আগামী ছয় মাসে তৈরি পোশাক ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার বড় আশংকা আছে দেখছেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের মূল ক্রেতাদেশ বা রফতানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ আরো কিছু দেশ। মোট পোশাক রফতানির সিংহভাগেরই ক্রেতা এ দেশগুলোর জনসাধারণ। চলমান ভূরাজনৈতিক সংকটে বৃহৎ অর্থনৈতিক ধাক্কার ঝুঁকিতে রয়েছে ইউরোপ। এ অবস্থা দেশগুলোর প্রবৃদ্ধিকে ধীর করে দিতে পারে বলে পূর্বাভাস পাওয়া গিয়েছে। যুদ্ধের ডামাডোল এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে তুলছে। এজন্য ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ইসিবি) চলতি বছরের মাঝামাঝিতে বাজারে নগদ অর্থ সরবরাহ বন্ধ করতে সম্মত হয়েছে। বছরের শেষদিকে ঋণের সুদহার বাড়ানো হবে বলেও জানানো হয়েছে। এমনটা করলে এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো ইউরো অঞ্চলে সুদহার বাড়বে। ইসিবির নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যেকোনো উপায়ে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে বর্তমানে এ হার ক্রমবর্ধমান ও তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক ওপরে। মূল্যস্ফীতিকে ২ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্য ছিল, যা ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশ অনুরূপ লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে। কারণ এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি বিস্তৃত জনগোষ্ঠীর ওপর কঠোর চাপ তৈরি করেছে। ফলে বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে ফেব্রুয়ারি শেষে ১২ মাসে মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দেশটিতে মূল্যস্ফীতির এ হার ১৯৮২ সালের পর সর্বোচ্চ। এদিকে চলতি বছর ইউরো অঞ্চলের মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। এটি ইসিবির ২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণেরও বেশি। বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৪ সালের আগে মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশে নামার আশা নেই। পশ্চিমা দেশগুলোর এ পরিস্থিতিতে আগামী বছরের ক্রয়াদেশ নিয়ে গভীর উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারকরা। তাদের এ উদ্বেগ যৌক্তিক জানিয়ে ভবিষ্যৎ ক্রয়াদেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশী তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরাও।
ইউরোপভিত্তিক একটি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে তিনি জানান, আগামী ছয় মাসে ক্রয়াদেশের প্রবাহ কম হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। রাশিয়া অনেক বড় দেশ। সেখানে সব বিক্রয়কেন্দ্র এখন বন্ধ। যে কোম্পানিগুলো ওই বাজারের জন্য পণ্য কিনেছিল, তার বড় একটি অংশ গুদামে পড়ে আছে। জাহাজীকরণের প্রক্রিয়ায় ছিল, এমন অনেক পণ্যের চালান স্থগিত করা হয়েছে। একদিকে বিক্রি হচ্ছে না, তারপর আবার অতিরিক্ত পণ্য জড়ো হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে রাশিয়ার মার্কেটের জন্য কেনা পণ্যগুলো ক্রেতারা লেবেল পরিবর্তন করে অন্য দেশগুলোয় বিক্রির চেষ্টা করছেনÍএমনটা জানিয়ে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধি বলছেন, এ পরিস্থিতির একটা প্রভাব সামনে দৃশ্যমান হতে পারে। বিশ্বজুড়েই মন্দার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অনেক দেশই জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে। এতে পরিবহন খরচ বেড়েছে। ফলে আগামীতে পণ্যের দাম বাড়াতে চাইবেন ক্রেতারা। কিন্তু চূড়ান্ত ক্রেতা বা ভোক্তা দাম বেশি দিতে চাইবেন না। আবার ইউরোপের কিছু জায়গায় বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ। এ পরিস্থিতিতে ক্রেতারা ক্রয়াদেশ কমিয়ে দেবেন। সব মিলিয়ে আগামী ছয় মাসে ক্রয়াদেশ শ্লথ হওয়ার বড় সম্ভাবনা আছে।
ইউরোপভিত্তিক একাধিক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের পোশাক সরবরাহকারীরা এখনো সংকটের মুখোমুখি তেমন একটা হননি। কিন্তু পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা এখনই দেখা যাচ্ছে। যুদ্ধ ও জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে এরই মধ্যে বিক্রির গতি অনেক কমে গিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন ক্রেতারা। জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় লজিস্টিক খরচ বেড়ে গিয়েছে অনেক। কাঁচামালের দাম বেড়েছে। জায়ান্ট ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বড় সমস্যা এখন কারেন্সি। সবকিছু কেনা হয় মার্কিন ডলারে, যা এ মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রা। কিন্তু পণ্য বিক্রি হয় ইউরোসহ ইউরোপের অন্যান্য মুদ্রায়। এ মুদ্রাগুলো ডলারের চেয়ে তুলনামূলক দুর্বল। ক্রেতারা কিনছেন শক্তিশালী মুদ্রায়, কিন্তু বিক্রি করছেন দুর্বল মুদ্রায়। যখন মুদ্রা রূপান্তর হচ্ছে তখন ক্রেতারা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। ইউরোপের সব ব্র্যান্ডেরই এখন এটা একটা বড় সমস্যা। এ সমস্যা সরাসরি ক্রেতার মুনাফায় প্রভাব ফেলছে, যার পরোক্ষ প্রভাব পণ্য সরবরাহকারীর ওপরও পড়বে।
