ডয়চে ভেলের বিশ্লেষণে বাংলাদেশের রাজনীতি
বাংলাদেশ একের পর এক নতুন আইন চালু করছে যেগুলো মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্রমশ ক্ষুণ্ণ করছে এবং আরো করবে বলে নানা আলামত পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে রাষ্ট্র, সরকার, রাজনীতিবিদদের সমালোচনার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সমালোচনায় সমস্যা কোথায়? এক সময় পত্রিকার চিঠিপত্র কলাম ছিল একজন সাধারণ মানুষের নিজের মতামত জানানোর অন্যতমক্ষেত্র। কিন্তু তাতে সময় যেমন অনেক লাগতো পাশাপাশি কোনো চিঠি সম্পাদক ছাপবেন, কোনটা ছাপবেন না তা নিয়েও তৈরি হতো জটিলতা। সাধারণ মানুষ নিজস্ব মতামত বড় পরিসরে জানানোর সুযোগ কয়েক দশক আগেও তেমন একটা পাননি।
অতীতে সংবাদপত্রের পাশাপাশি রেডিও, টেলিভিশনেও শ্রোতা, দর্শকের মতামত প্রকাশের সুযোগ কিছুটা ছিল। তবে, সেই অবধি পৌঁছানো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষেই অসম্ভব ছিল। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে সেই পরিস্থিতি আমূল বদলে গেছে। এখন কোনো লাইভ অনুষ্ঠানে সরাসরি মতামত কোনো বাধা ছাড়াই একজন মানুষ জানাতে পারেন।
গণমাধ্যম ডিজিটাল মিডিয়ায় কোনো কিছু প্রকাশের সাথে সাথেই শ্রোতা, পাঠক বা দর্শকের লাইক, কমেন্ট, শেয়ার দেখে সেটি সম্পর্কে জনমত বুঝে ফেলে। রাজনীতিবিদরাও তাদের সম্পর্কে মতামত পেয়ে যান দ্রুত। শুধু তাই নয়, একজন সাধারণ মানুষ যেকোনো ইস্যুতে তার মত এখন সহজেই প্রকাশ করতে পারছেন। তার সেই মত যদি অন্যদের পছন্দ, বা অপছন্দ হয়, তাহলে সেটাও জানা যায় দ্রুতই। আর যে-কারো মতামতই সোশ্যাল মিডিয়ায় গুরুত্ব পেতে শুরু করলে তা ভাইরালও হয়ে যায়। একজন মানুষ, তিনি বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, ডিজিটাল মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কমবেশি চর্চা করতে পারেন। এক্ষেত্রে, সুবিধা-অসুবিধা দুটোই আছে। বড় সুবিধা হচ্ছে, একেবারে আমজনতা যাদের আমরা বলি, তারা তাদের মতামত সহজেই জানাতে পারছেন। ফলে মানুষের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে কার্যত বাড়তি কিছু না করেই। আর জনমত জানার, বোঝার পথ এখন সহজ হওয়ায় একটি সরকারের পক্ষে জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হচ্ছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এটা বেশ ইতিবাচক ব্যাপার। এর মাধ্যমে সরকার, রাষ্ট্রসম্পৃক্তদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পথও সুগম হয়েছে। এক্ষেত্রে, অসুবিধার দিকটি হচ্ছে ডিজিটাল মাধ্যমে নানা অপরাধ সংগঠিত হওয়ার পাশাপাশি ভুয়া তথ্য, উগ্রবাদী আদর্শসহ সমাজের জন্য সুখকর নয় এমন বিষয়ও ছড়াতে পারে। আর তাই বাস্তব দুনিয়ার মতোই ভার্চুয়াল দুনিয়াতেও অপরাধ নিয়ন্ত্রণের সুযোগ থাকা উচিত।
কিন্তু এই যে নিয়ন্ত্রণ সেটা অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনেই সম্ভব। কিছু ক্ষেত্রে যা সম্ভব নয়, তার জন্য প্রচলিত আইনের সংস্কার কিংবা সুনির্দিষ্ট আইনও করেছে কিছু দেশ। জার্মানিসহ গণতান্ত্রিক বিভিন্ন রাষ্ট্র সাইবার নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে আইন করার ক্ষেত্রে তা যাতে সাধারণ মানুষের জন্য ভোগান্তির কারণ না হয়, মতপ্রকাশ কিংবা বাকস্বাধীনতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে, সেটাও নিশ্চিত করেছে।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ভিন্নচিত্র৷ ইতোমধ্যে চালু হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ডিজিটাল জগতের নিরাপত্তা নিশ্চিতের চেয়ে মানুষের মতপ্রকাশের ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ করাতেই ব্যবহার হচ্ছে বেশি৷ এমনকি শিশুদেরও এই আইনে কারাভোগ করতে হচ্ছে। আইনের কিছু ধারা অস্পষ্ট হওয়ায় সেগুলোর অপব্যবহারের ভয়াবহ উদাহরণ তৈরি হচ্ছে। একজন মানুষ ফেসবুকে কী লিখেছেন বা না লিখেছেন তা প্রমাণ হওয়ার আগেই মাসের পর মাস কারাভোগ করছেন, এমনকি কারাগারে মারাও যাচ্ছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা নাম হলেও এ ধরনের আইন উল্টো হিতের বিপরীতই করছে।
এখন ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট ২০২২, রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্মস এবং ওটিটি কনটেন্টভিত্তিক সেবা প্রদান ও পরিচালনা নীতিমালা, ২০২১ নামে যেসব নতুন আইন ও নীতিমালা তৈরির প্রক্রিয়া চলছে তা-ও মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে আরো সীমিত করবে বলে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন।
কথা হচ্ছে, এসব আইন কি তাহলে রাষ্ট্র, সরকার, রাজনীতিবিদদের সমালোচনা রুখতেই তৈরি করা হচ্ছে? সমালোচনা রুখতে এত আইনি আয়োজনের দরকারই বা কেন হচ্ছে?
বাংলাদেশে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, জবাবদিহিতায় যে ঘাটতি গত বেশ কয়েক বছরে তৈরি হয়েছে সেই ঘাটতি মেটানোর চেয়ে তা নিয়ে কথা বলার পথ বন্ধ করতে এসব আইন সাজানো হচ্ছে। এটা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য সুখকর বিষয় হতে পারে না। বরং রাজনীতিবিদদের উচিত সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি জনস্বার্থবিরোধী এমন কিছু না করা, যা তাদের সমালোচনার মুখে ফেলতে পারে। রাজনীতিবিদরা সমালোচনার, প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন না৷ তাদের ভালো কাজের প্রশংসা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি প্রশ্নবিদ্ধ, বিতর্কিত কাজের বিপুল সমালোচনাও অস্বাভাবিক নয়৷ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা নিশ্চিতে এসবের দরকার আছে। আইন করে সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করা উচিত হবে না।