মানুষের সুস্থতার অন্যতম বিষয় হলো মানসিক প্রশান্তি। এটি নির্ভর করে মানসিক সুস্থতার ওপর। নিকট অতীতে গোটা বিশ্ব কভিড-১৯-এর বড় একটি ধকলের মুখোমুখি হয়েছে। এ সময় ভয় ও পেরেশানি বেশির ভাগ মানুষকে গ্রাস করেছে। আজও মানুষ এই ভয়ানক ভীতিকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পায়নি।
ইসলামে মানসিক স্বাস্থ্য বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল। একজন মানুষের ভালো বা স্বস্তিকর অবস্থা বজায় রাখার জন্য তার জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন। মানুষের দুনিয়াবি ও ধর্মীয় দাবি পরিপূর্ণ করার জন্য দরকার তার মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা। ইসলাম মানুষের জন্য কতগুলো ঐশী বিধান জারি করেছে। মানুষ স্রষ্টার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে একটি সুন্দর, পরিচ্ছন্ন ও দুর্ভাবনাহীন জীবন লাভ করতে পারে। ইসলামী রীতি মানসিক সুস্থতা, স্থিরতা ও স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য আধ্যাত্মিকতাকে গুরুত্ব দিয়েছে। পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সরাসরি বা পরোক্ষভাবে মানসিক স্বস্তি এবং ধৈর্যের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। অতীত কালের বহু মুসলিম চিকিৎসক ও দার্শনিক মানুষের মানসিক রোগ-বালাইয়ের অস্তিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তাঁরা এই রোগ নির্ণয় ও নিরসনের উপায় নিয়েও নানা পরামর্শ দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, পৃথিবীর প্রথম মানসিক হাসপাতাল মুসলমানরাই ১৮ শতকে প্রতিষ্ঠা করেন।
যা হোক, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যারা উদ্বিগ্ন তাদের প্রতি পরামর্শ হলো আধ্যাত্মিকতা ও বাস্তবতার নিরিখে ভয়ভীতি ও পেরেশানির উপশম করা। পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে আমরা বিষয়টি আরো পরিষ্কার করতে পারি। আর সব কষ্ট এবং মানসিক দুশ্চিন্তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মানুষ এই মূল্যবান উপদেশ সব সময় স্মরণ করতে পারে। সুরা আল-বাকারার ১৭৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন : ‘তোমরা তোমাদের মুখম-লকে পূর্ব দিকে ফেরাও বা পশ্চিম দিকে ফেরাও, এতেই কিন্তু সব নেকি নিহিত নেই, তবে আসল নেকি হচ্ছে এটা যে একজন মানুষ ঈমান আনবে আল্লাহর ওপর, পরকালের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর, (আল্লাহর) কিতাবের ওপর, (কিতাবের বাহক) নবী-রাসুলের ওপর এবং তাঁর দেওয়া সম্পদের ওপর তার (প্রবল) ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও সে তা (তার) আত্মীয়-স্বজন, এতিম-মিসকিন এবং পথিক মুসাফিরের জন্য ব্যয় করবে, সাহায্যপ্রার্থী (দুস্থ মানুষ, সর্বোপরি) মানুষদের (কয়েদ ও দাসত্বের) বন্দিদশা থেকে মুক্ত করার কাজে অর্থ ব্যয় করবে, (দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য) জাকাত আদায় করবে। (তা ছাড়াও আছে সেসব পুণ্যবান মানুষ), যারা প্রতিশ্রুতি দিলে তা পালন করে, ক্ষুধা দারিদ্র্যের সময় ও (বিশেষ করে হক বাতিলের) যুদ্ধের সময় এরা ধৈর্যধারণ করে, (মূলত) এরাই হচ্ছে সত্যবাদী এবং এরাই হচ্ছে প্রকৃত আল্লাহভীরু মানুষ। ’