পোশাক রফতানি ও প্রস্তুতকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, মূল্যস্ফীতি সমস্যা বড় আকার ধারণ করতে পারে আগামী অর্থবছরে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিগুলো মন্দার শঙ্কার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ক্রেতাদেশগুলো এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতির চাপে পড়তে শুরু করেছে। এর প্রভাবে ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিয়েছেন তারা। যারা ক্রয়াদেশ দিয়ে ফেলেছেন, তারা ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করছেন। এইচঅ্যান্ডএম, জারাসহ আরো বেশকিছু ব্র্যান্ডের বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে ক্রেতাদেশগুলোয় বিশেষ করে ইউরোপে এখন বড় অগ্রাধিকার খাদ্যদ্রব্য। পোশাক এখন অগ্রাধিকারের জায়গায় থাকার কোনো কারণ নেই। এ পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছর রফতানি প্রবৃদ্ধি ৮ বা ৯ শতাংশে নেমে আসবে। আর যদি মন্দা দেখা দেয়, তাহলে আরো খারাপ অবস্থা হবে।
তবে কেউ কেউ ভিন্নমতও পোষণ করছেন। তাদের দাবি, পোশাকের বৈশ্বিক ক্রয়াদেশ কমবে। কিন্তু বাংলাদেশে তার বড় প্রভাব দেখা নাও যেতে পারে। কারণ ক্রেতারা কম মূল্যে সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহের বিকল্প দেশ হিসেবে বাংলাদেশকেই বেছে নেবেন। ইপিলিয়ন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন আল মামুন বলেন, আগামী অর্থবছর একদিকে মূল্যস্ফীতির প্রভাবে বিক্রি কম হবে। অন্যদিকে এ সময়ে ক্রেতাদেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়বে। কারণ চীনের সঙ্গে মার্কিন বিরোধ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হবে। এরই মধ্যে অনেক ক্রেতা চীন থেকে সরে আসছিলেন। আগামী দিনে এ প্রবণতা বাড়বে। এদিকে শ্রীলংকায় যে ক্রয়াদেশগুলো যেত, সেগুলোও বাংলাদেশের দিকেই ধাবিত হবে। অর্থাৎ ক্রয়াদেশ কমলেও তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কমবে বলে আমি মনে করি না।
আগামী অর্থবছরে ক্রেতাদেশগুলোর মূল্যস্ফীতি উদ্বেগের ক্ষেত্র হয়ে উঠবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্য যে পরিস্থিতি গুরুত্ব পাবে সেটা হলো কাঁচামাল। এটা কীভাবে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যাবে সে বিষয়টি দেখতে হবে। কারণ এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং বৈশ্বিক বিষয়। ক্রেতাদের কাছ থেকে আমরা কীভাবে আদায় করতে পারব সেটা নির্ভর করবে সমঝোতার ওপর। সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে সমঝোতার দক্ষতার ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের ব্যবসা। তবে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বলছেন, বাংলাদেশের ক্রয়াদেশ কমবে, তা নিশ্চিত। আর যেসব ক্রয়াদেশ আসবে, সেগুলোয় ক্রেতার পক্ষ থেকে থাকবে মূল্য কমানোর চাপ। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের আরেক বৃহৎ ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধটা এখন এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধে পরিণত হচ্ছে। রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে বিরোধ দেখা দিয়েছে, সেটা খুব দ্রুতই শেষ হবে না। অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধের ডামাডোলটা হয়তো কমবে, কিন্তু অন্যান্য যুদ্ধ রয়ে যাবে। শীতে জ্বালানির চাহিদা পশ্চিমা দেশগুলোয় দ্বিগুণ হয়ে যায়। সেটা কীভাবে মেটানো যাবে তা অনিশ্চিত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতিতে ধাক্কার প্রভাবে খাদ্য, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক চাহিদা মেটানোয় ভোক্তারা বেশি মনোযোগী থাকবেন। ফলে বিলাসপণ্য ব্যবহার কমে যাবে। মধ্যবিত্তের আপস করার ক্ষেত্রটি হলো পোশাক। নভেম্বরে ব্ল্যাক ফ্রাইডে, এরপর আছে ক্রিসমাস। যে পরিমাণ ক্রয়াদেশ আসার কথা ছিল সেই পরিমাণ ক্রয়াদেশের কোনো ইঙ্গিত বাংলাদেশে এখন নেই। ২০২২-২৩ অর্থবছর সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হবে তেল ও মুদ্রার। পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যকার সেই যুদ্ধে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের মতো পণ্য সরবরাহকারী দেশগুলো। এখনই ক্রেতাদের বিক্রয়কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়েছে। পণ্য যা আমদানি করা হয়েছে সেগুলো বিক্রি হচ্ছে না। এ অবস্থায় সতর্ক হয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ছাড়া আর তেমন কিছু করার নেই। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পণ্য রফতানির অর্থমূল্য ৫০ বিলিয়ন ডলার ছুঁই ছুঁই করছে। এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছে প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক। তবে এখন পণ্যটির ক্রেতাদেশগুলো রয়েছে যুদ্ধসৃষ্ট বিপর্যয়ের মুখে। জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও ঊর্ধ্বমুখী। রফতানি গন্তব্যগুলোয় মূল্যস্ফীতির বিরূপ প্রভাব হিসেবে আগামীতে পোশাকের বিক্রি কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে মারাত্মক ভোগান্তির শিকার হতে পারে দেশের রফতানিমুখী পোশাক শিল্প।