টমেটোর বিশাল স্তূপ। তার চারপাশে বসে ৮ থেকে ১০ জন শ্রমিক টমেটো বাছাইয়ের কাজ করছেন। ভালোটা একপাশে রেখে দিচ্ছেন। আর যে টমেটোতে দাগ রয়েছে তা আলাদা রাখা হচ্ছে। যেগুলো পচে গেছে তা ফেলে দেওয়া হচ্ছে। পাশে অন্য শ্রমিকরা প্লাস্টিকের ক্যারেটে টমেটোগুলো সাজাচ্ছেন। সাজানো হলে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানোর জন্য বোঝাই করা হবে ট্রাকে। এমনই দৃশ্য দেখা গেলো দিনাজপুর সদর উপজেলার ৪ নম্বর শেখপুরা ইউনিয়নের গাবুড়া হাটের। প্রতি বছর এখানে টমেটোর বড় বাজার বসে। এসব টমেটো সদর উপজেলাসহ আশপাশের যেমন চিরিরবন্দর, বিরল ও খানাসামা উপজেলার কৃষকদের উৎপাদিত ফসল। তবে এই বাজারের পাশপাশি জেলার জনতার মোড়, পাঁচবাড়ি হাট, কাওগাঁ মোড়সহ চিরিরবন্দর উপজেলার চাকার বাজারে টমেটো বেচাকেনা হয়। এই বাজারে যে টমেটো আমদানি হয় তা নাবি জাতের টমেটো। এসবের মধ্যে অন্যতম রানি, বিপুল প্লাস এবং পভলিন সিট। গাবুড়া হাটের টমেটোর বাজারে কদর বেশি বিপুল প্লাসের। এরপর রয়েছে রানি এবং পভলিন সিট। প্রতিদিন ভোর ৫টায় বেচাকেনা শুরু হয়। চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত। প্রায় দুই মাস এই বাজারে টমেটো বেচাকেনা চলে। শুরুর এবং শেষ দিকে ৫ থেকে ১০টি ট্রাকে টমেটো বোঝাই করা হলেও ভরা বাজারে বোঝাই হয় ৩০ থেকে ৪০ ট্রাকে। প্রতিদিন গড়ে বেচাকেনা হয় ৩০০ থেকে ৪০০ মেট্রিক টন।
গাবুড়া টমেটোর বাজারে বর্তমানে বিপুল প্লাস জাতের টমেটো প্রতি মণ (৪০ কেজি) বিক্রি হচ্ছে ১০০০ থেকে ১৪০০ টাকায়। একইভাবে রানি জাতের প্রতি মণ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা এবং পভেলিন সিট ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, টমেটোর আবাদ সবচেয়ে বেশি হয় সদর উপজেলায়। চলতি বছরে জেলায় টমেটোর আবাদ হয়েছে ৯৫৫ হেক্টর (১ হেক্টর সমান ২৪৭ শতাংশ) জমিতে। হেক্টরপ্রতি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ মেট্রিক টন।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় এ বছর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না। হেক্টরপ্রতি ৫ মেট্রিক টন কম উৎপাদন হতে পারে। একই কথা বলছেন কৃষকরাও। তারা বলছেন, প্রতি বছর যেখানে বিঘাপ্রতি (৪৮ শতক) উৎপাদন হতো ২০০-৩০০ মণ, সেখানে এবারে উৎপাদন হয়েছে ১০০-১২০ মণ। প্রতি হেক্টরে ২০ থেকে ২৪ মেট্রিক টন। বাজারে ভালো দাম থাকলেও উৎপাদন কম হওয়ায় এ বছর টমেটো চাষ করে লোকসানের আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। সদর উপজেলার গোয়ালহাট এলাকার টমেটো চাষি রূপ কুমার দাস বলেন, ‘যখন বাজারটা শুরু হয় তখন টমেটা বিক্রি করলাম ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা মণ। তারপর বাজার বাড়লে ১৮০০ টাকা পর্যন্ত দাম ওঠে। কিন্তু মাঝে বৃষ্টি হয়ে আবার বাজারটা ফেলে দিল (দরপতন)। এখন বাজারে বিপুল প্লাস টমেটো বিক্রি হচ্ছে ভালোটা (সাইজে বড়) ১০০০ থেকে ১৪০০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু বাজারে ভালো দাম থাকলেও লাভ হবে না। কারণ এবারও ফলন কম। তারপর সার-বিষের দাম বেশি। শ্রমিকের মজুরি বেশি। সবমিলিয়ে এবারও লাভ হচ্ছে না বোধহয়।’
একই উপজেলার মহারাজপুর এলাকার কৃষক আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘১০ থেকে ১২ বছর ধরে টমেটো আবাদ করছি। এবারের মতো কম ফলন কোনোবারেই হয়নি। বাজারে বর্তমান দাম ভালো থাকলেও লাভ হবে না। কারণ যেখানে অন্যান্য বছর বিঘাপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ মণ ফলন হয়, সেখানে এবার ১০০ থেকে ১২০ মণ উৎপাদন হওয়ায় কষ্টকর। অন্যদিকে খরচ প্রচুর।’
তিনি বলেন, ‘বিঘাপ্রতি ৬০ হাজারের ওপর খরচ। আর গাছে রোগ-বালাই তো আছেই। এখন বাজার ভালো থাকেও লাভ হবে না। শুরুর দিকে বিক্রি করেছি ৩০০ টাকা মণ। ফলন না থাকলে দাম দিয়ে কী হবে?’
একই কথা বললেন মাধবপুর এলাকার টমেটো চাষি জুবায়ের আহম্মেদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাজারে ভালো দাম থাকলেও এবারও কৃষকরা লাভ করতে পারবেন না। কারণ এবার গাছের ফলন কম। রোগ-বালাইয়ে অনেক গাছ মরে গেছে। এখন বৃষ্টির জন্য টমেটো পচে যাচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে লাভ হবে না। আসলটা হয়তো উঠতে পারে।’ শরীয়তপুর জেলার টমেটো ক্রেতা মোহাম্মদ আবু আলম বলেন, এক সপ্তাহ আগে থেকে ঢাকায় টমেটোর চাহিদা হওয়ায় বাজারে টমেটোর দাম বাড়ছে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে দর পড়ে গেছে বলে জানালেন শরীয়তপুর জেলার টমেটো ক্রেতা মোহাম্মদ আবু আলম। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির কারণে একদিনে বাজার কমে গেছে ৬০০ টাকা। ওখানে চাহিদা থাকলে আমরা বেশি দিয়ে কিনবো। চাহিদা না থাকলে বেশি দাম দিয়ে কিনবো কীভাবে?’ দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) খালেদুর রহমান বলেন, জেলায় অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি টমেটো আবাদ বেশ ভালো হয়। এ বছর জেলায় ৯৫৫ হেক্টর জমিতে টমেটো আবাদ হয়েছে। তবে আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না। এ বছর হেক্টরপ্রতি ৪৫ মেট্রিক টন উৎপাদন হতে পারে।