মহান আল্লাহ সুরা জুমারের ৩৮ নম্বর আয়াতে আরো বলেন : ‘হে নবী! আপনি যদি তাদের জিজ্ঞেস করেন, কে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। তাদের জিজ্ঞেস করুন, যখন বাস্তব সত্য এটাই (তখন কি তোমরা চিন্তা করো না যে) আল্লাহ যদি আমার কোনো ক্ষতি করতে চান, তা হলে তোমরা আল্লাহকে ছাড়া যাদের ডাকো তারা কি তাঁর ক্ষতি থেকে আমায় বাঁচাতে পারবে? অথবা আল্লাহ যদি আমার প্রতি মেহেরবানি করেন তা হলে তারা কি তাঁর রহমতকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে? আপনি বলে দিন, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। ভরসাকারীরা শুধু তাঁরই ওপর ভরসা করে থাকে। ’এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভয়ের অনুভূতি প্রশমিত করার জন্য ধর্মীয় উপদেশ বা নীতি মনে চলা খুবই জরুরি। আমরা লক্ষ করছি, করোনাভাইরাস সমূলে নির্মূলের প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। একেবারে আস্থার সঙ্গে এ কথা বলার সময় এখনো হয়নি যে এই ভাইরাসের কার্যকর প্রতিষেধক খুব শিগগির বের করা সম্ভব হবে। তবে মুসলমান মাত্রই বিশ্বাস করেন যে প্রতিটি অসুস্থতা এবং রোগের প্রতিকার অবশ্যই আছে। যদিও এসব প্রতিষেধক সবার অজানা। মহানবী (সা) বলছেন : আল্লাহ এমন কোনো রোগ দেননি যার কোনো প্রতিষেধক নেই। (সহিহ বুখারি) এই হাদিসের মর্মার্থ এটাই যে ইসলাম রোগের টিকা ও চিকিৎসার জন্য উৎসাহ প্রদান করেছে। মানুষ যখন তার মনের গভীরে মজবুত বিশ্বাস পোষণ করে যে আল্লাহ অবশ্যই তার সমস্যা দূর করবেন, তখন থেকেই তার মন থেকে সব অনিশ্চয়তা, ভীতি ও উদ্বেগ প্রশমিত হতে শুরু করে। এ প্রসঙ্গে সুরা আলে-ইমরানের ১৫৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন : ‘তুমি যখন একবার সংকল্প করে নেবে, তখন (তার সফলতার জন্য) আল্লাহর ওপর ভরসা করো, অবশ্যই আল্লাহ (তাঁর ওপর) নির্ভরশীল মানুষদের ভালোবাসেন। ’ একজন ঈমানদার জানে, আল্লাহ তাআলা চরম কষ্ট ও দুর্ভোগের পর রেখেছেন প্রশান্তি বা অনাবিল সুখ। এ কথা সুরা ইনশিরাহর ৫-৮ নম্বর আয়াতসমূহে আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন এভাবে : ‘সুতরাং কষ্টের সঙ্গেই আছে সুখ। নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গেই আছে সুখ। অতএব, যখনই তুমি অবসর পাবে, তখনই কঠোর ইবাদতে রত হও। আর তোমার রবের প্রতি আকৃষ্ট হও। ’ ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ‘মানসিক স্বাস্থ্য’ বলতে আমরা বুঝি, জীবনের সংকট বা জটিলতা সফলভাবে মোকাবেলা এবং স্রষ্টার প্রতি বিশ্বস্ত এবং অনুগত থেকে বলিষ্ঠতা সহকারে নিজের সামর্থ্য বা সক্ষমতা তৈরি করা। ইসলামী চিন্তাবিদদের একদল এটা বলার চেষ্টা করেছেন যে মানসিক প্রশান্তির জন্য প্রতিদিন কয়েক মিনিট বা কিছুক্ষণ একান্তে বা নির্জনে কাটানো যেতে পারে। এই চিন্তার পক্ষে যাঁরা, তাঁরা বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর হেরা গুহায় বসে ধ্যানমগ্ন থাকার অবস্থাকে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে পেশ করেন। এ কথায় আস্থাশীলরা মানসিক স্বাস্থ্যের ইসলামী ধারণাকে মানবজীবনের জন্য পালনীয় ও অনুকরণীয় বলে দাবি করেন। কোরআন ও হাদিসের আলোকে ওপরের আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়, একমাত্র ইসলামের আদর্শই মানসিক প্রশান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে।
লেখক : সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি., বর্তমানে হেড অব বিজনেস ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড শরিয়াহ সেক্রেটারিয়েট এবং কো-অর্ডিনেটর স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড (শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক)