পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। আমরা নিত্যপ্রয়োজনে একজন আরেকজনকে ভালোবেসে থাকি। কিন্তু একজন মুমিন কখনো এই ভালোবাসার ক্ষেত্রে দুনিয়াকে প্রাধান্য দিতে পারে না। সে সবাইকে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্যই ভালোবাসবে। কারণ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়ার কোনো স্বার্থ ব্যতীত কোনো মুসলিমের অন্য মুসলিম ভাইকে ভালোবাসা একটি বড় ইবাদত। আর উলামায়ে কেরামের মতে, এটা অবশ্যই হতে হবে ইসলামী শরিয়তসম্মত ভালোবাসা। আরবি ‘আল-হুব’ শব্দটি একবচন, বহুবচন হলো ‘আহবাব’। যার অর্থ ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, পছন্দ, আসক্তি, ঝোঁক ইত্যাদি।
এই ভালোবাসা শব্দটি পবিত্র কুরআনে সাতটি পর্বে ৬৩ বার উল্লেখ হয়েছে। বিশ্বাসী বা মুমিনদের ভালোবাসা সম্পর্কে ১৪টি আয়াত রয়েছে; কাফেরদের ভালোবাসা সম্পর্কে রয়েছে ১২টি আয়াত; আল্লাহ ভালোবাসেন না প্রসঙ্গে আছে ১৫টি আয়াত; আল্লাহ ভালোবাসেন প্রসঙ্গে আছে ৯টি আয়াত; ভুল করে ভালোবাসা সম্পর্কে বিবৃত আছে তিনটি আয়াত, ভালোবাসার অসার দাবি সম্পর্কে রয়েছে একটি আয়াত; ভালোবাসার অন্যান্য প্রসঙ্গে উল্লেখ রয়েছে ছয়টি আয়াত।
আর ভালোবাসা অবশ্যই হতে হবে মাহরাম বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের সাথে। না হলে শয়তানের ওয়াসওয়াসায় একজন ব্যক্তি খুব সহজেই নফসের শেকলে বাঁধা পড়তে পারে।
রাসূল সা: বলেছেন, আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসলে তাকে সে কথা জানিয়ে দেয়া উচিত। তাহলে উভয়পক্ষ থেকে ভালোবাসা সৃষ্টি হবে এবং সে ভালোবাসা আরো প্রগাঢ় হবে। হজরত মিকদাদ বিন মাদিকারিব রা: বলেন, রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘কেউ অন্যকে ভালোবাসলে যেন তাকে ভালোবাসার কথা জানিয়ে দেয়।’ (আবু দাউদ-৫১২৪)
ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহর জন্য ভালোবাসার গুরুত্ব অনেক। আর ইসলামে পারস্পরিক ভালোবাসা সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব এত বেশি যে, এর ওপর ঈমানের ভিত্তি রাখা হয়েছে। রাসূল সা: বলেন, ‘তোমরা জান্নাতে যেতে পারবে না যতক্ষণ না ঈমানদার হবে। আর তোমরা ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না পরস্পরকে ভালোবাসবে। আমি কি তোমাদের এমন আমলের কথা বলে দেবো না, যা করলে তোমাদের পরস্পরের মাঝে ভালোবাসা সৃষ্টি হবে? তা হলো সালামের প্রসার ঘটানো।’ (সহিহ মুসলিম-৫৪) অন্য একটি হাদিসে রাসূল সা: বলেন, ‘তোমরা একে অন্যকে উপহার দাও। তাহলে তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও হৃদ্যতা তৈরি হবে।’ (আদাবুল মুফরাদ-৫৯৪)
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাউকে ভালোবাসলে অনেক উপকারিতা লাভ করা যায়। যেমন-
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন : ইসলামের শরিয়তসম্মত বন্ধুদের যদি কেউ আল্লাহর জন্য ভালোবাসতে পারে, তাহলে সবচেয়ে বেশি যেই সুফলটি পাওয়া যাবে তা হচ্ছে ¯্রষ্টার সন্তুষ্টি। হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, নবী করিম সা: বলেন, ‘এক ব্যক্তি তার কোনো (মুসলমান) ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের জন্য অন্য গ্রামে রওনা হয়, পথে আল্লাহ তার জন্য একজন ফেরেশতা বসিয়ে দেন। অতঃপর ফেরেশতা তাকে বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে এমন ভালোবাসেন, যেমন তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসো।’ (মুসলিম, হাদিস-২৫৬৭)
ঈমানী স্বাদ লাভ : শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসলে ঈমানের স্বাদ পাওয়া যায়। আনাস রা: থেকে বর্ণিত, নবী করিম সা: বলেন, ‘যার মধ্যে তিনটি গুণ বিদ্যমান সে ঈমানের স্বাদ পাবে- ক. যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সর্বাধিক ভালোবাসে; খ. যে শুধু আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসে এবং গ. আল্লাহ যাকে কুফরি থেকে মুক্তি দিয়েছেন সে কুফরিতে ফিরে যাওয়াকে এমনভাবে অপছন্দ করে, যেভাবে অপছন্দ করে আগুনের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে।’ (বুখারি, হাদিস-৫৮২৭; মুসলিম, হাদিস-৯৪)
ঈমানের পূর্ণতা লাভ : আমরা যখন আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসতে শিখব তখন আমাদের ঈমানের পূর্ণতা লাভ করবে। আর ঈমানের পূর্ণতা প্রতিটি মুসলিমের জন্যই কাম্য। আবু উমামা রা: বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসে, আর আল্লাহর জন্য কারো সাথে বিদ্বেষ পোষণ করে এবং আল্লাহর জন্যই দান-খয়রাত করে আবার আল্লাহর জন্যই দান-খয়রাত থেকে বিরত থাকে, সে যেন ঈমান পূর্ণ করল।’ (মিশকাত, হাদিস-৩০)
আখিরাতে উচ্চ মর্যাদা লাভ : আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসলে আখিরাতে উচ্চ মর্যাদা লাভ করা যায়। রাসূল সা: বলেন, আল্লাহ বলেন, ‘আমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যারা পরস্পরকে ভালোবাসে, তাদের জন্য (পরকালে) থাকবে নূরের মিম্বার, যা দেখে নবী ও শহীদরা ঈর্ষা করবেন।’ (তিরমিজি, হাদিস-২৩৯০)
কিয়ামতের দিন আরশের নিচে স্থান লাভ : শেষ বিচারের দিনে আল্লাহর আরশ ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না। আর আল্লাহর জন্য ভালোবাসার আরো একটি মূল্যবান নেয়ামত হচ্ছে হাশরের ওই কঠিন বিচারের দিনে আল্লাহর আরশের ছায়া লাভ। রাসূল সা: বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন বলবেন, ‘আমার মহিমা ও শ্রেষ্ঠত্বের জন্য পরস্পরকে যারা ভালোবেসেছিল তারা কোথায়? আজ আমি তাদের ছায়া দেবো আমার ছায়াতলে, যেদিন কোনো ছায়া নেই আমার ছায়া ছাড়া।’ (মুসলিম, হাদিস-২৫৬৬) অতএব আমাদের প্রত্যেকের উচিত একে অপরকে শুধু আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য ভালোবাসা। তাহলে দুনিয়াতে যেমন আমাদের মধ্যে সর্বদা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকবে, ঠিক তেমনই আখিরাতের ওই মহা নেয়ামত আমাদের চিত্তে প্রশান্তি ঘটাবে। লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়