নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও মহামারির আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। এর উপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আগামী ২০২৩-২৪ সালে পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলবে। একারণে বেকার যুবকদের জন্য মাসিক ১ হাজার টাকা ভাতা দেয়া যেতে পারে। এছাড়া সরকার ৬.২২ শতাংশের যে মূল্যস্ফীতির কথা বলছে, বাস্তবতার সঙ্গে তার আদৌ মিল নেই। এমনকি এ তথ্য বিজ্ঞানসম্মতও নয়। ধারণা করা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। আগামী দিনে এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
গতকাল সোমবার ‘বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, জাতীয় বাজেট ও অসুবিধাগ্রস্ত মানুষের প্রত্যাশা’ শীর্ষক একটি মিডিয়া ব্রিফিংয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেন। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত এই ব্রিফিংয়ে তিনি মূল প্রতিবেদন উপস্থাপনা করেন। কোর গ্রুপ সদস্য ও সিপিডি’র অপর বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানী এতে সভাপতিত্ব করেন। দেশের বেকার যুবকদের অন্তত ১০ শতাংশকে (প্রায় ৬ লাখ ৬৯ হাজার) সরকারের নিরাপত্তা বেষ্টনী উদ্যোগের আওতায় আনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্রমবর্ধমান দামের সঙ্গে মোকাবিলা করতে সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকায় সব ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে তারা।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, আর্থিকভাবে অসচ্ছলদের জন্য ন্যূনতম ১ হাজার টাকার ভাতা নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে অতিরিক্ত ৫ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা (জিডিপির ১.৩৪ শতাংশ) বরাদ্দ করতে হবে। ২০০৭-০৮ সাল থেকে বাংলাদেশে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এতটা চাপের মধ্যে পড়েনি উল্লেখ করে বলা হয়, ব্যক্তি পর্যায়ে করমুক্ত আয়ের সীমা ৩.৫ লাখ টাকা হওয়া উচিত। এছাড়া নারী ও অন্যান্য সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীগুলোকে আরও সুযোগ দেয়া যেতে পারে।
সংগঠনটি বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও মহামারির আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। এর উপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আগামী ২০২৩-২৪ সালে পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলবে। গবেষণা বলছে, ২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রেভিনিউ টু জিডিপির (রাজস্ব থেকে জিডিপি) অনুপাত ছিল ৯.৪ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এটিই সর্বনিম্ন এমনকি বিশ্বের সর্বনিম্ন রেভিনিউ টু জিডিপির মধ্যে এটি একটি।
অর্থনীতির তিনটি বিষয়ের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় তার প্রতিবেদনে বলেন, মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, অন্যদিকে টাকার মূল্যমান কমে যাচ্ছে। যেকোনো অর্থনীতির ভেতরে সুদের হার, বিনিময় হার ও মূল্যস্ফীতির মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। একদিকে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে, আবার অন্যদিকে টাকার মান অবনমন হচ্ছে। যে প্রত্যাশায় সুদের হার কম রাখা হচ্ছে, সেই বিনিয়োগ কত কয়েক বছরের বেড়েছে এমন কোনো তথ্য নেই। সুদের হার কমিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানো যাবে এমন সূত্র বাংলাদেশে প্রযোজ্য নয়।
তিনি বলেন, এখন টাকার আমানতে গড় সুদের হার ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকে টাকা রাখলে প্রতি বছর প্রকৃত মূল্য দুই শতাংশ করে কমে যাবে। এটা বড় ধরণের সঞ্চয়বিরোধী। আগামীতে টাকার মান অবশ্যই নিম্নমুখী হবে। অবশ্যই সুদের হার বাড়াতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতিকে ধরে রাখতে হলে, মূল্যস্ফীতিকে কেন্দ্র করে পরিকল্পনা সাজাতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হলে গরিব, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ তাদের আয় পণ্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে না।
দেবপ্রিয় বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির ভিতরে বড় ধরনের টানাপোড়ন দেখা দিয়েছে। বিগত বছরে আমাদের আর্থিক যে আয়-ব্যয়ের হিসাব রয়েছে, তা সব সময়ই দুর্বল ছিল। দুর্বলতার লক্ষণ হচ্ছে আমাদের কর জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের ওপরে উঠেনি। একই সঙ্গে উন্নয়ন ব্যয়ের চেয়ে পরিচালন ব্যয় বা অপারেটিং ব্যয় অনেক বেশি। দেশে কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা হলো- একদিকে অর্থের অভাব, অন্যদিকে সম্পদ থাকলেও তা যথাপোযুক্তভাবে খরচ করতে না পারা। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে আসছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি বিষয় লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকেই কমার ধারা শুরু হয়েছে। আমাদের বর্তমানে যে মজুদ আছে, তা দিয়ে ৪ থেকে ৫ মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে না।