ ইভিএম কিনেছে সেই প্রকল্প শেষ হবে আগামী বছরের জুনে। ইভিএম কেনার নতুন কোনো প্রকল্প প্রস্তাব তৈরির কোনো কার্যক্রম নেই ইসির।
ইসির একাধিক সূত্র জানায়, আসন্ন সংসদ নির্বাচনে প্রতিটি আসনেই ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তুতি নেবে ইসি। এজন্য নতুন করে ইভিএম কেনাসহ প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে।
সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে দলের নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন। দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে ভোট হবে ইভিএমে। নির্বাচনে বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ সব দলই অংশ নেবে বলে আশাবাদী তিনি। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি ছাড়াও বরাবরই ইভিএমের বিরোধিতা করে আসছে বিএনপি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখন থেকেই নানা ‘কলাকৌশল’ ও ‘ফন্দিফিকির’ শুরু করেছে বলে মনে করছে দলটি।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল এ বিষয়ে বলেন, ‘ইভিএম তো পরের কথা, নির্বাচনে আমরা যাবোই না শেখ হাসিনা যদি ক্ষমতায় থাকেন।’ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সের সাবেক এ অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট লেখক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) খুব লো লেভেলের টেক। এখন অনেক হাইটেক জিনিসপত্র রয়েছে। ইভিএম সম্পর্কে বলা হচ্ছে এটা নাকি অনেক হাই লেভেলের টেকনোলজি। আসলে তা না। এখন তো অনেক হাইটেক জিনিসপত্র রয়েছে। আমাদের ভার্সিটির স্টুডেন্টরা ইভিএম নিয়ে প্রজেক্ট করে।
নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) আয়োজিত সংলাপে অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। এই মেশিন ব্যবহার করে কারচুপি করা যাবে না সেটা নিশ্চিত না করে ব্যবহার না করারও পরামর্শ দেন তিনি।
বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএমের বিরোধিতা করেছিলেন জাতীয় পার্টির তৎকালীন চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তিনি বলেছিলেন, আমাদের দেশের মানুষ তো টিপসই দিতে পারে না, ইভিএমে টিপ দেবে কীভাবে? তবে এ বিষয়ে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সভায় প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ইভিএমে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে সেই আলোচনা ওই সভায় কতটা প্রাসঙ্গিক সে বিষয়ে মতভেদ আছে। নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে তা নির্ধারণের দায়িত্ব মূলত নির্বাচন কমিশনের। তিনি বলেন, নিরক্ষরতার জন্য আমাদের দেশে এখনো প্রার্থীর নামের পাশে প্রতীক ব্যবহার করতে হয়। এমন বাস্তবতায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে ভোটগ্রহণ কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে।