জেলায় দার্জিলিং জাতের কমলা বাগান করে লাভবান হয়েছেন কৃষক আবু জাহিদ ইবনুল ইরাম জুয়েল। এবছর তিনি তার বাগান থেকে কমপক্ষে ২৫০ মণ কমলা উৎপাদনের আশা করছেন। ২০০ টাকা কেজি দরে যার বাজার মূল্য ২০-২৫ লাখ টাকা। এই বাগানটি গড়ে উঠেছে ঠাকুরগাঁও পীরগঞ্জ উপজেলার ২ নং কোষারাণীগঞ্জ ইউনিয়নের মালঞ্চা গ্রামে। সেখানে জুয়েল নামে এই কৃষক ১০ বছর আগে হর্টিকালচার থেকে কিছু চারা কিনে রোপণ করেন। দুবছরের মাথায় আশানুরূপ ফল হওয়ায় তিনি বাগানের পরিধি বাড়ান। এখন তার বাগানে প্রায় ৩০০ কমলা গাছ রয়েছে।
ঠাকুরগাঁও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য মতে, জেলায় ৭৩ হেক্টর জমিতে মাল্টা ও কমলার ১০৩২টি বাগান রয়েছে। এর মধ্যে সীমান্তবর্তী উপজেলার পীরগঞ্জ ও হরিপুরে ভারতীয় দার্জিলিং জাতের সাতটি কমলা বাগান গড়ে উঠেছে। জেলায় অনেকেই কমলার বাগান গড়ে তুলতে চাইলেও জুয়েল ছাড়া অন্যরা দার্জিলিং জাতের কমলার চাষ ভালোভাবে করতে পারেননি।
এই বাগানটি ঘুরে দেখা যায়, বাগানের প্রতিটি গাছে প্রচুর ফল ধরেছে। ভারতীয় জাতের এ ফল মিষ্টি ও সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে চাহিদাও রয়েছে। এছাড়াও বাগানটি দেখার জন্য প্রতিদিন হাজারো দর্শনার্থী ভিড় করছেন। বাগানেই বিক্রি হচ্ছে এই দার্জিলিং জাতের কমলা।
এই বাগান মালিক কৃষক জুয়েল জানান, বাগানের বয়স ১০ বছর হলেও তিন বছর ধরে ভালো ফলন আসছে। এবার প্রচুর পরিমাণে ফল ধরেছে। নভেম্বর মাস থেকে বাগানের উৎপাদিত কমলা বিক্রি শুরু হয়েছে। বাগানের উৎপাদিত এসব ফল স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণ করে পাঠানো হচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। বর্তমানে তিনশতাধিক গাছের এই বাগানের প্রতিটি গাছে ৮০০ থেকে ৯০০ কমলা ধরেছে। উৎপাদিত কমলা কিনতে বাগানেই ছুটে আসছেন দূর-দূরান্তের ব্যবসায়ীরা। আগের বছর এই বাগান থেকে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকার কমলা বিক্রি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষক জুয়েল। তবে এবার প্রায় ২০-২৫ লাখ টাকা আয়ের আশা করছেন তিনি।
এছাড়াও জুয়েল কমলা বাগানের পাশাপাশি একই প্লটে উৎপাদন করছেন চারা। সীমান্ত এলাকায় ফল বাগান গড়ে ওঠায় কর্মসংস্থানের পাশাপাশি এলাকার অন্যান্য কৃষকেরাও উৎসাহিত হয়ে তার কাছ থেকে বাগান করার পরামর্শ নিচ্ছেন। এছাড়াও কেউ কেউ বাগান সম্পর্কে জুয়েলের কাছে জানতে গেলে কৃষকদের উৎসাহ দিচ্ছেন। অনেকে মনোরম এই বাগানে ছবি তুলে ফেসবুক পোস্ট করছেন। ফলে জেলাসহ সারাদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে বাগানটি। বাগান দেখতে আসা দর্শনার্থী সোহেল রানা বলেন বলেন, শহর থেকে এসেছি কমলা বাগান দেখতে। আমি দর্জিলিংয়ে কমলার বাগান দেখেছি। কিন্তু এখানের কমলা বাগান যে সুন্দর তা দার্জিলিংয়ের বাগানকেও হার মানাবে। আর এই কমলা অনেক মিষ্টি। আমার দেশের মাটি সোনার চেয়েও খাঁটি তা এই বাগান দেখেই বোঝা যায়। দর্শনার্থী আবুল হোসেন চৌধুরী ও কহিনুর বেগম পৃথকভাবে বলেন, পরিবারসহ কমলা বাগান দেখতে এসেছি। আগে কমলা বাগান শুধু ছবিতেই দেখেছি। আজ বাস্তবে গাছে ঝুলন্ত কমলা দেখলাম। আর পুরো বাগানে কমলা ঝুলে রয়েছে। দেখতেই অনেক সুন্দর লাগছে। কমলা কিনে খেলাম, অনেক মিষ্টি ও রসালো কমলা। এই কমলা খেয়ে মনে হলো না যে আমার দেশের মাটিতে উৎপাদিত কমলা খাচ্ছি। পরিবারের সবাই খুশি এমন কমলা বাগান দেখতে এসে বলেও জানান তারা।
শহরের পাশেই কমলা বাগানের মালিক মাহফিজুর রহমান ছুটু বাগান দেখতে এসে বলেন, আমার বাগানেও কমলা গাছ রয়েছে। তবে এই বাগান খুব সুন্দর করে যত্ন করার কারণে ফলন অনেক ভালো হয়েছে। এছাড়াও ফলের সাইজ ও রং একবারে ঠিকঠাক হয়েছে। আমি বাগান মালিক জুয়েল ভাইয়ের সঙ্গে আমার বাগান নিয়ে আলোচনা করার জন্য এসেছি।
কমলা বাগানে প্রথম থেকেই কাজ করেন নরেন মোহন। তিনি জানান, আমি বাগানের প্রথম থেকেই কাজ করছি। এখন প্রতিদিন প্রায় ১ হাজারের বেশি মানুষ আসে এই বাগান দেখতে। আমরা বাগানে ৮ থেকে ১০ জন এখন কাজ করতেছি। গাছ থেকে কমলা সংগ্রহের জন্য ৩-৪ জনকে কাজ করতে হয়। এছাড়াও বাগান পাহারা দিতে হয়। ঠিক মতো পাহারা না দিলে ফল চুরির ভয় থাকে।
ঠাকুরগাঁও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আবু হোসেন জানান, বছর দশেক আগে সরকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়। সে সময় থেকেই ঠাকুরগাঁওয়ে কমলা চাষ শুরু হয়। কমলা বাগানে সফলতা পেতে এ বিষয়ে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করে বাগানের পরিচর্যা নিতে হয়। জুয়েল কৃষি দপ্তর থেকে সব সময় পরামর্শ নিয়েছেন। তার দার্জিলিং জাতের বাগানটি বেশ সুন্দর হয়েছে এবং বাগানে প্রচুর পরিমাণে কমলা ধরেছে। তার বাগান দেখে অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করছেন নিজেরা বাগান করার জন্য। আমরা সর্বাত্নকভাবে জুয়েলকে কৃষি বিভাগ থেকে সহায়তা করি এবং ভবিষ্যতের ও করবো বরেও জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, কৃষকরা যদি এভাবে কমলার বাগান করতে এগিয়ে আসে তাহলে কৃষিতে একটা বিপ্লব ঘটবে। আর কমলা দেশের বাহির থেকে আনতে হবে না। আমাদের দেশের কমলা দিয়েই ভিটামিন ‘সি’-এর চাহিদা পূরণ হবে বলে আমি মনে করছি বলেও আশা প্রকাশ করেন এ সিনিয়র কৃষিবিদ।